নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ২য় পর্ব।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ২য় পর্ব
- এ কে আজাদ দুলাল
মেয়েকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢোকেন রাকিব আহমেদ। এর আগে এভাবে কখন একাকী ঢাকার রাইরে যায়নি রাকা। একটা অশান্তি বয়ে বেড়াচ্ছে মনের ভেতরে। মনে মনে মেয়ের মঙ্গল কামনা করেন। পনের মিনিটের মধ্যে রেলস্টেশনে পোঁছে যায় রাকা। সকালে যানজট কম থাকে। বারিধারা হতে রেল স্টেশন বেশি দূরে নয়। গাড়ি হতে নেমেই দেখা হয়ে যায় মনিকার সাথে। একজন কুলি আগেই ঠিক করে অপেক্ষা করছিল মনিকা। কুলি তাদের লাগেজ মাথায় আর হাতে নিয়ে আগে হাঁটতে থাকে। তারা দুজন পিছনে হাঁটছে। রেল স্টেশন রাকার কাছে অদ্ভুত লাগছে। বিভিন্ন ধরনের মানুষের আনাগোনা। অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। অনেকটাই আশ্চর্য হয়ে যায় রাকা। জীবনে এ ধরনের রেল স্টেশন আগে কখনো দেখেনি। কী জানি ট্রেনের ভেতরে কী রকম পরিবেশ। মন খারাপ হয়নি রাকার। স্বল্প আয়ের দেশ। স্বাধীনতার পর হতে দেশ অনেক বার ক্রাইসিসে পড়েছে; আস্তে আস্তে সচল হচ্ছে। আগামীতে আরও হবে যদি কোনো অঘটন না ঘটে; মনিকা আঁচ করতে পেরেছে।
— ম্যাডাম, দেশটা বেশি দিন স্বাধীন হয়নি। তারপর সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতার স্থপতি সপরিবারে নিহত হন। তারপর চলে সামরিক শাসন। বিদেশে ছিলেন তো কিছু জানেন না। আগামীতে আরও উন্নতি দেখতে পারবেন। ইতোমধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে এসে লাগেজ রেখে কুলি বলল,
— ট্রেন আসতে আর পনের মিনিট সময় লাগবে। সময়মতো এসে মালপত্র যথাস্থানে উঠিয়ে দেব।
কুলি লাপাত্তা হয়ে গেল। মনিকা রাকার মুখের পানে চেয়ে ফিক করে হেসে দেয়।
আরও পড়ুন প্রিয়তমার লাল চোখ
— মনিকাদি, একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রাখা কর্তব্য। আপনি আর আমি এক সাথে পা বাড়িয়েছি। এখানে আপনি নয় তুমি। এক জনমের বোন ছিলাম, আবার মিলিত হলাম।
— চমৎকার, তুমি তো সুন্দর বাংলা বলতে পারো। তাই হবে।
— আমরা যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন আমার বয়স আট-নয় বছরের মতো হবে। ছুটির দিনে বাবা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে বাংলা পল্লিতে নিয়ে যেতেন। সেখানে অনেক বাঙালি বসবাস করেন। তাদের কালচার ছিল একদম আলাদা। একটা অ্যাকাডেমি ছিল। সকাল হতে বিকেল পর্যন্ত বাংলা ভাষা, গান, আবৃত্তি আসলে বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি বলতে যা বুঝায় তা শেখানো। আমি দুটো জিনিস শিখেছিলাম।
— সেটা আবার কী? উৎসুক হয়ে জানতে চাইল মনিকা।
— প্রথমটা হলো, বাংলা ভাষা ভালো করে আয়ত্ত করা, তারপর রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাবা বলতেন কাঁচা বয়সে যা শিখবে জীবনে কোনো দিন ভুলবে না। পরিণত বয়সে জ্ঞানার্জন করা যায়। বাবার কথাগুলো এখনো কানে বাজে। তাই তো আমলার পরিবর্তে শিক্ষকতা বেছে নিয়েছি। এখানেই উর্দুভাষী মায়ের ঘোর আপত্তি। আমলা হব, সবাই ম্যাডাম বলে ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে। কী ধ্যান-ধারণা আমাদের সমাজের। জানো মনিকাদি, ভালো ইংরেজি জানা সত্ত্বেও সবার সাথে বাংলায় কথা বলি। কিন্তু ক্লাসে ইংরেজিতেই কথা বলে থাকি। কেউ যদি না বুঝে বলে দেয় ইংরেজি সাহিত্য পড়া প্রয়োজন নেই।
— তোমাকে যতই দেখছি নিজের ভেতরে তোমাকে আপন করে নিচ্ছি। নিজেকে ধন্য মনে করছি। আজ আমি একা নই। মনের জমানো কথা তোমাকে বলব। জানো মনিকাদি, ঢাকায় এসে ইংলিশ ভার্সনে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হই, তখন অনেকের খারাপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে। আমার উর্দুভাষিনী মা তো উঠতে-বসতে কম কথা শোনাননি। চাষাভুষা পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সাথে উঠবস করছি। আরও কত কী! আমাদের একটা সোসাইটি আছে। তাদের পরিবার তো শুনে রি রি করে মৌমাছির ডানা মেলে গান গাইত।
আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম
— তোমার বাবা কী বলতেন?
— না। বরং তার আগ্রহে আমি ভর্তি হয়েছিলাম। আমার স্কুলের সহপাঠিদের অনেকের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। সুন্দর ইংরেজি জানতাম বলে স্যাররা অনেক আদর করতেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছি। আমার অনেক ভালো মনের বন্ধু-বান্ধবী আছে। তবুও আমি নিঃসঙ্গ। বাবা সাথি। বাবাকে আজ একা রেখে আসাটা হয়তো মানবিক হয়নি। কিন্তু উপায় নেই।
মনিকার দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হেসে দেয় রাকা। মনোমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মনিকা। এত সুন্দর মিষ্টি চেহারা। অবিকল এক শ্বাশত বাঙালি নারীর মুখ।
— আমার রক্তের সহোদর ভাই দুটো আমেরিকাবাসী আর তাদের স্ত্রীদ্বয় আমার মায়ের মতো উর্দুভাষী পাকিস্তানি। মনিকাদি, এবার বুঝ আমি কোন পরিবারের মেয়ে।
শেষের কথাগুলো শোনাচ্ছিল তাচ্ছিল্য সুরে। মনিকা কী যেন বলতে যাচ্ছিল এমন সময় কুলি এসে তাড়া দিলো ট্রেন এখনই এক নম্বর লাইনে এসে থামবে। লাগেজগুলো মাথায় নিয়ে তাকে অনুসরণ করতে বলে হাঁটতে শুরু করে। তারা নির্দিষ্ট কেবিনে এবং বরাদ্দকৃত দুটো সিটে বসে পড়ে। চাহিদার চেয়ে বেশি মজুরি পেয়ে একফালি চাঁদের বক্র হাসি দিয়ে চলে যায়। মালপত্র ঠিক আছে কি-না মনিকা পরীক্ষা করে দেখে নিল। মনিকা ইচ্ছে করে রাকাকে জালনার পাশে বসতে বলল। রাকা আপত্তি না করে সুবোধ বালিকার মতো বসে পড়ে। বগিতে লোকের সে রকম সমাগম নেই। মনে হয় এসি বগি এজন্য।
— সকালে কি নাশতা করে এসেছ?
— সময় আর কোথায় পেলাম।
— বেশ, আমার ঝুড়িতে কিছু স্যান্ডুইস আছে। খেয়ে নিতে পারো। এখানে চা-কফির ব্যবস্থা আছে।
— অনেক ধন্যবাদ মনিকাদি। তোমার হাতের তৈরি স্যান্ডুইস আর ট্রেনের কফি দারুণ জমবে প্রভাতে ট্রেন ভ্রমণ। ভ্রমনটা অ্যাডভ্যাঞ্জার হবে, কি বলো?
মনিকা কোনো উত্তর না দিয়ে ভাবছে এটা রাকার কোন ধরনের খামখেয়ালি ভ্রমণ। ডা. মাসুদ শুধু বলেছেন, রাকা যেন কোনো বিপদে না পড়ে। সবেমাত্র আধা ঘণ্টা। এত অল্প সময়ে কাউকে জানা যায় না। তবে মেয়েটি সহজ-সরল এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন নীরুপায় নীলাঞ্জনা
— মনিকাদি, সকল ব্যয়ভার আমার। তুমি শুধু আমার গাইড।
ইতোমধ্যে কফি এসে গেছে। কফি হাতে নিয়ে মনিকা হাসে; সেটা তো ডা. মাসুদ বুঝিয়ে বলেছেন তার দায়িত্ব কী। টাকা-পয়সার কথা ভাবতে হবে না। ডা. মাসুদ (ফুলঝুড়ির) কথা বলেছেন। তাছাড়া আর কিছু বললেননি। জায়গাটা তার জানা-শোনা। তার অনেক কলিগ ওই এলাকায় কাজ করেছেন; তাদের মাধ্যমে এলাকার গণ্যমান্য কিছু ব্যক্তির নাম সংগ্রহ করে নিয়েছে। অচেনা জায়গা ফুলঝুড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী রাকার। আবার রাকাও জানে না ফুলঝুড়ির নাম। এ বিষয়ে রাকাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে না। কফি পর্ব শেষ করেছে। রাকা নিমগ্ন হয়ে তাকিয়ে দেখছে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সবুজ মাঠ। আগে হয়তো দেখনি। মনিকা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রাকার জীবন সম্পর্কে ভাবছে। এত বড়ো আমলার সুন্দরী স্মার্ট যুবতী হঠাৎ অচেনা জায়গায় যাওয়ার কারণ কী। ওর বাবা রাকিব আহমেদ কিছু জানেন না। শুধু ডা. মাসুদের উপর নির্ভর করে তাকে বিশ্বাস করে সঙ্গী হিসেবে পাঠিয়েছেন। হে ঈশ্বর সহায় থেকো।
সূর্যের মৃদ আলো গাছের সবুজ পাতার ওপর পড়ে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। অপরূপ বাংলার রূপ। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে রাকা। এত সুন্দর বাংলার মুখ দেখেই বুঝি জীবনানন্দ দাশ সেই বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন—আমি বাংলার মুখ দেখিয়াছি, তাই দেখিতে চাই না আর পৃথিবীর রূপ। কী অসাধারণ!
— কী অসাধারণ, রাকা?
— কেন? জীবনানন্দ দাশের বাংলার মুখ।
রাকা মুডে আছে। এবার জানতে চাওয়া যায় তার এই নিরুদ্দেশের হেতু কী। এর মধ্যে মনিকাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে জানতে চাইল,
আরও পড়ুন কালো কঙ্কাল
— মনিকাদি সংসারী হওনি কেন? মানে বিয়ে করোনি কেন?
মনিকা সুযোগটা হাত ছাড়া করতে রাজি নয়। আগে নিজের কথা বলে তারপর এই নিরুদ্দেশগামী যুবতীর যাত্রার কারণ কী, তাও এক এনজিও সমাজকর্মীর সাথে; তা জানতে চাইবে। অবশ্য এটা ডা. মাসুদ স্যারের অনুরোধে। তিনি একজন পরোপকারী সজ্জন ব্যক্তি। বড়ো ভালো পরিবারের সন্তান।
— বলতে পারি, তবে এক শর্তে। তোমার এই নিরুদ্দেশের কারণ কী?
— বলব বলেই তো তোমার হাত ধরে ঘর ছেড়েছি…
দুজনে জোরে হেসে ওঠে।
আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ২য় পর্ব