পাথরে-ফুল
গল্প,  রাতুল হাসান জয় (গল্প),  সাহিত্য

পাথরে ফুল

পাথরে ফুল

রাতুন হাসান জয়

 

– বুঝলেন মতিন মিয়া মধ্যবিত্তের স্বপ্ন হলো আপনার ওই থালায় রাখা বায়েম মাছের মতো। হাতের নিচেই আছে অথচ খালি হাতে ধরে রাখতে পারছেন না। ছাই লাগিয়ে ধরে রাখতে পারছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন ছাইয়ের ব্যাপার টা?
– জ্বী পারছি। টাকা।
– টাকার অভাবেই আলোর মুখ দেখছে না স্বপ্ন। কাঁটাতারে হঠাৎ আটকে যাওয়া টুকরো কাপড়ের মতো অবস্থায় আছি। ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে যাবো যাবো করেও থেকে যাচ্ছি।
– আপনার কঠিন কথা বুঝতে কষ্ট হয় সবুজ ভাই। তবে অবস্থা বুঝতে পারি। মাছ দেবো?
– দেন, এক কেজি।

মতিন মিয়ার কাছ থেকে বায়েম মাছ নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। মুসাদ ভাই ভালো রান্না করেন। উনি বলেছেন বায়েম মাছ আনতে। বায়েম এমন ভাবে রান্না করেন উনি দেখে মনে হয় গরুর মাংস রান্না হইছে। মাসে দুইবার উনি বায়েম মাছ রাঁধেন। আমরা তৃপ্তি করে খাই।

বিকেলের বাতাসে খোলা চুলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মিতু। শীতল বাতাসে চুলগুলো উড়ে মুখের উপর আসছে বারবার। মিতুদের বাড়িটা দুইতলা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর বয়স মিতু জানেনা। বাহির থেকে দেখলে মনে হয় পরিত্যক্ত কোন বিল্ডিং। পলেস্তারা খসে পরছে। জমিদার আমলের বাড়িটার ভিতরের অবস্থা পুরোটাই বাহিরের বিপরীত। সুন্দর গোছগাছ করা সবকিছুই। এই বাড়িটার নিচতলার একটা রুমে ভাড়া থাকি আমরা তিনজন। মুসাদ ভাই মিলন আর আমি। এত সুন্দর ছাদ থাকার পরেও আমরা ছাদে যেতে পারি না। এই বাড়ির কোনকিছুতেই আমাদের মানা নেই শুধু ছাদে যাওয়া ছাড়া।

আরও পড়ুন গল্প বিপরীত

উপরতলায় মিতুরা থাকে। চারজনের সংসার তাদের। দুই বোন আর মা বাবা। বাজারের ব্যাগ হাতে গেটে পা রাখতেই মিতু ছাদ থেকে সরে গেলো দৃষ্টির আড়ালে। পাঁচ মাস তাদের বাড়িতে আছি। কয়েকবার ঘটনাক্রমে মুখোমুখি দেখা হয়েছে মিতুর সাথে। কখনোই নিজে থেকে সে কথা বলে না। কেবল কিছু জিজ্ঞেস করলে সহজ উত্তর দিয়ে চলে যায়। মুখ দেখে মনে হয় এক কোটি বছরের রাগ পুষে রেখেছে। রাগের কারণ সে নিজেও জানে কি না সন্দেহ আছে। মিলন এর ধারণা বাড়িওয়ালি বলেই তার এত দম্ভ। ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা বলা যাবে না। মিলন একটা কবিতার সুরে বলে মিতুর কথা উঠলেই।
” রাগ তার কবেকার জন্মালো কিভাবে?”

রাতে খাওয়ার পর মুসাদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন।
– চাকরিটার কিছু হলো সবুজ ভাই?
– না। টাকা চায়।
– কত চায়?
– পাঁচ।
– দিবেন?
– না। এত টাকা থাকলে ব্যবসাই করতাম। পরের গোলামীর জন্য এত টাকা দেবো কেন?

মুসাদ ভাই কথা বাড়ায় না আর। নিজেও চাকরি খুঁজতে খুঁজতে মাথার চুল পাকিয়ে ফেলছে। একলা মানুষ। মা বাবা কেউ বেঁচে নেই। বোন ছিলো একটা বিয়ে দিয়েছে। তারা ভালো আছে। মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসেন উনি। ছোটখাটো একটা কোচিং সেন্টার চালায়। যা আয় হয় বেশ চলে যায়। এমনকি আমাদের থাকা খাওয়ার খরচটাও প্রায় সময় নিজেই চালান। এই বাড়িতে মুসাদ ভাই নিয়ে এসেছেন আমায়। যান্ত্রিক শহরে ওই সময় আমার আশ্রয় এর খুব দরকার ছিলো। দুইটা টিউশনির ব্যবস্থাও করেছেন।

– মুসাদ ভাই আমি আপনাদের মতো পড়ালেখা জানা মানুষ হলে মিতুরে পটাই বিয়ে করে নিতাম। লাইফ স্যাটেল। বুঝলেন। চাকরি বাকরির পিছনে ছুটতাম না।

মিলনের কথা শুনে আমি আর মুসাদ ভাই দু’জনেই হাসি।

– সবুজ ভাই মিতুরে পটাই নেন। পুরো বাড়ির মালিক হবেন। আমাদের ভাড়া দিতে হবে না৷ নাকি তখনও ভাড়া নিবেন?
– চুপ থাক মিলন। ঘুমা।

আরও পড়ুন গল্প  রঙিন ঘুড়ি

দরজার ঠকঠক শব্দে ঘুম ভাঙলো । তখনও সকাল হয় নি। বাহিরে অন্ধকার। দরজা খুলে দিলাম। মিতুর আম্মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে রাজ্যের ভয়।
– কি হইছে আন্টি? কোন সমস্যা?
– একটু উপরে আসো বাবা। তোমার আঙ্কেল কেমন করছে। হাসপাতালে নিতে হবে।
বলেই হাউমাউ করে কাঁন্না শুরু করলেন।

এই প্রথম উপর তলায় আসলাম আমি। সাথে মুসাদ ভাই। মিলন আসেনি। সে ঘুমাচ্ছে। আঙ্কেল খাটে শোয়া। অবস্থা তেমন ভালো মনে হচ্ছে না। পাশে বসে আছে মিতু। চোখে একফোঁটা অশ্রু নেই। একজন মানুষের বাবা অসুস্থ। যাই যাই অবস্থা। আর তার মেয়ে স্বাভাবিক বসে আছে। মুসাদ ভাই এম্বুলেন্স খবর দিয়েছিলো আগেই। আঙ্কেল কে এম্বুলেন্স এ উঠিয়ে আমরাও উঠে বসলাম। মিতু আসে নি। সে ঘরেই থাকবে। হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন আঙ্কেল মারা গেলেন। আঙ্কেল বলছি এর কারণ আমি মানুষটার নাম আগে জানতাম না। ভর্তি করানোর সময় জেনেছি। নাম গোলাম ইশতিয়াক। মিতু গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিলো খাবার নিয়ে। আর ফিরে যায়নি। হাসপাতালেই আছে।

পুরো বাড়িতে আগরবাতির গন্ধ। আরেকটা গন্ধ আছে মৃত্যুর গন্ধ। দাদি যেদিন মারা গেলেন সেদিন আগরবাতির গন্ধ ছাড়াও আরেকটা গন্ধ ছিলো। মৃত্যুর গন্ধ। আমার চোখ দিয়েও সেদিন পানি বের হয়নি সবার সামনে। বিকেলে মাটি হবার পর মেজফুফু যখন কাছে বসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমি কাঁদলাম। চোখের জল বাঁধ মানে নাই। সেই যে জন্মের কাঁদা কেঁদেছি। এখনো মনে পড়লেই বুকের ভিতর হাহাকার ভরে ওঠে। মনে হয় দাদি আছেন। দাদি মারা যাচ্ছেন চোখের সামনে। আমি চামুচে করে পানি খাওয়াচ্ছি। আমার চোখ ভিজে যায়। এ কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না।

মিতুকেও আমার তেমন মানুষ মনে হয়। মিতুর বোন অন্তরার কান্না এখনো থামেনি। মা বেটি কাঁদছে জীবনের কান্না। মিতু দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। যেন পাথর মুর্তি বানিয়ে রেখেছেন কারিগর। কোন নড়াচড়া নেই কিছু নেই। আমি জানি একটা ঠিকঠাক কাঁধ পেলে এই মেয়েটা কাঁদবে। সকল কষ্ট চোখের জল হয়ে বেরিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন গল্প সুরেন বাবু

মিলন বলছিলো ঢাকায় তাদের আত্মীয় স্বজন নেই। যারা এসেছিলো মাটি হবার পর সবাই চলে গেছে। মরা বাড়িতে বেশিক্ষণ কেউ থাকতে চায় না। মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যায়।

মেয়েটার পাশে বসলাম। যে মেয়ে দেখলেই রেগে যায়। সে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলাম কিছু না ভেবেই। আমার স্পর্শে সে কেঁপে উঠলো। মেয়েটা কাঁদতে শুরু করেছে। এই প্রথম তার চোখে অশ্রু দেখছি । ক্রমেই তার কান্নার গতি বাড়ছে। মাথা হেলিয়ে দিয়েছে আমার কাঁধে। সরাচ্ছি না। কাঁদুক। এই মেয়েটার কান্না ভীষণ দরকার। যত কাঁদবে তত হাল্কা হবে মনের ভিতর। মিতুর কান্না দেখে তার মা আর বোন মিতুর কাছে আসে। আমি উঠে মুসাদ ভাইয়ের সাথে নিচে চলে আসি। সিঁড়ি দিয়ে নামছি উপর তলা থেকে ক্রমেই অস্পষ্ট হচ্ছে ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজ। কাঁদুক আজ তারা। সকল কষ্ট ধুয়ে দিক কান্নার জলে।

তিন মাস পর চাকরি হলো আমার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে। টাকাপয়সা লাগেনি। চাকরির সুবাদে আমায় চলে আসতে হয় মিতুদের বাড়ি ছেড়ে। মাঝে মাঝে যেতাম মুসাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। মিতুর আম্মার সাথেও কথা হতো। মিতু সেই আগের মতোই দেখলেই দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। এখন দায়িত্ব বেড়েছে কাজের। সময় করে উঠতে পারি না। ফোনেই কথা হয়।

– একটা সুখবর আছে সবুজ।
– কি মুসাদ ভাই?
– অন্তরার সাথে বিয়ের কথা বলছে আম্মা।
– আপনার আম্মা তো নাই মুসাদ ভাই!
– অন্তরার আম্মা।
– আচ্ছা। ভালো হবে।
– তোকে জানাবো তুই আসবি অবশ্যই।
– আসবো মুসাদ ভাই।

বিয়েতে যাওয়া হয়নি। সময় সুযোগ কিছুই করে উঠতে পারিনি। অন্যের গোলামী করলে কখনোই নিজের সময় সুযোগ বলে কিছু থাকেনা। চাকরি হলো অন্যের গোলামি। মিলন মাঝে মাঝে ফোন করে।
– সবুজ ভাই বড়লোক হয়ে গেছেন তাই খোঁজ রাখেন না।
– তা না। কাজের অনেক বেশি চাপ মিলন।
– চাপ টাপ কিছু না ভাই বুঝি। চাপের বাপ ও বুঝি।

চাপের বাপ যে বোঝে তার সাথে কথা বাড়ানো বোকামি। তারপর ও আমরা কথায় কথা বাড়াই। অফিসে এসেই দেখলাম টেবিলের উপরে একটা খাম। খামের উপরে কিছু লেখা নাই।

আরও পড়ুন গল্প তৃতীয় স্বাক্ষী

কেউ এসে দারোয়ান ছেলেটার হাতে দিয়ে গেছে বোঝাই যায়। হাতে হাতে এসেছে চিঠি। চিরকুট।

সবুজ সাহেব,

কেমন আছেন? আজকাল ভালো থাকা খুব সহজ নয়। মনের ভিতরে বাহিরে নিজের সাথেই লড়াই। লড়াই দখল করেছে আমাদের যাপিত জীবনের সবটুকু। জীবনের সব রস নিংড়ে নিয়ে দুঃখ কষ্টগুলোর গায়ে মেকি রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। যেনো লুকাবার কিছুই নেই, নেই একান্ত নিজস্ব অনুভবেের কোনো চিলোকোঠা।

কবে কখন আপনাকে এত কাছ থেকে অনুভব করা শুরু করলাম জানিনা। যোগাযোগহীন মুহূর্তগুলো এক আলোকিত ক্ষমতায় আরো কাছে আসতে শিখিয়েছে। সমর্পিত মনের শরীরে আমি ভালোবাসার চাষাবাদ করছি। নতুন উদ্দীপনায় আপনি জেগে উঠছেন আমার মনের আঙিনায়।

সেদিন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই মনে হলো আপনি নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ নাই। ছাদে গেলে এখন আর আপনাকে দেখা যায় না। অথচ আমার ভাবনায় আপনি বাজারের ব্যাগ হাতে গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। দরজায় হেলান দিয়ে বসলে মনে হয় আপনি পাশে খুব পাশে। পলক ফেলা দূরুত্ব অথচ ছুঁতে গেলে নাই। সবুজ সাহেব চোখ বন্ধ করলেই কি কারো শরীরের গন্ধ পাওয়া যায়? না কি শুধু আমিই পাই!
এখন আলাদা কোন গন্ধ বুঝি না। মনে হয় সব গন্ধই আপনার শরীরের মিষ্টি গন্ধ। সবুজ সাহেব আমাকে কাঁদালেন। কাঁদতে দিলেন। যেতে যেতে কেন শরীরের গন্ধ ছেড়ে গেলেন?

শেষবার যখন কথা হলো। মনে হলো আপনি দৌড়াচ্ছেন! কোথাও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজের কাছেই হেরে গিয়ে জিততে চান আপনি। তাই আপনি পালিয়ে বেড়ান?
অন্তরা আপার বিয়েতে আসলেন না। অথচ কত অপেক্ষায় ছিলাম আমি। এত অপেক্ষায় আপনার জন্য কেউ কোনদিন থাকে নি।

দুপুর রাত নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এমন কালো আঁধারেই আমি লিখছি।
সবুজ সাহেব আমি সারাজীবন কাঁদতে চাই। আমাকে কাঁদতে দিবেন? কাঁদাবেন? কাঁদতে আমার আপনাকেই লাগবে। আপনার স্পর্শ লাগবে। কাঁধ লাগবে। দিবেন?

মিতু

যে মেয়েটার চোখেমুখে কোটি বছরের রাগ পোষা থাকতো। সেই রাগী মেয়েটা ভালোবাসছে। তার এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

পাথরে ফুল

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!