ঊর্মিমালা-১ম-পর্ব; amadersujanagar.com
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

ঊর্মিমালা (১ম পর্ব)

ঊর্মিমালা (১ম পর্ব)

শাহানাজ মিজান

 

শেষ সম্বল বলতে বাকী ছিলো শুধু এই পুরোনো আম গাছটা। আজ সেটাও বিক্রি করে দিলাম। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু এরপর কি হবে, কি করবো, কিভাবে মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাড় করবো জানি না।
আমার মা কিডনির মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার বলেছেন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করাতে হবে। তা না হলে, মাকে আর বাঁচানো যাবে না। আমরা খুব গরীব। সহায় সম্পত্তি বলতে বাপ দাদার রেখে যাওয়া এই ভিটে বাড়ি, আর বাড়িতে দোচালা টিনের একটা ঘর। এছাড়া আর কিছুই নেই। বাড়িতে কয়েকটি পুরোনো ফলজ গাছ ছিলো, আম, কাঁঠাল, আর নারিকেল গাছ। এসব ফলমূল বিক্রি করে, দুবেলা খেয়ে না খেয়ে কোন মতে বেঁচে ছিলাম, মা ছেলে দুটি প্রাণী।

আমি যখন খুব ছোট তখন বাবা মারা গেছেন। পরের বাড়িতে কাজ করে, বড় কষ্টে মা আমাকে মানুষ করেছে। সবেমাত্র আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট না হলেও, কষ্ট করে মোটামুটি রেজাল্ট আসে। মায়ের খুব ইচ্ছে, আমি লেখাপড়া করে একদিন বড় চাকরি করবো যার জন্য মা সবসময় দোয়া করে। আমিও মাকে খুব ভালোবাসি। মা ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই।
আল্লাহ আমার মায়ের এমন একটা রোগ দিয়েছেন, যার চিকিৎসার খরচ অনেক। দিনে মানুষের জমিতে কাজ করে, রাতে ভ্যান চালিয়ে, কয়েকটি ওষুধ কেনার টাকা হয়।
তাছাড়াও তো খাওয়া-দাওয়ার খরচ আছে। এর আগেই গ্রামের সবাই দু’বার করে চাঁদা তুলে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছে। সবকিছু মিলে আর পেরে উঠছি না। মাকে বললাম, আমাদের বাড়ির পেছনের কিছু অংশ বিক্রি করে দিই। মা মরে যেতে রাজি, তবুও বাড়ি বিক্রি করতে দিবে না।
বাড়ির পাশেই মেম্বার চাচার বাড়ি। তিনি খুব ভালো মানুষ। বিপদে আপদে সব সময় আমাদের পাশে থেকেছেন। সব বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করি। তিনিও বললেন, মাঠের জমি হলে এক কথা, বসত বাড়ি সহজে কেউ কিনতে চায় না। তাছাড়া ঐটুকু বিক্রি করে অপারেশনের টাকা পুরোটা যোগাড় হবে না।

আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে

আমি ভাঙা মনে বাড়িতে ফিরে আসি। আয়নায় নিজেকে দেখি আর নিজেই নিজেকে হিংসে করি, গালি দিই। গরীব ঘরের ছেলে, ঠিক মতো খেতে পাই না, অথচ স্বাস্হ্য আর চেহারা দেখে যে কেউ বলবে, কতবড় ধনীর ছেলে আমি। সবাই বলে, আমার মা দেখতে খুব সুন্দর বলে, আমিও তার মতো দেখতে হয়েছি। দারিদ্র্যতা আর অসুস্থতার কারনে মায়ের শরীর ভেঙে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সুন্দর চেহারা আর স্বাস্থ্য থেকে লাভ কি? গর্ভধারিনী মা আমার বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, আর আমি সন্তান হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখবো, কিছুই করতে পারবো না। কতবড় অসহায়, অভাগা সন্তান আমি। সত্যিই, এই পৃথিবীতে দারিদ্রতা আর অসুস্থতার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কিছু নেই।

পাশের বাড়ির চাচী, মায়ের জন্য এক প্লেট গরম ভাত দিয়ে গেল। মাকে সেটা খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। সকালের ক’টা ভাত ছিলো, তাতে পানি ঢেলে, কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে খেয়ে নিলাম।
মাকে নিয়ে বারান্দায় বসে আছি, এমন সময় মেম্বার চাচা এসে মাকে বললেন,
──ভাবী, আপনাদের এই বিপদে একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি, যদি আপনি রাজি থাকেন।
মা আমার মুখের দিকে একবার চেয়ে, চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন,
──কি করতে হবে?
তিনি যা বললেন, তাতে আমরা মা ছেলে আকাশ থেকে পাতালে পড়ে গেলাম।
──এই গ্রামের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী লোক, শিকদার সাহেবের একমাত্র মেয়ে, ঊর্মিমালাকে যদি আমি বিয়ে করি, তাহলে তিনি আমার মায়ের চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করবেন। শুধু তাই নয়, আমার লেখাপড়া, চাকরি বাকরি কোন কিছুতেই কোনো অভাব থাকবে না।

আরও পড়ুন গল্প  স্বপ্ন জল

মেম্বার চাচা চলে গেলেন। আমি হাঁ করে তার চলে যাওয়া দেখলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো আমার মতামত জানতে চাইলো। আমি ঘোরের মধ্যে থেকেও ভাবতে লাগলাম, ঊর্মি আর আমি একই সাথে, একই স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করছি। ঊর্মি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু ওর একটু শারীরিক সমস্যা আছে। উঁচু লম্বা, গায়ের রঙ ফর্সা হলেও, ওর চোখ দুটো ট্যারা। আর জন্ম থেকেই একটু খুঁড়িয়ে হাটে, মানে একটা পা একটু খাটো। বড় লোকের মেয়ে আর ওর বড় তিন ভাইয়ের ভয়ে, কেউ তাকে সামনে কিছু বলার সাহস পায়নি। কিন্তু কিছু নীচু মানসিকতার মানুষ, আড়ালে হাসা-হাসি করতো। কেননা ঊর্মি তাকায় একদিকে আর কথা বলে অন্যদিকে। আমি অনেক বার শুনেছি আর তাদের বলেছি, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তো সে দায়ী নয়। তাহলে তাকে নিয়ে এতো হাসা-হাসির কি আছে? তাছাড়া মেয়েটি অত্যন্ত ভদ্র, কথা-বার্তায় সাবলীল, ভীষণ ভালো। অবশ্য আমি নিজেও কখনো ঊর্মির সাথে কথা বলিনি, মানে বলার সাহস করিনি।

অথচ সেই ঊর্মির সাথে আজ আমার বিয়ের কথা শুনে, আমার মন সায় দিতে চাচ্ছে না। সেটাও ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্যেই। শেষে কিনা, আমাকে এমন একটি প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে করতে হবে?

আমগাছের নীচে একটা মাচাল বাধা ছিলো, গাছটা কেটে নিয়ে যাওয়ার পর জায়গাটা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি মাচালের উপর বসে বসে এসব কথাই ভাবছিলাম।
মা, বারান্দায় বসে আমাকে কাছে ডেকে বললেন,
──আমি বুঝতে পেরেছি বাবা, তুই কি ভাবছিস। তোর মন এই বিয়েতে সায় দিচ্ছে না। কিন্তু বাবা, আমি চাই তুই এই বিয়েটা কর।
আমি বাধ সেধে বললাম,
──মা, কোথায় শিকদার সাহেব আর কোথায় আমরা? তাদের বাড়িতে ঢোকার সাহস হয়নি কোনোদিন। ঊর্মির ভাইয়েদের সাথে ভয়ে কোন দিন কথা কথা বলিনি, ঊর্মির সাথেও না। এত বড় ধনী লোক তার একমাত্র মেয়েকে আমার মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে কেন? তিনি কি শুধু তোমার চিকিৎসা করাতে দয়া করছেন, নাকি তার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?
──কারণ যাই থাক, তাতে তোর ভালো হবে। আমার চিকিৎসা হোক বা না হোক, আমি তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

──শোন বাবা, খারাপ বা অসৎ লোক যদি প্রভাবশালী ধনী হয়, তবে লোকজন তার সামনে ভয় করে চলে, তোষামোদ করে চলে কিন্তু আড়ালে ঠিকই তাকে নিয়ে খারাপ আলোচনা করে, সমালোচনা করে। কিন্তু সৎ ও ভালো মানুষ যদি প্রভাবশালী ধনী হয়, তবে লোকজন সামনে পিছনে উভয় জায়গাতেই তার প্রশংসা করে, ভালো বলে। শিকদার সাহেব তেমনি একজন মানুষ। এমন মানুষদেরকে আত্মীয় হিসেবে পাওয়া, আল্লাহর দেওয়া অশেষ নেয়ামত ও সৌভাগ্য। মনে রাখিস বাবা, জেনে বুঝে সৌভাগ্য ফিরিয়ে দিতে নেই। আর এমন সৌভাগ্য, মানুষের দরজায় বার বার আসে না।
আর ঊর্মির কথাই যদি ভাবিস, তাহলে এটাও ভাবিস যে, সে একটা মানুষ। আল্লাহ এই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ সৃষ্টি করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের অনেকেরই হাত নেই, পা নেই, চোখ নেই। কেউ কেউ বোবা, কালা, কিন্তু তারও জোড়া দিয়ে দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে কেউ একা পরে থাকে না। সেখানে ঊর্মি তো অনেক ভালো। তাছাড়া আল্লাহ যদি তোর সাথেই তার জোড়া লিখে রাখেন, তো তুই তাকে অস্বীকার করবি কি করে?
আমি মাথা নীচু করে মায়ের কথা শুনছি। মাকে এক মুহূর্তে লোভী ভাবতে গিয়ে, তার মুখের কথা শুনে জিভে কামড় দিলাম আর মনে মনে তওবা পড়লাম।
একটু থেমে মা আবার বলতে শুরু করলেন,
──এই পৃথিবীতে আমাদের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। ঊর্মির বড় তিনটা ভাই, শিকদার সাহেব, তার লোকবল, আত্মীয়বল অনেক। ঊর্মির সাথে তোর বিয়ে হলে, ওরা তোকে আদরে মাথায় করে রাখবে, সব সময় তোর পাশে ছায়া হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যতে কোন একদিন তুই বুঝতে পারবি, এমন আত্মীয়-স্বজন পাশে থাকা মানে, আলাদা একটা শক্তি পাওয়া। তাছাড়া আজ আমি যেটা বুঝে, তোকে এই বিয়েটা করতে বলছি, তুই হয়তো সেটা বুঝতে পারছিস না। আমি তোদের দোয়া করছি বাবা, তোরা জীবনে খুব সুখী হবি। আর তোর সুখ দেখলে, তোকে মানুষের মতো মানুষ হতে দেখে যেতে পারলে, আমি মরেও সুখ পাবো।

আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম

আমার আর ঊর্মির বিয়ের কথা শুনে প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই বেশ খুশী হলো। বললো,
──যাক এত দিনে মুরাদের মা সুখের মুখ দেখবে।
আবার দু-একজন মুখে ভেঙচি কেটে উল্টোপাল্টাও বললো,
──উঁহ, মুরাদ দেখতে শুনতে ভালো ছেলে। তাই শিকদার সাহেব তাকে মেয়ের জামাই করে ঘর জামাই বানাবে। মুরাদের মাকে বানাবে চাকরানী। যাই বলো আর তাই বলো, গরীবের কপালে সুখ নাই।
এসব কথা শুনে আমার খারাপ লাগলেও, মা তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।

আরও পড়ুন ঊর্মিমালা-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

ঊর্মিমালা (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!