নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ১ম পর্ব।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ১ম পর্ব
- এ কে আজাদ দুলাল
প্রবল আপত্তির মুখে শেষ পর্যন্ত বাবার কথা রাখতে হলো রাকার। এককালের জাঁদরেল সিএসপি কর্মকর্তা রাকিব আহমেদ রাকার বাবা। চলনে, কথাবারতায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে রের্কড নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারী তিনি। কিছু দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষকতা জীবনে বৈচিত্র্য আনতে পারেননি এই তুখোড় মেধারী রাকিব আহমেদ। স্বপ্নের জাল বঙ্গোপসাগরের ধুঁ ধুঁ দৃষ্টির বাইরে। সিনিয়র বড়ো ভাইদের সরকারি চাকরিতে প্রশাসনিক ক্ষমতার কথা শুনে নিজের ভেতরে নতুন স্বপ্ন জেগে ওঠে। তার চাই উপরে ওঠা আর ক্ষমতা। বলতে গেলে এই বয়সে তাকে ক্ষমতার মোহ পেয়ে বসেছিল।
সারা পাকিস্তানে সুপিরিয়র সার্ভিস প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় তার স্থান হয়ে যায় দশের মধ্যে। প্রশাসন ক্যাডার। তিনি সিএসপি ক্যাডারের একজন সম্মানিত কর্মকর্তা। তারই একমাত্র কন্যা রাকা আহমেদ। বাবার মতো মেধাবী, তবে মায়ের মতো সুন্দরী নন। চেহারা সাদৃশ্য কার মতো, কেউ বলতে পারেন না। তবে রাকিব আহমেদের আরও দুটো পুত্র সন্তান আছে; তারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। বুদ্ধি হওয়ার পর হতে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেনি। আবার বিয়ে করেছে মায়ের সহজাতি পাকিস্তানি মেয়েদের। এটা তাদের মায়ের কৃপায় ও আদর্শে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার একমাত্র মেয়ে এবং পাকিস্তানি পরমা সুন্দরীকে নিয়ে ঢাকায় অভিজাত্য এলাকায় বসবাস করছেন।
রাকা একদিন হাসতে হাসতে তার বাবার কাছে জানতে চায়,
— বাবা, শুনেছি ছেলেদের চেহারা মায়ের আদলে, আর মেয়েদের চেহারা বাবার আদলে হয়ে থাকে। আমার টু-ব্রাদার্স তাদের মায়ের আদলে। শুধু তাই নয়, স্বভাব-চরিত্রে শতকরা নব্বই। কিন্তু বাবা আমি তো তোমাদের কারো চেহারার আদলে নই। তাহলে কি তোমাদের পূর্বপুরুষের কোনো মহিলার মতো আমার চেহারা? ধরো, তোমার মা, ফুফু, খালা মানে যাদের সাথে তোমাদের রক্তের সম্পর্ক বিরাজমান?
আরও পড়ুন শেষ অপেক্ষা
মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকতেন মেয়ের মুখের দিকে। পানিতে চোখ না ভরলেও হৃদয়ে বেদনার বরষায় প্লাবিত হতো ক্ষণিকের জন্য। সত্য কথা কেন বলতে পারছে না। মেয়ে যদি আসল পরিচয় জেনে যায়, কী জবাব দিবে। রাকা তার বাবার বংশের পরিচয় জানে না। জন্মের পর উর্দুভাষী মা-ভাইদের সাথে বড়ো হয়েছে। বাবার সহযোগিতা এবং নিজের প্রবল ইচ্ছের শক্তিতে মনের মাধুরী মিশিয়ে তপ্ত করেছে বাংলাভাষা; বিদেশের মাটিতে। অবসরের এক বছরের মাথায় দেশে ফিরে আসেন জাঁদরেল সিএসপি কর্মকর্তা রাকিব আহমেদ। আসতে চাননি, বাধ্য করা হয়েছিল। জীবনে রাষ্ট্রের আর কত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। রাকাকে নিয়ে তার বাবার দুশ্চিন্তা। তার পড়াশোনা শেষ হয়নি। বাংলাদেশে গিয়ে কোথায় পড়বে। বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলাম একদম আলাদা। রাকা বাংলা ভাষায় যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছে। বন্ধুদের কাছে খোঁজ-খবর নিয়েছে বাংলাদেশে ঢাকায় বেশ ক’টা মাধ্যামিক স্কুলে ইংলিশ ভার্সনে পড়াশোনা করানো হচ্ছে। ভর্তির ব্যবস্থা করা যাবে বলে অনেকে আশ্বাস দিয়েছে।
বিদেশের মাটিতে মেয়েকে একা রেখে যেতে রাজি নন। তার স্ত্রী এবং দুই পুত্র বাধা দিয়েছিল। শেষ পর্ষন্ত রাকার সিদ্ধান্তে ঢাকায় ফেরে রাকা তার বাবা-মায়ের সাথে। দুই পুত্র সন্তান বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে সংসারী হয়ে আলাদা জীবনযাপন করছে বিদেশের মাটিতে। বিদেশে যা হয়ে থাকে। ফিরে এসে রাকার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান, তারপর ওএসডি। অবশেষে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর খাতায় নাম লেখান। পাকিস্তানি শ্বশুরের ধানমন্ডি রেখে যাওয়া বিরাট বাড়ি তার সহকর্মীদের সহায়তায় শত্রুমুক্ত করে। কিন্তু বেশি দিন রাখতে পারেননি; তার আর এক প্রভাবশালী সহকর্মীর জন্য। বাড়ির বিনিময়ে যে অর্থ পেয়েছিলেন বারিধারায় বিশ হাজার বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাটে স্ত্রী-মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন। উর্দুভাষী স্ত্রী আবার সমাজসেবা করে বেড়ান। আভিজাত্য শ্রেণির সাথে তার সখ্যতা। সপ্তাহে একদিন নিজের বাসায় পার্টি হয়। আসেন উচ্চবর্গের মহিলাগণ। গভীর রাত পর্যন্ত চলে পার্টি।
স্বামী-মেয়ের সাথে খাবার টেবিলে কমই দেখা মেলে। বাঙালি খাবার তার আবার অপছন্দ।
আরও পড়ুন পতুল
রাকা ভর্তি হয়েছিল সাধারণ কারিকুলামে ইংরেজি ভার্সনে একটা মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। অসুবিধা তো হয়েছিল কিন্তু টিউটরের মাধ্যমে আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভালো ফলাফল করেছিল। মা উৎসহ না দিলেও বাবা সর্বক্ষণ সাহস জুগিয়েছেন এবং আগলে রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। বাবা বলতেন অর্থনীতি নিয়ে পড়তে। রাকার অপছন্দ। সাহিত্য নিয়ে পড়বে। পড়েছিল ইংরেজি সাহিত্য। বাবার মতো অত ব্রিলিয়েন্ট রেজাল্ট করতে পারেনি। তবে প্রথম শ্রেণি পেয়েছিল। রাকার মা প্রায় বিদ্রুপ করে বলত তোদের বাপ-মেয়ের ধ্যান-ধারণা সেকালে যাকে বলা হয় ওল্ড।
— রাকা, তুমি আধুনিক যুগের মেয়ে। জন্ম বিদেশে। চৌদ্দ-পনেরো বয়স পর্যন্ত বিদেশ কাটিয়েছ। তোমার একটুও বিদেশি হাওয়া গায়ে লাগানেনি। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সে পথে হাঁটলে না। আচ্ছা, তোমার সমস্যা কোথায়? বিয়ে বয়স হয়ে গেছে। আমার এক বান্ধবী একটা ছেলের খোঁজ দিয়েছে। ধনী পরিবারের ছেলে। বাবার বড়ো ব্যবসা আছে।
কিন্তু রাকা অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। জেদকে ভেতরে পুষে রাখার ক্ষমতা আছে। রাকা তার মায়ের কোনো কথাই পাত্তা না দেওয়াতে মায়ের সাথে সম্পর্ক দূরত্ব হতে থাকে। সব আব্দার বাবার কাছে। কিন্তু একটা ঘটনা কেন যেন বাবাকে বলতে সংকোচবোধ করছে। মনের ভেতরে অশান্তি। কাকে বলবে। আপন কেউ নেই। বাবাকে বলা যায় কিন্তু বাবা বলবেন,
— মা, চলো মনোবিজ্ঞানী ডা. মাসুদের কাছে। ও হয়তো একটা ভালো পরামর্শ দিতে পারবে। ও তো আমাদের পরিবারের একজন। ওদের বাসায় তো কত বার গিয়েছ। ওর মা তোকে কত আদর করেন। ওর বাবা ডা. নাজিম আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ছিলেন। কিন্তু অকালে একজন মেধাবী চিকিৎসককে জাতি হারিয়েছে। জাতি তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অবদানের কথা কখনো ভুলবে না।
আরও পড়ুন শরতের মেঘ
বাবার এসব কাহিনি শুনে রাকার মন নরম হবে। বাবার এটাও জানা আছে তার রক্ত রাকার শরীর প্রবাহিত হচ্ছে। তবু্ও বিষয়টি বাবাকে জানানো প্রয়োজন। হয়তো এর একটা সমাধান দিতে পারবেন। কিন্তু ওই যে মনোবিজ্ঞানী ডা. মাসুদ ভাই শুনে কী বলবেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকবার চিন্তা-ভাবনা করে রেখেছে; সময়মতো বাবাকে বলবে।
সকাল সাড়ে ছয়টার ট্রেন কমলাপুর রেল স্টেশন হতে ছেড়ে বিমানবন্দর রেল স্টেশনে পৌঁছা আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। মনিকা চাকমা নিজের ব্যবস্থাপনায় স্টেশনে যাবেন; এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। দারুণ স্মার্ট মহিলা। ডা. মাসুদ ভাইয়ের চেম্বারে দশ মিনিটে পরিচয় হয়েছিল। তাতেই রাকা বুঝে নিয়েছিল নির্ভয়ে নির্ভর করা যায়।
তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে গিয়ে বসে রাকা। সাথে মাঝারি ধরনের একটা ট্রাভেলিং ব্যাগ। হাতে ছোটো আকারে হ্যান্ড ব্যাগ। আরাম-আয়াসে জীবনযাপন করা বিত্তবান শ্রেণির উচ্চশিক্ষিত একজন যুবতী নিজে দেশান্তরি হচ্ছে এটা ভাবতেই অবাক লাগছে। কোথায় যাচ্ছে, কত দিন থাকবে, টাকা-পয়সার প্রয়োজন আছে কি-না, কোনো কিছুই জানেন না এককালের জাঁদরেল প্রাক্তন সিএসপি আমলা। ক্ষমতা আর আধিপত্য সবসময় থাকে না। যাবার সময় বাবাকে কানে কানে বলেছিল,
— মাতৃভূমি মন ভরে দেখব।
জন্মের পর হতে রাকাকে ‘সোনা মা’ বলে ডেকেছেন তার বাবা। যৌবনে পা দেওয়া মাত্রই মা বলে ডাকেন রাকার বাবা। কেন মা বলে ডাকতেন তা একমাত্র রাকার বাবাই জানেন। এ নিয়ে রাকার মা ব্যাঙ্গ করে বলত,
— বাঙাল তো। আনকালচার্ড।
আরও পড়ুন উপেক্ষিত
বাবা তার পাকিস্তানি অভিজাত্য ঘরের উচ্চশিক্ষিত পরিবারের স্ত্রীর কথায় কখনো জবাব দেননি। অবসর যাওয়ার পর হতে অনেকটাই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে আসছেন। মাঝেমধ্যে ঢাকা ক্লাবে যেতেন। বাবা অনেক বার বলেছেন, যদি পছন্দের কোনো ছেলে থাকে তাহলে তার কোনো আপত্তি থাকবে না।
রাকা হাসতে হাসতে বলেছে,
— বাবা, তোমাদের মতো উচ্চশিক্ষিত, বুনিয়াদি ঘরের ছেলে কোথায় পাব? তোমাদের দুই রাজপুত্রকে পাকিস্তানি বুনিয়াদি সম্ভ্রান্ত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করেছে। মায়ের তো সেই অহংকারে মাটিতে পা পরে না। আর কথায় কথায় ভীতু বাঙালি বলে উপহাস করে থাকে। জানি, এটা তাদের অপমান ও রাগের বহিঃপ্রকাশ। তবুও কেন যে বাংলাদেশে ফিরে এলো? বাবা, চিন্তা করো না। পথ চলতে চলতে যদি মনের মতো কাউকে পেয়ে যাই তাহলে তোমাকে জানাব। তুমি যে আমার প্রাণ।
বাবা হেসে বলতেন,
— ঠিক আছে তাই হবে।
আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ১ম পর্ব