-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (শেষ পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (শেষ পর্ব) তাহমিনা খাতুন চৌব্বিশ. দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেছে। হাবিবুর, মোমিনা দুজনেরই বয়স বেড়েছে। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে সবাই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবুও হাবিবুর রহমান এখনো পুরোপুরি অবসরে যাননি। গ্রামের মসজিদে ইমামতি, সংসারের টুকটাক কাজ কর্ম, বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া জমিতে শাক-সবজি লাগানো ইত্যাদি করে সময় কাটান। আষাঢ় মাস। আকাশ কালো করে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। নূরপুরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। হাবিবুর রহমান একটা ছাতা নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই মাগরিবের নামাজের ইমামতি করার জন্য মসজিদে চলে গেছেন। মাগরিবের নামাজের ইমামতি শেষ করে হাবিবুর রহমান সাধারণত এশার নামাজের সময় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন এবং একেবারে এশার…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব) তাহমিনা খাতুন বাইশ. নূরপুরের মধ্যপাড়ার জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়ির বড়ো উঠানের এক কোণে অনেকগুলো বাঁশের চাটাই আর খেজুর পাতার পাটি বিছানো। সন্ধার কিছুক্ষণ পরে পূবপাড়া আর দক্ষিণপাড়ার বেশ বিশ-পঁচিশজন বিভিন্ন বয়সের মানুষ উঠানে বিছানো চাটাইয়ের উপর এসে বসল। কিছুক্ষণ পরে জান্নাতুল ফেরদৌসের এক মাত্র ছেলে ফেরদৌস তার বিছানার পাশের জানালা খুলে সবাইকে সালাম দিল। ফেরদৌসের বয়স এখন চব্বিশ বছর। চাটাইয়ে অপেক্ষমান লোকজনের মধ্য থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের আক্কেল আলি উঠে এল ফেরদৌসের জানালার পাশে। ফেরদৌস আক্কেল আলিকে সালাম দিয়ে বলল, “আক্কেল ভাই, আপনারা সবাই যে উদ্দেশ্যে আমার বাড়িতে এসেছেন, তা আমি জানি। নূরপুরের সমাজ প্রধান…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১০ম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১০ম পর্ব) তাহমিনা খাতুন বিশ. নূরপুরের মধ্যপাড়ায় কলিমউদ্দিন খন্দকারের বড়ো ঘরটার পিছনে ফলের বাগানের বিশাল বিশাল আম, লিচু গাছের ডালগুলো মুকুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। পিছনের বড়ো মগডালে বসে একটা কোকিল মধুর সুরে ‘কু-উ-উ কু-উ-উ’ স্বরে ডেকে যাচ্ছে। উঠানের এক পাশে একটা সুপারি গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা দুটো ছাগল একটানা ‘ম্যা ম্যা’ করে চলেছে। উঠানের আরেক কোণে একটা পলোর নিচে কয়েকটা মুরগির বাচ্চা পলোর বাইরে আসার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পলোর বাইরে মা মুরগি ছানাদের বাইরে বের হয়ে আসার জন্য ডেকে চলেছে। একটা চিল মুরগি ছানাগুলোকে লক্ষ্য করে কয়েকবার হানা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘরের বারান্দায় বাড়ির…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৯ম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৯ম পর্ব) তাহমিনা খাতুন আঠারো. কয়েক মাস হলো নূরপুরের মধ্যপাড়ার শিহাব উদ্দিনের বড়ো ছেলে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে শাজাহান পুরের জয়নাল মিয়ার মেয়ে মোমিনার বিয়ে হয়েছে। সন্ধ্যার পরে পালকিতে চড়ে মোমিনা স্বামীর ঘর করতে চলে গেল। শূন্য ঘরে ফিরে এলো হালিমা। দশ বছর পরে জয়নালের শোক যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে। বুকের মধ্যে যে ছাই চাপা আগুন ধিকিধিকি করে পুড়িয়েছে হালিমাকে, মোমিনার মুখের দিকে চেয়ে যে আগুনকে জ্বলে উঠতে দেয়নি, আজ মোমিনাকে স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সে আগুনের স্ফুলিঙ্গে যেন শতধা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল হালিমার শূন্য হৃদয় জুড়ে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দশ বছরের পুঞ্জীভূত বেদনা আর…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৮ম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৮ম পর্ব) তাহমিনা খাতুন ষোলো. শ্রাবণ মাস। বিকালের দিকে নূরপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আত্রাই নদীর পাড়ে একটি বড়ো নৌকা এসে থামল। নৌকা ভর্তি চাল, ডাল, লবণ, তেলের বড়ো বড়ো বস্তা এবং আরও বিভিন্ন মনিহারি সামগ্রীতে ঠাসা। নৌকা থেকে নামল হাবিবুর রহমান; সাথে আরও চার পাঁচ জন লোক। তারা মালপত্রগুলো ধরাধরি করে নামাতে লাগল। মৃত শিহাব উদ্দিন খোন্দকারের বড়ো ছেলে হাবিবুর রহমান এখন বাইশ তেইশ বছরের পরিপূর্ণ যুবক। শিহাব উদ্দিনের বড়ো বোন আর খালা মিলে তাঁর তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন। আত্রাই নদীর পাড় থেকে সামান্য দূরে নূরপুর গ্রামে প্রবেশের হালট ঘেঁষে হাবিবুর রহমানের মনিহারি সামগ্রীর দোকান।…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৭ম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৭ম পর্ব) তাহমিনা খাতুন তেরো. অঘ্রান মাসের প্রায় শেষ। শীত পড়তে শুরু করেছে। কৃষকের নতুন ফসল কেটে মাড়াই করে গোলায় তোলা শেষ। মরা কার্তিকের আকালের দুর্দশা ঘুচিয়ে গরিব পরিবারগুলোতেও অভাবের মুখ-ব্যাদান করা রূপটি সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ঢাকা পড়েছে। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোতে নবান্নের উৎসব চলছে। গ্রামের খেজুর গাছগুলোতে ঝুলছে লাল আর কালো রঙের রসের হাঁড়ি। বাড়িতে বাড়িতে চলছে পিঠে, পুলির আয়োজন। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। সবার গায়েই শীতের পোশাক। কয়েক মাস আগের ঘটনা। গ্রীষ্মের এক বিকেলে একটি ছইওয়ালা মহিষের গাড়ি নূরপুরের মধ্যপাড়ার শুকুর কাজির বাড়ির সামনের উঠানে এসে থামল। শুকুর কাজির বড়ো ছেলে ওয়াদুদ কাজি গাড়িতে শোয়া। গাড়োয়ান গাড়ি…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৬ষ্ঠ পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৬ষ্ঠ পর্ব) তাহমিনা খাতুন দশ. তিন বছর হলো জয়নাল মারা গেছে। শিশু কন্যাকে নিয়ে কোনো মতে স্বামীর ভিটায় জীবন পার করছে আঠারো বছরের হালিমা। শ্বশুরের আমলের টিনের ছাউনি দেওয়া চার চালা বড়ো ঘরটিতেই ছোট্ট মোমিনাকে নিয়ে ঘুমায় সে। শ্বশুরের আমলে করা বিশাল বাড়িটির চার পাশেই আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুর বড়ো বড়ো গাছ, ঝোপঝাড়। কেমন যেন গা ছমছম করা একটা পরিবেশ। রাতে দরজা জানালা ভালোভাবে বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। বিছানার বালিশের নিচে খেজুর গাছ কাটার একটা হাঁসুলি রেখে দেয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পরই ঘুম ভেঙে যায়। গত কয়েকদিন ধরেই ঘরে ফসল রাখার জন্য তৈরি বাঁশের বড়ো মাচাটার…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৫ম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৫ম পর্ব) তাহমিনা খাতুন আট. নুরুল ইসলামের তিনটি ছেলেমেয়ে। বড়ো ছেলে আতিকুল ইসলাম বটতলা হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়ায় যেমন মনোযোগী তেমনি বাপের মতো সেবামূলক কাজের প্রতি বেশ আগ্রহ। কারও কোনো বিপদের কথা শুনলে সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। বেশ কিছু দিন ধরে চল্লিশ/বিয়াল্লিশ বছর বয়সের মানসিক রোগগ্রস্থ এক নারী মধ্যপাড়ার নুরুল ইসলামের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ‘সুন্দরী’। বাড়ি কোথায়, বাপ মা আছে কিনা কিছুই বলতে পারে না। সারা দিন আপন মনে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে চেয়ে-চিন্তে খাবার খায়। রাতে নুরুল ইসলামের ঘরের ভিতরের বারান্দায় এসে শুয়ে…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৪র্থ পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৪র্থ পর্ব) তাহমিনা খাতুন ছয়. চৈত্র মাসের শেষ। দুই মাস ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। ভোর হতেই লাল সূর্য যেন চারদিক পুড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে হাজির হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অঙ্গীকার পূরণ করে চলে। প্রচণ্ড রোদের তাপ চারদিক ঝলসে দেয়। আরও একটা তাপদগ্ধ দিনের অবসানের পর সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আগমন ঘটেছে। আকাশের এক কোণে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ মুখে এক রাশ উজ্জ্বল হাসি নিয়ে যেন পরম মমতায় পৃথিবীর দিকে অপলকে চেয়ে আছে। রুপোলি জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। সে হাসি যেন ছড়িয়ে পড়েছে নারকেল গাছের পাতায় পাতায়। সন্ধ্যার পর মৃদু বাতাস বইতে শুরু করেছে। পূবের এই শীতল বাতাস নূরপুরের হাঁসফাঁস…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৩য় পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৩য় পর্ব) তাহমিনা খাতুন চার. দুইদিন পর জয়নালকে নৌকা করেই গঞ্জে পরেশ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল শাহাবুদ্দিন। সকাল দুপুর গড়িয়ে গেল। জয়নালকে নিয়ে শাহাবুদ্দিন ফিরলো না। উৎকণ্ঠায় ঘরে পায়চারি করছে হালিমা। বিকালের দিকে দুইজন লোক ধরে ধরে অসুস্থ জয়নালকে শাহাবুদ্দিনের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। শাহাবুদ্দিন কোথায় জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে লোক দুজন বেরিয়ে গেল। জয়নালকে জিজ্ঞেস করলে সেও চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠল সে। “তোমার ভাই আমার অনেক বড়ো সর্বনাশ করেছে। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে গেছে। আমি সামান্য কয়েকটা টাকা ধার নিয়েছিলাম তার কাছ…