নিঃশব্দে-নীড়ে-ফেরা-।।-৩য়-পর্ব
উপন্যাস

নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৩য় পর্ব।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল

নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৩য় পর্ব

  • এ কে আজাদ দুলাল

মনিকা চাকমা রাঙামাটি পাহাড়ি এলাকার এক নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। দু’ভাই বোনের সংসার তাদের বাবা-মায়ের। মনিকা বড়ো। পরিবারের মোট চার জন সদস্য আর আছে একটা গোরু-ছাগল এবং সব সময়ের সাথি বিশ্বস্ত টমি নামের কুকুর। বাবা মাইল তিনেক দূরে একটা কারখানার শ্রমিক। সেই সকালে কারখানায় যেত আর ফিরত রাত করে। রাতে খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়ত, দেখা হতো না বাবার সাথে। সকালে ঘুম ভাঙার আগেই বাবা কাজে চলে যেত। সারাদিন মন খারাপ করে টমি আর দুটো বোবা জন্তু নিয়ে তাদের দিন কেটে যেত। শুধু সাপ্তাহিক একদিন ছুটি ছিল; তাদের আনন্দের পরিপূর্ণ দিন। সারাদিন বাবার সাথে কাটানো, বেড়ানো। বাড়িতে আনন্দে ভরে উঠত। অভাবী ছোটো সংসারে আনন্দের কোনো ঘাটতি ছিল না। অল্প আয়ে তাদের সংসার ছিল সুখে ভরপুর।

ছয় বছর বয়সে মনিকা ভর্তি হয় এনজিওভিত্তিক একটা স্কুলে। ছোটো ভাইয়ের বয়স মাত্র চার বছর। মনিকা মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত লাভ করে। স্কুলের মহিলা শিক্ষকগণ বেশ আদর-যত্ন সহকারে পড়াতেন। আদব-কায়দা ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। চেহারার মধ্যে ছিল নমনীয়তা এবং মার্জিত। সহজেই যে কারও চোখে পড়ার মতো চেহারা। পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পায়। কিন্তু স্কুলটি ছিল নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে। বাড়ি হতে বেশ দূরে মাধ্যমিক স্কুল। মেয়েদের একা যাওয়া-আসা নিরাপদ নয়। মনিকার প্রবল ইচ্ছে, সে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হবে। বাবা-মায়ের ইচ্ছে মেয়ে স্কুলে ভর্তি হোক। স্বরস্বতী দেবীর সুনজর ছিল মনিকার ওপর। একই পাড়ার মনিকার সমবয়সী গৌতম চাকমা ভর্তি হয়েছে ওই স্কুলে। তার সহায়তা এবং আশ্বাসে ভর্তি হলো মাধ্যমিক স্কুলে। এসএসসি পাশ করে ভর্তি হয়েছিল কলেজে। বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে। গ্রামের লোকেরা নানান কথা বলা শুরু করে দেয়।

আরও পড়ুন মাধবী নিশীথিনী

বিয়ের উপযুক্ত মেয়েকে ঘরে রাখা পাপ। দেবী অসন্তুষ্ট হলে বিপদ হতে পারে। অশিক্ষিত সমাজে কত রকম কুসংস্কার। বাধ্য হয়ে মনিকার বাবা মনিকাকে বিয়ের জন্য আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ করে। পেয়ে যায় তাদেরই সহজাতী এক যুবককে। ঘোটক বলেছে ছেলে শহরে মস্ত বড়ো কারখানায় মোটা বেতনের চাকরি করে। বিয়ের পর বউকে বাসায় নিয়ে যাবে। মনিকাদের বাড়ি হতে মাইল চারেক দূরে ছেলের বাড়ি। মনিকাকে দেখে পছন্দ হলো পাত্র পক্ষের। কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল। মনিকার এইচএসসি পরীক্ষা দিতে চায়। বর পক্ষ রাজি হয়েছিল। বিয়ের এক সপ্তাহের পর মানিকাকে তার বাবার বাড়িতে রেখে তার স্বামী কাজে চলে যায়। স্বামী কোথায় চাকরি এবং কীসের চাকরি করে তা জানতে চাইলে ধমকের সুরে বলেছিল,
— এত কিছু তোমার জানা দরকার নেই। প্রতি মাসে হাত খরচের জন্য দু’হাজার করে টাকা পাবে। আর হ্যাঁ, এ টাকা আমার এক বন্ধু প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দিয়ে যাবে।
ঘোটকের কথার সাথে মনিকার স্বামীর চাকরির বিষয়ে কোনো মিল খুঁজে পেল না মনিকার পরিবার।

আরও পড়ুন নতুন সূর্যের অপেক্ষায়

যে ক’দিন মনিকা স্বামী মনিকাদের বাড়িতে ছিল, সে কখনো দিনে বাড়ির বাইরে বের হতো না। সন্ধ্যার অনেক পর রাতের অন্ধকারে তার দু’তিন জন বন্ধু আসত কিন্তু তারা কখনো বাড়ির ভেতরে বা ঘরে এসে বসত না। বাড়ির বাইরে দূরে কথাবার্তা বলত। তাদের হাবভাব দেখে মনিকার মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু স্বামীর বদমেজাজ আর রুক্ষমূর্তি দেখে ভয় পেত মনিকা। হঠাৎ এক রাতে বেশ ক’জন বন্ধু আসে মনিকার স্বামীর কাছে। তারা জানায় কারখানায় জরুরি কাজ পড়েছে, আজকেই যেতে হবে রাজিব চাকমাকে। বেশি দেরি না করে ব্যাগ গুছিয়ে চলে যায় বন্ধুদের সাথে।
মাসের প্রথম সপ্তাহে একজন লোক এসে টাকা দিয়ে যেত মনিকাকে। চেহারা সুরুত দেখে মনে হতো এরা শিয়ালের মতো চতুর এবং নিশাচরী জন্তু। গায়ে জড়ানো থাকত মোটা চাদর। রাজিবের কথা জানতে চাইলে বলত,
— রাজিব গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকে।
লোকগুলো বেশি সময় অপেক্ষা করত না। এমন কী কোনো দিন মনিকাদের বাড়িতে এক গ্লাস পানিও পান করেনি।

মনিকার শ্বশুর বাড়ির লোকজনও জানত না তাদের ছেলে কী কাজ করে। মাসের শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েই তারা খুশি এবং ছেলের প্রসংশায় পঞ্চমুখ।
বেশ কিছু দিন রাজিবের কোনো খোঁজ-খবর নেই। জামাইয়ের খোঁজ নেওয়ার জন্য একদিন রাজিবদের বাড়ি যায় মনিকার বাবা। কিন্তু তাদের কথাবারতায় মনিকার বাবা খুশি হতে পারেনি। চিন্তাযুক্ত মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। মনিকাকে মিথ্যে বলতে হয়েছিল। জামাই বাবাকে কাজের জন্য অফিসের বাইরে পাঠিয়েছে, তাই যোগাযোগ করতে পারছে না। কিন্তু মনিকার বাবার মনে সন্দেহ হয়েছিল রাজিবের বাবার আচরণে এবং কথাবারতায়। কথাবারতায় অসংলগ্ন ছিল।

আরও পড়ুন সুকৃতি এবং বৈরীকাল

প্রায় চার মাস হতে চলে কোনো খোঁজ-খবর নেই রাজিবের। শ্বশুরবাড়ির একই কথা। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল মনিকার পরিবার। যোগাযোগের কোনো ঠিকানা নেই। যারা মাসে মাসে টাকা দিয়ে যেত, তাদের কোনো খোঁজ-খবর নেই। হঠাৎ একদিন শেষ রাতের দিকে দু’জন লোক এসে মনিকার বাবাকে ডেকে একটা দুঃসংবাদ দিয়ে যায়। রাজিব চাকমা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। লোক দুজনের গায়ে ছিল চাদর দ্বারা আবৃত, মাথা ছিল ঢাকা। চোখ-মুখ ছাড়া আর কিছু দেখার উপায় ছিল না। এ পর্যন্ত যে ক’জন লোক মনিকা দেখেছে তাদের একই ধরনের পোশাক এবং আচরণ একই রকম। কথাবারতার ভেতরে কোনো ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। তাদের আচরণ আর বেশভুষা সন্দেহজনক। তাহলে কী চরমপন্থী দলের বেতনভুক্ত সদস্য। যারা পাহাড়ি এলাকায় উৎপাত করে বেড়াচ্ছে; বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করছে। হাজারটা প্রশ্ন মনিকার মাথার ভেতর ঘোরপাক খাচ্ছে। প্রথম দিকেই স্বামীর আচরণে তার মনের ভেতরে অশনি সংকেতের সুর বেজেছিল।

খবরটা পাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মনিকার পরিবার। এখানেই শেষ নয়। বিপদ আসে ঝড়ের গতিতে। মনিকার বাবার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু খবরটা দিয়েছিল। শ্রমিক হলেও তার মালিক এবং কারখানার সবাই তাকে সুনজরে দেখত। রাজিবসহ বেশ ক’জন চরমপন্থী সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত হয়। তারা ছিল বেতনভুক্ত একটা চরমপন্থী দলের সদস্য। তাই মনিকার পরিবার এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সমস্ত তথ্য এখন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। কালবিলম্ব না করে বন্ধুদের পরামর্শে চলে আসে চট্টগ্রামে। প্রাক্তন মালিকের পরিচিত এক কারখানার মালিকের অধীনে চাকরি হয়ে যায়। মনিকা এখন কী করবে। স্বামী নেই। অল্প বয়সে বিধবা। বিধবা মেয়েকে কে বিয়ে করবে। পড়াশোনা করতে চায় মনিকা। ভর্তি হয় এইচএসসিতে। টিউশনি পেয়ে যায়। আর ফিরে তাকাতে হয়নি মনিকার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজকর্মে মাস্টার্স করে। ছোটো ভাইকে ভর্তি করেছে স্কুলে।

আরও পড়ুন সে আমার কেউ

ভাগ্য সুপ্রসন্ন। ঢাকাতে চাকরি হয়ে যায় একটা দামি এনজিওতে। সেখান হতে পরিচয় হয় মনোবিজ্ঞানী ডা. মাসুদের সাথে। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরে দেখেছে। তার মতো কত অসহায় নারী দেখেছে। আপনজন হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। সাবলম্বী করে তুলেছে অনেকের। বিয়ের কথা ভাববার সময় হয়নি। বয়স পঁয়ত্রিশ চলছে। বয়সের ছাপ পড়েনি। অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিনীয়ের সাথে প্রত্যাখান করেছে। কেউ তো তার অতীত জানেন না। বেশ আছে মনে মনে ভাবে মনিকা। বাবা-মা আর ছোটোভাইকে নিয়ে ভালোই তো চলছে জীবন। ডা. মাসুদের পাশে থেকে মানুষের মন চিনতে পেরেছে। মানুষের মন কত জটিল। বাইরে থেকে বুঝা যায় না। আনন্দভরা জীবন হঠাৎ এক নিমিষে বিলীন হয়ে যায় ভাগ্যের হাতে। কিন্তু মনিকা নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেনি। ভাগ্য আর জীবনকে নিয়ে লড়াই করে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
— রাকা, এই তো আমার জীবন। তোমাকে আপন ভেবে মনের কথা বলে অনেকটা শান্তি পেলাম।
সুন্দর ও মৃদ হাসে যে নারী সেই তো সুস্মিতা। রাকা তাদেরই একজন। সে কেন তাকে নিয়ে ফুলঝুড়িতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো রাকা জানে না। রাকাকে বলা হয়েছে মনিকা তার সহযাত্রী এবং যথা জায়গায় নিয়ে যাবে।
— মনিকাদি, তুমি আজ হতে আমার আত্মার বোন। আজ তোমাকে সব বলব। তুমি বাধা দিও না। তোমার সংগ্রামী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা রইল। তবে আসল উদ্দেশ্য এখনই বলব না।

আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৩য় পর্ব

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি নিয়মিত 'আমাদের সুজানগর' ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে, এক কিশোরীর প্রেম, ভোরের কৃষ্ণকলি; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা; কবিতাগ্রন্থ: জোছনায় রেখে যায় আলো। তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের বোনকোলা গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই উপজেলার হাটখালি ইউনিয়নের নুরুদ্দিনপুর গ্রামে।

error: Content is protected !!