-
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা তাহমিনা খাতুন আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রামের মানুষের রোগবালাই তেমন একটা ছিল না!। ভেজাল মুক্ত খাবার, কায়িক পরিশ্রম, অনেক বেশি হাঁটা-হাঁটি করার অভ্যাসের কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বিস্ময়করভাবে কম ছিল। কোথাও যেতে হলে কোনো যানবাহনের সহজ লভ্যতা বর্তমান সময়ের মত ছিল না। স্বভাবতই লোকজনকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। সাধারণত বর্ষাকালে বা শীতকালে ঠাণ্ডাজনিত কারণে জ্বরে ভুগতো মানুষ। আমরা ভাই-বোনেরা জ্বরে আক্রান্ত হলে মাথায় অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালতেন মা। কখনও কখনও দ্রুত জ্বর কমানোর জন্য পুকুর থেকে ভেজা কাদা তুলে এনে কাপড়ে জড়িয়ে পেটের উপর দিয়ে রাখতেন! বড় জোর আব্বা আমাদের গ্রামের ডা.…
-
স্মৃতিতে সুজানগর
স্মৃতিতে সুজানগর ড. রেবেকা বানু আমি সুজানগরেরই সন্তান। আমার বাড়ি সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের কামারহাট গ্রামের পদ্মা পারে, যদিও আমার জন্ম এবং বড় হওয়া ঢাকাতেই। সুজানগরকে চেনা মূলত মুক্তিযুদ্ধের সময়; আতাইকুলা, কামারহাট, আবার গাজনার বিল পার হয়ে আলোক চরে কিছুদিন থেকে আতাইকুলা হয়ে ঢাকায় ফিরে আসা। আমার স্বামী অধ্যাপক ফজলুল করিম ১০ বছরের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। সে সময় তিনি বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দেশে উদ্ভাবিত লাগসই প্রযুক্তির উপর অনুষ্ঠান করতে যেতেন। সালটা ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ১৯৯৮ বা ৯৯ হবে। অনুষ্ঠানগুলো হতো শুক্রবার আর শনিবার। স্থানীয় যেকোন স্কুল বা কলেজের মাঠে চারদিকে ছোট ছোট স্টল করা হতো;…
-
স্নেহশীল কজন
স্নেহশীল কজন তাহমিনা খাতুন কয়েকজন স্নেহশীল মানুষের কথা মনের গভীরে আজও ছায়া ফেলে যায়। যাদের কথা মন হলে আজও মনের গহীনে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করি। যারা আমার রক্ত সম্পর্কীয় না হয়েও আমার শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে এমন একাকার হয়ে মিশে আছেন যে, তাঁদেরকে বাদ দিয়ে স্মৃতিচারণ করাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আমাদের শৈশবে দেখেছি, যাদেরকে আমাদের গৃহস্থালী কাজে বা কৃষি কাজে নিয়োজিত করা হত, তাদেরকে পরিবারের একজন সদস্য হিসাবেই গণনা করা হত। আমার মা, চাচি অথবা ফুফুকে বায়োজ্যষ্ঠ কাউকে কখনো নাম ধরে ডাকতে বা অসন্মান করে কথা বলতে শুনিনি। তাদের অমুকের মা অথবা বাপ এমন সম্বোধন করতে শুনেছি। আমরাও ওনাদেরকে…
-
ছোটবেলার ইদ ও আমি
ছোটবেলার ইদ ও আমি মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান ছোট্টবেলায় ইদ বলতে -আমার গ্রামে আর দশজন ছেলের মত আমার ইদ ছিল না। আমি খুব সুখের এবং দুঃখের দুই ধরনের অনুভূতি লাভ করেছি। সুখের অনুভূতি এমন যা আজও অনুভবে নিজেকে হারিয়ে যাই। আমাদের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের গুপিনপুর গ্রামে। তখন আমি খুব ছোট্টো। এ টুকুই বলতে পারবো, আমার বাবা পরিবারের সবার জন্যই নতুন জামা-কাপড় কিনতেন। আমার পরিবার গ্রামের ধনী পরিবারের মধ্যে একটি ছিলো। আমার বাবা পরিবারের বড় ছেলে। তিনি দাদা-দাদী, দুই চাচা-চাচী, চাচাতো ভাইবোন, একমাত্র ফুফু, ফুফাতো ভাইবোন সবার জন্যই জামাকাপড় কিনতেন। ফুফু’র বাড়িতে আগেই নতুন কাপড় পাঠিয়ে দিতেন।…
-
মধুর স্মৃতি
মধুর স্মৃতি তাহমিনা খাতুন অল্প বয়সের স্মৃতি হয়তো মানুষ কখনো ভোলে না। তেমনি একটি স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। আমার বড় ভাবী ও ওনার মায়ের টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়া জাতীয় কোন জ্বর হয়েছিল। আমার ভাবী ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ভাবীর বাবার একার পক্ষে দুই জন অসুস্থ মানুষকে সুশ্রুষা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। খবর পেয়ে মা ওনাদের সেবা করার জন্য আমাকে আর ছোট দুই ভাই-বোন বাসার আর তুষারকে নিয়ে ভাবীর বাবার বাড়ি সৈয়দপুর গেলেন। কয়েকদিন পর আব্বা আমাকে আনতে গেলেন। কয়দিনেই ভাবীর চাচাত বোনদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমি ফিরে আসার আগে আমার বন্ধুটি আমাকে ভালবেসে তার কিছু পুতুলের কাপড় আমাকে…
-
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
ছেলেবেলার ষড়ঋতু তাহমিনা খাতুন চৈত্রের খর তাপের দাবদাহের পর বৈশাখ আসতো ভয়ঙ্করী রূপে। প্রায়ই কালবৈশাখী ঝড়ে গাছপালা উপরে, ঘর- বাড়ি ভেঙ্গে মানুষের দুর্দশার সীমা থাকত না। আর আমাদের চলতো কাঁচা আম কুড়ানোর ধুম। ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙ্গে মাথায় পড়বে কিনা-তাতে কোন ভ্রুক্ষেপও করতাম না। আমি তখন খুবই ছোট। একদিন দুপুরের পর পরই আকাশের ঈষান কোন ঘন কাল মেঘে ছেয়ে গেল। আব্বা, মা সহ বেশীর ভাগ ভাই-বোন বাড়ির বড় চৌচালা ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। কেবল মাত্র মেজ ভাই অপেক্ষাকৃত ছোট ঘরটায় অবস্থান করছিলেন। প্রচন্ড বেগে ঝড় শুরু হল। আব্বা চিৎকার করে মেজভাইকে বড় ঘরটিতে চলে আসতে বললেন। মেজভাই দৌড়ে বড় ঘরটিতে…
-
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
তৎকালীন গ্রামের চিত্র ও শৈশবের পালা-পার্বন তাহমিনা খাতুন তৎকালীন গ্রামের চিত্র আমাদের ছেলেবেলার দ্বারিয়াপুরের সাথে বর্তমানের দ্বারিয়াপুরের এখন আর কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর বা তার আগের দ্বারিয়াপুর ছিল ঘন বন-জঙ্গল, বিশাল বিশাল তেঁতুল গাছ, বিশাল আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, জামরুল ইত্যাদি গাছ-গাছালিতে ভরপুর। ছিল তাল, খেজুর, নারকেল, সুপারি। এক শান্ত গ্রাম। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠত চারিদিক। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই শোনা যেত শেয়ালের হুক্কাহুয়া রব। বনবিড়াল, মেছো বাঘ (স্থানীয়ভাবে বলা হত বাঘ ডাঁশ) ঘরের আশেপাশে উঁকি-ঝুঁকি দিত। বাড়ির আশেপাশে ঝোপ জঙ্গলে সজারু, বেজী, বুনো খরগোশের (যাকে স্থানীয় ভাষায়…
-
শৈশবের দুঃখজাগানিয়া স্মৃতি
শৈশবের দুঃখজাগানিয়া স্মৃতি কৃষ্ণ ভৌমিক শৈশব যেন দুঃখজাগানিয়া স্মৃতি। আর যদি সে হয় গ্রামীণ শৈশব, তাহলে মধুময় সে সোনালী দিন মনের পর্দায় বারবার ফিরে আসে। তখন মনে অনুভুত হয় আনন্দ, বেদনা। আমার শৈশব কেটেছে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার রাণীনগর ইউনিয়নে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল গাজনার পার্শ্ববর্তী বাঘুলপুর গ্রামে। কৃষিজীবি পরিবারে গ্রাম বাংলার ধুলা, কাদা মাটির সাথেই জড়িয়ে থাকে শৈশব। আমারও তার ব্যতিক্রম নয়। বনজঙ্গল, খাল-বিল, মাঠ-ঘাটে শৈশবের দৌঁড়-ঝাপ, গ্রামীণ মেঠোপথ, বর্ষায় ডুবু ডুবু গ্রামের ছবিও যেন এখনো স্মৃতিতে ভেসে উঠে। এখনো দেখতে পাই দিগন্তজোড়া সবুজ ফসলের মাঠ। আউশ ধানের জমিতে সাথি ফসল, ডাবধান, ভুরা আর কাউনের লম্বা শীষের…
-
প্রথম শহর দেখা ও বিদেশ ভ্রমণ
প্রথম শহর দেখা ও বিদেশ ভ্রমণ তাহমিনা খাতুন শহর দেখা সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় পাবনা শহর দেখতে গিয়েছিলাম মেজ ভগ্নিপতি কাজী মর্তুজা মজিদের (মেজ দুলাভাই) এর সাথে। পেট্রোল চালিত লক্কড়-ঝক্কর বাসে চড়ে পাবনা শহর দেখতে গেলাম। এর আগে কোথাও বেড়াতে যাওয়া বলতে নিজের গ্রাম থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরে মেজ বোনের শ্বশুর বাড়ি চরগোবিন্দপুর অথবা মাইল দুই/তিন দূরে বড় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি সৈয়দপুর গ্রামে! আর সে ভ্রমণও ছিল মহিষের বা গরুর গাড়ি অথবা নৌকায় চড়ে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইঞ্জিন চালিত কোন যানবাহনে প্রথম ভ্রমণ করা! কাজেই বাসে চড়ে সেই প্রথম ভ্রমণ ছিল রীতিমত রোমাঞ্চকর! পাবনা শহরে ভ্রমণ করতে গিয়ে…
-
আমার নানি
আমার নানি ~তাহমিনা খাতুন ‘মিতব্যয়িতার’ শিক্ষা পেয়েছিলাম আমার নানির কাছ থেকে। আমার নানি মারা গেছেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে নানির একমাত্র সন্তান আমার মায়ের কাছে ছিলেন। সেই সময় একদিন নানিকে দেখলাম গোসলের পর নিজের পরনের বাসী ধুতি খানা বালতির অল্প পানিতে ধুয়ে নিচ্ছেন। নানি যতদিন বেঁচে ছিলেন আর সুস্থ ছিলেন সব সময় নিজের কাজ নিজেই করতেন।আমি নানির ধুতিটা ধুয়ে দিতে চাইলে তিনি কোনোভাবেই রাজি হলেন না। আমি নানিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “নানি এতো অল্প পানি দিয়ে কাপড় ধুচ্ছ কেন?” নানি জবাব দিলেন, “আল্লাহ্ তায়ালার কাছে তো একদিন এই পানির জন্যও হিসাব দিতে হবে।”…