নিঃশব্দে-নীড়ে-ফেরা-।।-৫ম-পর্ব
উপন্যাস

নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৫ম পর্ব ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল

নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৫ম পর্ব

  • এ কে আজাদ দুলাল

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জমে উঠেছে রাজনৈতিক আন্দোলন। শেখ মুজিব সারা বাংলাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন। জেল হতে ছাড়া পাচ্ছেন আবার জেলে ঢুকছেন। বাংলার ছাত্রসমাজ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে আমলা তৈরি হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণে রাকিব আহমেদ পাড়ি জমায় রাওয়ালপিন্ডিতে। যেখানে চৌকস আমলা তৈরি হয়ে থাকে। মন এবং মানসিকতায় জন্ম দেয় এক উচ্চতর জীবনযাপনের। আর হয়ে উঠে প্রশাসক। যাওয়ার আগে বাবা-মা এবং ভাই-বোনের সাথে দেখা করে যায় রাকিব আহমেদ সিএসপি। প্রায় এক বছর পর প্রশিক্ষণ শেষ করে ঢাকায় পোস্টিং হয় রাকিব আহমেদের। বাপের তৈরি জীর্ণকুঠিরে মাত্র দুটো রাত কাটিয়েছিল সে। এ দুটো রাতে পুলিশ চোখে চোখে রাখত। পাকিস্তানের সম্পদ। সময়টা ছিল শীতকাল। মা কত যত্ন সহকারে ছেলের ছোটোবেলার পছন্দের খাবার তৈরি করে সামনে দিয়েছে। ছেলের ইচ্ছে মতো খেয়েছে। তারা জানে ছেলে তাদের অনেক বড়ো মাপের একজন এই সমাজের। বিদায় মুহূর্তে সবার চোখে অশ্রু। কেউ কি জানত এটাই তার শেষ পদচিহ্ন।

সবেমাত্র শেখ মুজিব আগরতলা মামলা হতে মুক্তি পেয়েছেন। ছাত্রসমাজ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছে। হঠাৎ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে আর এক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা দিয়ে অন্তরালে চলে যান। সারা দেশে চলছে স্বাধীকার আন্দোলন। এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে মনোরম পরিবেশে প্রশাসনিক উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে আমলা হয়ে চাকরি যোগদান করল একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষকের সুদর্শন যুবক রাকিব আহমেদ। ঢাকা জেলা প্রশাসন অফিসে তার কর্মস্থল। কাজে যোগদানের পরপরই পরিচিত হন আর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা মুহাম্মদ সরফরাজ খানের সাথে। তিনি সিএসপি। চোখে পড়ে করাচি বাসিন্দা মুহাম্মদ সরফরাজ খানের। প্রথমে বুঝতে পারেনি এটা বাঙাল কি-না। সুদর্শন যুবক একজন অফিসারকে পেয়ে ধন্য মনে করে মি. খান। আগ বাড়িয়ে আলাপ করে নিজের পরিচয় জাহির করে। সেও তার মতো সিএসপি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরের বাসিন্দা।

আরও পড়ুন একশত ছিদ্রযুক্ত জামা

মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে এই রত্নকে হাতছাড়া করা যাবে না। নিজের বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে না থাকলেও ঢাকায় ধানমন্ডিতে তার কাজিনের বিয়ের উপযুক্ত সুন্দরী মেয়ে রয়েছে। বিএ পাশ করেছে। বড়ো লোকের মেয়ে তাই আর বেশি দূর পড়াশোনা করেনি। সামরিক–বেসামরিক পর্যায়ে রয়েছে অনেক বড়ো বড়ো কর্মকর্তা। রাকিবের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। অফিসে উচ্চ পদে কোনো বাঙালি নেই বললেই চলে। যারা আছে তারা কেরানি পর্যায়ের কর্মচারী। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সাথে ভাব করতে থাকেন এ সি রাকিব আহমেদ। আর অন্য দিকে অঙ্ক কষতে থাকে বুদ্ধিমান সিএসপি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সরফরাজ খান। চাকরির শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে তার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল। এখানে তিন বছর চাকরি করার পর রাওয়ালপিন্ডিতে পোস্টিং হয়। সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরুতেই তাকে আবার ঢাকায় ফিরে আনে কর্তৃপক্ষ। হয়তো কোনো কাজে লাগানোর জন্য। সে যাক, এখন একটাই কর্ম রাকিব আহমেদকে কীভাবে বশে আনা যায়।

অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা মি. খান গোপনে খবর নিলেন রাকিব কোথার আদমি। সব খবর নিয়ে দাবার গুটি চাল দিতে থাকেন। বেশি সময় লাগল না। রাকিবের নাড়ি-নক্ষত্র বের করে নিলেন। এখন শুধু আড়াই প্যাঁচের ঘোড়ার চাল।

এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। সময় নষ্ট করা যাবে না। বাসায় স্ত্রীর সাথে শলাপরামর্শ করে একটা পার্টির আয়োজন করে নিজের বাসায়। ধানমন্ডি বসবাসরত আত্মীয়কে সপরিবারে দাওয়াত দেয়। আর বিশেষ অথিতি হিসেবে দাওয়াত পায় সুদর্শন সিএসপি রাকিব আহমেদ।

আরও পড়ুন প্রথম প্রভাত

নির্দিষ্ট তারিখে রাতের ঝলমল আলোয় জমে উঠেছে মিলন মেলা। মি. খান খুশিতে অনেকটাই আত্মহারা। মিসেস খান সুকৌশলে পরিচয় করিয়ে দেয় মেয়ের পরিবারের সাথে রাকিব আহমেদকে। জমে উঠে আলাপ-আলোচনায়। মি. খানের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রশিক্ষণের সময় ভালো উর্দু শিখেছে। ইংরেজিতে তো ঝানু। কিন্তু এই পরিবেশে নিজেকে ছোটো মনে হচ্ছে। তার পরিবারের সাথে এদের পরিবার আকাশপাতাল পার্থক্য। তাছাড়া তার মাথার মধ্যে ঢুকেছে, সে ছাড়া তাদের অফিসের অন্য কোনো কলিগকে না দেখে। এখানে সবাই অপরিচিত, আবার কেউ বাংলায় কথা বলছে না; উর্দু বা ইংরেজিতে। চেহারা কারো বাঙালি বলে মনে হচ্ছে না। ইতোমধ্যে মিসেস খান অপরিচিত এবং অবিবাহিত একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াতে মনের ভেতরে সন্দেহের দানা বেঁধে উঠে। বুদ্ধিমান ছেলে। মি. এবং মিসেস খানের মতলবটা বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু এটা কী সম্ভব! তার পিতৃপরিচয় সে ভালো করেই জানে। বিষয়টি মনে মনে হজম করে নেয়।

তার বাঙালি সহকর্মী প্রশিক্ষণের পর যাদের পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং হয়েছে সে ব্যতিত অন্যরা ঢাকার বাইরে। একমাত্র কলেজে পড়ুয়া বন্ধু ডা. নাজিম সস্ত্রীক ঢাকায় থাকে। খাবার টেবিলে মি. খান বর্তমান দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। তাদের সবার একমত বাঙালিরা দেশ শাসন করতে পারবে না। নির্বাচনে শেখ মুজিব হেরে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু রাকিব আহমেদ ভাবছে অন্য বিষয়। মি. খান সুকৌশলে রাকিবকে উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, বর্তমান চাকরির ক্ষেত্রে পদোন্নিতর জন্য উপর লেবেলে লোক বা আত্মীয়স্বজন প্রয়োজন। তা না হলে একটা প্রমোশনই শেষ। এই একটা কথাই বুলেটের মতো কানে ঢোকে রাকিব আহমেদের। আসলেই তো, তার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যে তাকে উপরে উঠার জন্য সাহায্য সহযোগিতা করবে। এখানে এসে বুঝতে পেরেছে এরা অনেক উঁচুমানের লোকজন। নিজের বাংলোতে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে যায়।

আরও পড়ুন শিকড়ের সন্ধানে

মনের আনন্দে মি. খান গুন গুন করে বাংলা গান গায়ছেন।
“আমি চিনি গো চিনি ওগো বিদেশিনী”।
তার স্ত্রী জানতে চায়,
— তুমি এই বাঙাল গানটা প্রায় গেয়ে থাকো কেন?
উত্তরে হেসে বলেন,
— চাকরির প্রথম জীবনে তো এই বাঙলায়। আজ কেন যেন গানটা নতুন করে গাইতে ইচ্ছে করছে।
— এই শোন, শাহনাজের সাথে কিন্তু তোমার নতুন নায়কের বেশ মানাবে।
— ঠিক বলছ। প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। তুমি একটা কাজ করো, শাহনাজের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলো। ছেলের বিষয়টি আমি দেখব।
— ঠিক আছে।
মি. খান মনে মনে হাসে। সুকৌশলে টোঁপ তো দিয়েই রেখেছে বাঙালকে। এখন শুধু টোপ গেলার অপেক্ষায় জনাব রাকিব আহমেদ।

অফিসে এক বাঙাল আছে মি. খানকে পছন্দ করে। আদমি বাঙাল হলে কি হবে জন্ম করাচিতে। বাবা চাকরি করত করাচিতে। অবসর নিয়ে নিজ জেলা শহরে চলে আসে। আসার সময় নিজের ছেলেকে যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরি বাগিয়ে তারপর বাঙালমুলুকে হিজরত করে সাথে ছেলেকে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বদলি করে নিয়ে আসে। তাকেই কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন মি. সরফজান খান।

আরও পড়ুন ঊর্মিমালা

এদিকে নির্বাচন ঘোষণা দিয়েছে সামরিক সরকার। অফিসে কাজের পরিধি বেড়ে গেছে। নতুন অফিসারদের কাজে লাগানো হচ্ছে। মি. সরফরাজ খান জানেন তার কী কাজ। এখানে অনেকগুলো বছর আছে। ঢাকার উচ্চতর বুনিয়াদি এবং সুশীল মহলের সাথে রয়েছে সুসস্পর্ক। তাছাড়া অনেকগুলো বছর ঢাকায়। পশ্চিম পাকিস্তানি হলেও উগ্র মেজাজী অফিসার নন মি. খান। যে কোনো মুহূর্তে বদলি হওয়ার সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু তার আগে মিশন সফল করতে হবে। সেই বাঙালি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বিষয়টি বলাতে সে আশ্বাস দিয়ে বলল ,
— স্যার, চিন্তা করবেন না। রাকিব স্যারের সাথে পরিচয় হয়েছে। তার কিছু ব্যক্তিগত কাজ করে দিয়েছি। আশা করি আপনার প্রস্তাব তার কান পর্যন্ত পোঁছাতে পারব। একটু সময় দিবেন।
— ঠিক হায়।

আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৫ম পর্ব

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি নিয়মিত 'আমাদের সুজানগর' ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে, এক কিশোরীর প্রেম, ভোরের কৃষ্ণকলি; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা; কবিতাগ্রন্থ: জোছনায় রেখে যায় আলো। তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের বোনকোলা গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই উপজেলার হাটখালি ইউনিয়নের নুরুদ্দিনপুর গ্রামে।

error: Content is protected !!