-
আট ফাল্গুন
আট ফাল্গুন তাহমিনা খাতুন ভিনদেশি প্রভু চেপে ধরেছিল বাংলার কণ্ঠনালি বাংলা ভুলে শিখতে হবে তাদের শেখানো বুলি! ‘মা’ বলে ডাকা চলবে না, আর দিল এই ফরমান উর্দু ভাষা শেখার তরে, হও বাঙালি আগুয়ান। ‘মানি না মানব না’ যতক্ষণ আছে প্রাণ। গর্জে উঠল বাংলার মানুষ ‘রুখবই রুখব’ মায়ের এ অপমান। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ উঠল ধ্বনি সাগরের কূলে কূলে সে ধ্বনি ক্রমে ছড়িয়ে গেল সকল মর্মমূলে। গৃহকোণ ছাড়ি পথে নেমে এল বাংলার লাখো তরুণ তাদের দমাতে ঝলসে উঠল শাসকের সিসার আগুন। জীবন দিল রফিক-বরকত-জব্বার-শফিউর বাংলাভাষার সন্মান যেন তখনো খানিক দূর। জীবন দিল অহিউল্লা, আট বছরের শিশু মায়ের কোল খালি করে, সে…
-
একুশ মানে, দুয়ারে একুশ
একুশ মানে জাহাঙ্গীর পানু একুশ মানে – ফাগুন মাসের ঠান্ডা হাওয়ায় তপ্ত মনের উচ্ছাস। বাংলা মায়ের দামাল ছেলের বীরত্বগাঁথা উপন্যাস। একুশ মানে – কৃষকের মুখের হাসি স্বপ্নবোনা সোনার মাঠ। নদীতটের বটতলার বিকিকিনির গঞ্জ হাট। একুশ মানে – কিশোরীর মলিন ঠোঁটে মুক্ত আলোর বিচ্ছুরণ। সন্ধেবেলা পড়তে বসা খোকার কণ্ঠের উচ্চারণ। একুশ মানে – পাতা ঝরা শেষ বিকেলের মুক্ত ধরার প্রাণ। মধুর সুরে গেয়ে যাওয়া কোকিল পাখির গান। একুশ মানে – শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়ার লাল বর্ণে ধারণ। রাজপথে দামাল ছেলের রক্তমাখা বসন। একুশ মানে – নদীর বুকে মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুর। উর্দুই শুধু রাষ্ট্র ভাষার দম্ভ ভেঙে চুর। একুশ মানে – আঞ্চলিকতার…
-
ভয় নাই
ভয় নাই মো. রমজান আলী খান ভয় নাই ওরে ভয় নাই একুশে জাগ্রত বীর, ক্ষয় নাই ওরে ক্ষয় নাই বইমেলার রেখ মনস্থির। একতাবদ্ধ হও সকলে সাজো দামালের সাজ, যতই আসুক সংগঠনের বাঁধা চালিয়ে যাও কাজ। একুশে বইমেলা সম্পর্কে যদি কেউ দ্বিমত পোষণ করে, বোঝাতে হবে সকলে মিলে গিয়ে তাদের ঘরে ঘরে। বোঝাতে হবে সকলকে কেন হয় একুশে বইমেলা, যেদিন বুঝবে করবে না কখনও বইমেলার অবহেলা। বোঝাতে হবে একুশ মানে নাজিমুদ্দিনের হুংকার, উর্দু-ভাষা বলবৎ রাখবে এই তার অহংকার। বোঝাতে হবে একুশ মানে দুশমনের কালো হাতছানি, ভাষা শহিদদের বাবা মায়ের বুক ভেজা চোখের পানি। একুশ মানে রফিক, শফিক, সালাম বরকতের আত্মা, বাংলা…
-
হারানো ফাল্গুন
হারানো ফাল্গুন তাহমিনা খাতুন ফাল্গুন এসেছে আবার ফিরে শূন্য রিক্ত হাতে খুঁজে ফিরি ফাল্গুনী মায়া রুক্ষ অকরুণ খাঁ খাঁ প্রান্তরে। ফাল্গুন খুঁজে ফিরি জারুলের বনে, খুঁজে তো পাই না তা হারায়েছে জারুলের বন। সাথে নিয়ে গেছে স্নিগ্ধ মনোরম বেগুনির মায়া ফাগুনের আগুন খুঁজি কৃষ্ণচূড়ার বনে। কৃষ্ণচূড়ার বোন উধাও! সাথে হারায়েছে ফাগুনের আগুন রাধাচূড়া ফিরে গেছে, নয়ন জুড়ানো হলুদের আলপনা মুছে গেছে তাই। বৃক্ষহীন শাল বনে নাই পাতা ঝরার গান ফাল্গুনে শুনি না তাই কোকিলের ‘কুহুতান। বাঁশ বন উধাও, ঘাস ফড়িং পুচ্ছ নাচায় না আর বাঁশের কঞ্চির ডগায় ফাগুনের দিনে। ‘বউ কথা কও’ বুঝি ভুলেছে আহ্বান নিষ্ফল বেদনায় দোয়েল ফিঙে ভুলেছে…
-
কলকাকলি, ছলনার ফসল
কলকাকলি কে এম আশরাফুল ইসলাম দেখেনি ভুবন ভাষার রণাঙ্গন কালে কস্মিনে কোথাও, বাংলার কানন খুনে রাঙ্গা ভাষা শহিদানের দিকে চাও! শকুনি মামারা হায়েনার বেয়ারা কাড়িতে মায়ের ভাষা, ক্ষিপ্ত মাতোয়ারা মূর্খতার মুকুটে এলো করিতে সর্বনাশা! বীরের জাতি না মেনে বজ্জাতি ভাষার দাবিতে অটল, বীরত্বে মাতি জরুরী আইন ভাঙ্গিয়া অবাধ কোলাহল! বুলেটে ঝাঁঝরা নির্বোধ পাকেরা করিলো অকুতোভয় বীর, দেখিলো ধরা ভাষার তরে বিশ্বে কাহাদের দুর্বিনীত শির! মায়ের ভাষা পরম খাসা জন্মসূত্রে ভূমে ভূমে চিরকাল, পুরায় আশা কোল থেকে দোলনায় আজীবন উদয়াচল! সেই অধিকার অপহরণে আরবার নির্বোধ অপরিণামদর্শী, ছাড়িয়া হুঙ্কার গর্জিলে রাজপথে প্রাণ দিলো ভালোবাসি! সন্তান জননীর বীর বীরাঙ্গনা ধরণীর যাহাদের তরে দেশ,…
-
একুশ তুমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, চেতনা
একুশ তুমি খোন্দকার আমিনুজ্জামান একুশ তুমি আমার রক্তে রুয়ে দিয়েছ ভাষার অহংকার মননে তাই মাতৃভাষার অতুল ঝংকার। একুশ তুমি প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের নাম শহিদ সূর্য সৈনিক বরকত-রফিক-জব্বার-সালাম। একুশ তুমি বাংলা বর্ণমালার প্রতি প্রবল প্রীতির ঝোঁক মা মাটি মানুষের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। একুশ তুমি মাতৃভাষা রক্ষার বিরল বিস্ফোরণ আন্তর্জাতিকভাবে তাই করে সবাই স্মরণ। একুশ তুমি অন্যায় প্রতিরোধের অঙ্গীকার সত্য-সন্দর শক্তির সুদীপ্ত অহংকার। একুশ তুমি বাংলা মায়ের বুক আমার মায়ের মমতাময়ী মুখ। একুশ তুমি হয়ে গেছ আজ পৃথিবীর বুক তোমার চেতনায় ধরণীতে আসুক সুখ। আরও পড়ুন খোন্দকার আমিনুজ্জামানের কবিতা- মানবিকতা অপেক্ষা সাদা মন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ বাংলা ভাষা হয়ে গেছে…
-
খোকা, বর্ণমালা ও স্বাধীনতা
কখোকা রাফিয়া লাইজু কিলিজ আবীর রাঙা পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়া ডালে কত কথা কয় প্রকৃতি, নীরবে নিভৃতে, স্মৃতির মিনারে থোকা থোকা ফুলে কত বেদনার মালা গাঁথা, প্রাতে! আসি বলে, গরম ভাতের থালাটা রেখে, সেই যে গেলো ভাই আসলো না আর ফিরে, ফিরতি পথে, চুড়ি-মালা, আরো কত কী নিবে সবকিছু আজ স্মৃতির মণিকোঠায়, সয়ে যাওয়া ফিকে! অশ্রু শুকায় মায়ের চোখেতে পথ চেয়ে চেয়ে থেকে, এই বুঝি খোকা ডাকল আমায় মা…মা…বলে দূর থেকে! খোকা ফিরে আর আসে না, মা আশা ছাড়ে না যেন তীর বৃদ্ধ পাখি ডাকে, কুঞ্জ মাঝে ঝরে পড়ে পাতা শূন্য তা ছেয়ে যায় শাখে! আবার রঙিন ফুলে-ফলে সাজে দোয়েল-কোয়েল-শ্যামা ডাকে দূরে, প্রকৃতির…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (শেষ পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (শেষ পর্ব) তাহমিনা খাতুন চৌব্বিশ. দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেছে। হাবিবুর, মোমিনা দুজনেরই বয়স বেড়েছে। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে সবাই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবুও হাবিবুর রহমান এখনো পুরোপুরি অবসরে যাননি। গ্রামের মসজিদে ইমামতি, সংসারের টুকটাক কাজ কর্ম, বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া জমিতে শাক-সবজি লাগানো ইত্যাদি করে সময় কাটান। আষাঢ় মাস। আকাশ কালো করে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। নূরপুরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। হাবিবুর রহমান একটা ছাতা নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই মাগরিবের নামাজের ইমামতি করার জন্য মসজিদে চলে গেছেন। মাগরিবের নামাজের ইমামতি শেষ করে হাবিবুর রহমান সাধারণত এশার নামাজের সময় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন এবং একেবারে এশার…
-
দূর জংলার গান
দূর জংলার গান : ভাব ও রূপকল্পের অন্বেষণ আতাউল হক মাসুম হৃদয়ের গভীর অনুভূতি মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হয়ে শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার ও উপমার মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যম হলো কবিতা। একটি সুদৃশ্য অট্টালিকা নির্মাণের পর দর্শক তার মহিমাকীর্তন বা সমালোচনাই করতে পারেন শুধু; তা নির্মাণে শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা কয়জনই বা স্মরণ করেন। একটি সার্থক কবিতা রচনার পেছনেও একজন কবির নিরলস শ্রমের কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবে সব কবিই পরিশ্রমী নয়, কেউ কেউ পরিশ্রমী। বাংলা সাহিত্যে শূন্য দশকে আবির্ভূত কবি আদ্যনাথ ঘোষও তেমনি পরিশ্রমী কবিদের একজন, যিনি নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে একের পর এক লিখে চলেছেন রূপকাশ্রয়ী নান্দনিক সব কবিতা। প্রায়োগিক দিক থেকে…
-
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব)
সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব) তাহমিনা খাতুন বাইশ. নূরপুরের মধ্যপাড়ার জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়ির বড়ো উঠানের এক কোণে অনেকগুলো বাঁশের চাটাই আর খেজুর পাতার পাটি বিছানো। সন্ধার কিছুক্ষণ পরে পূবপাড়া আর দক্ষিণপাড়ার বেশ বিশ-পঁচিশজন বিভিন্ন বয়সের মানুষ উঠানে বিছানো চাটাইয়ের উপর এসে বসল। কিছুক্ষণ পরে জান্নাতুল ফেরদৌসের এক মাত্র ছেলে ফেরদৌস তার বিছানার পাশের জানালা খুলে সবাইকে সালাম দিল। ফেরদৌসের বয়স এখন চব্বিশ বছর। চাটাইয়ে অপেক্ষমান লোকজনের মধ্য থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের আক্কেল আলি উঠে এল ফেরদৌসের জানালার পাশে। ফেরদৌস আক্কেল আলিকে সালাম দিয়ে বলল, “আক্কেল ভাই, আপনারা সবাই যে উদ্দেশ্যে আমার বাড়িতে এসেছেন, তা আমি জানি। নূরপুরের সমাজ প্রধান…