নতুন-সূর্যের-অপেক্ষায়-২য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (২য় পর্ব)

নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (২য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

শীতের সকালটা একটু দেরিতে শুরু হয়েছে। সামনে মাঠ ভরা কুয়াশা। কুয়াশা ভেদ করে ধোঁয়া বের হচ্ছে। হায়াত কাজীর ঘুম একটু দেরিতেই ভাঙলো। তার ধারণা চাষার বাচ্চা দুটো ভোর না হতেই আঙিনায় এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা-কফি খেতে খেতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেলো; তখনো রহিম তার ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়নি। প্রায় পনের মিনিট পর খবর এলো রহিম সরদার তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। হায়াত কাজী অঙ্ক কষেই রেখেছে, এদের সাথে একটু মিষ্টি সুরে কথা বললে কাজ হাসিল হবে। তাই বেশ খুশি খুশি মেজাজ। দাদার আমলের বৈঠকখানায় গিয়ে বসলো। রহিম এবং তার ছেলের জন্য বিশেষ ধরনের বসার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে নবাব কাজী।

হায়াত কাজীকে দেখে সৌজন্যবোধে রহিম সরদারের ছেলে সালাম দিলো। হায়াত কাজী ছালামের প্রতিত্তোর দিয়ে, বসার জায়গায় ইঙ্গিত করে বসতে বললো। মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছেলে আনোয়ার; প্রথম দৃষ্টিতেই বসার আসনের দিকে নজর পড়েছে। মনে মনে ভাবছে আল্লাহ যদি ইচ্ছে করেন এমন একদিন আসবে, সেই দিন ঠিক এর বিপরীত অবস্থান হবে। ধৈর্য এবং অপেক্ষা মানুষের সুফল এনে দেয়। বাপ-ছেলে বসলো।
– শুনলাম, তুমি না-কি বিসিএস মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পাড় করেছ?
– ঠিকই শুনেছেন।
– তোমার নাম কি, কোন বিষয়ে এমএ করেছ?
– এস এম রহিম আনোয়ার। অর্থনীতি সম্মান এবং মাস্টার্স ১ম শ্রেণি।
শুনে হায়াত কাজী কিছু সময় চুপসে যায়। বেশ কবার চোখ তুলে আনোয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিবোধ করছিল। এ যেন আষাঢ় মাসের ধানে কাঁচা মরিচ। গা দিয়ে মরিচের ঝাল বের হচ্ছে। তবুও তার প্রস্তাব দিয়ে দেখতে পারে, দেখা যাক কতটুকু গিলতে পারে।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

– তুমি কি জানো এসব ক্ষেত্রে শক্তিশালী সার্পোট দরকার হয়, মানে বড় আত্মীস্বজন না থাকলে উপরে উঠা যায় না। এ ছাড়া কতইবা বেতন-ভাতা।
– এ সব নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি।
– বেশ ভাল। ধর, তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা মাসিক বেতনসহ বাড়ি এবং সর্বক্ষণ গাড়ি থাকবে। শুধু তাই নয় আরও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এমন কোন লোভনীয় চাকরি করতে রাজি আছো কি-না বলতে পার। না, এই মুহূর্তে বলতে হবে তা বলছি না। ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে বলতে পারো।
পকেট হতে হায়াত কাজী একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে আনোয়ারের সামনে ধরলো। আনোযার ধন্যবাদ বলে কার্ডটা হাতে নিয়ে বললো,
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মতো করে চলতে দিন। আমার মতো এই গ্রামে বেশ কজন যুবক এমএ পাস করে বসে আছে। তাদের দয়া করে একটু সাহায্য সহযোগিতা করতে পারেন। এবার আমরা যেতে পারি। আসসালামু আলাইকুম।
বাপ-বেটা বের হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বৈঠকখানায় বেশ কিছু লোকজন এসে উপস্থিত হয়েছে। হায়াত কাজীর মনের ভেতরে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বাহির হতে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। চতুর নবাব বুঝতে পেরেছে। প্রথম বলেই বোল্ট আউট ছোট কাজী। উপস্থিত সবার সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলে ভেতর বাড়িতে চলে যায়। নিজের মনে ফন্দি আঁটতে থাকে, এই ধানি মরিচকে কিভাবে সায়েস্তা করা যায়। দুষ্ট লোকের সুযোগ বার বার আসে। কিন্তু একবার ধরা খেলে জীবন একেবারে ঘোলা জলে কোনো ব্যাঙের মতো সাঁতার কাটা ছাড়া আর উপায় থাকে না।
– নবাব, থানার বড় বাবু কি ধরনের মানুষ?
– চার আনা নিতে ভুল করে না। তবে লোক দেখে।
হায়াত কাজী আর কিছু না বলে ড্রাইভারকে জিনিসপত্র গাড়িতে উঠাতে বলে, নিজে প্রস্তুতি নিতে ঘরের ভেতর চলে গেলো। আর নবাবকে রেডি হতে বললো। নবাব-গিন্নী কিছুই বুঝতে পারছে না ব্যাপার কি। মনিবের হুকুম। তখন প্রায় সকাল এগারোটা বাজে।

আরও পড়ুন গল্প জারজ

গাড়ি সোজা থানা কমপ্লেক্সে ঢুকলো। নবাব আগে নেমে হাঁটতে থাকে, পিছনে হায়াত কাজী। বড় বাবুকে ভিজিটিং কার্ড একজন ডিউটিরত পুলিশকে দিয়ে অপেক্ষা করছে। ঠিক পাঁচ মিনিট পর ভেতরে ডাক পড়লো। নবাব কাজীকে বাইরে রেখে সে নিজেই ডুকলো। প্রায় আধা ঘন্টা কথা বলার পর একটা হলুদ খাম বড় বাবুর হাতে তুলে দিলো হায়াত কাজী।
– কিছু চিন্তা করবেন না। চাষার পুতকে বিসিএস পা-ছা—
– নবাব আপনাকে সাহায্য করবে।
মনের ভেতরে প্রশান্তি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নবাবকে বলে গেলো একটু পরে বড় বাবু তাকে ভেতরে ডাকবে। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না নবাব কাজীর। ভেতরে ডাক পড়লো। রহিম সরদারের সাথে কারো কোন বিবাদ আছে কি-না এবং সেটা কি রকম, যাতে বাপ-বেটার কমপক্ষে ছয় মাস জেলহাজতে শুকনো রুটি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। গ্রামের মানুষের মধ্যে তো কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে বিবাদ থাকে। তারই কিছু সত্য মিথ্যে মিশে একটা তিতো সিরাপ তৈরি করে, বড় বাবুর কানে ঢেলে দিয়ে নবাব কাজী মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে এলো। যাবার সময় হায়াত কাজী পাঁচ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলো,
– চোখ কান খোলা রাখবে।

আরও পড়ুন গল্প পরাভূত

গ্রামের সাধারণ অভাবী মানুষ দিন আনে দিন খায় আর রাতে আরামে ঘুমায়। শীতের রাত অনেকের গরম লেপ-কম্বল নেই। কষ্টে তাদের রাত কাটে। সকালে সুর্যের আলোর অপেক্ষা থাকে। আজ কদিন সকাল নয়টার আগে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা পড়ছে বেশ। গভীর রাতে গ্রামের মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। কুশায়ায় গ্রামটি অন্ধকারে ঢেকে আছে। কাজী বাড়ির পিছনের জঙ্গল হতে মাঝে মধ্যে শিয়ালের করুণ সুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। রাত গভীর হতে গভীরতর। শীতের রাত এমনিতেই দীর্ঘ। তবে আনুমানিক রাত তিনটা বাজে। একদল পুলিশ এসে ঘিরে ফেলে রহিম সরদারের সদ্য তৈরি পনের হাত টিনের ঘরটি। টিনের বেড়ায় লাঠির আঘাতে ঘুম ভেঙে যায় রহিম এবং পরিবারের সদস্যদের। দুটো রুম। এক রুমে আনোয়ার আর তার ভাই পানুকে নিয়ে থাকে। অপর রুমে তার মা-বাবা থাকে। শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই ঘরের বাইরে এসে তাকিয়ে দেখে ছয়-সাত জন পুলিশ রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা রিভলবার।
– এখানে রহিম সরদার আর আনোয়ার কে?
আনোয়ার সাহসী ছেলে। সে এগিয়ে এসে বললো।
– আমি আনোয়ার আর এ আমার বাবা রহিম সরদার।
আর কোন কথা না শুনে আনোয়ারের চোয়ালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। বাকি পুলিশের মধ্যে দুজন এসে রহিম এবং তার ছেলের রশি দিয়ে কোমড় বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলো। রহিম সরদারের বৌ আর পনের বছরের ছেলে আনু চিৎকার করে আশেপাশের লোকজনকে ডেকে তুললো। ফজরের আযান ভেসে আসছে। কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আনোয়ারকে সবাই ভাল ছেলে বলে জানে। যাওয়ার সময় আনোয়ার তার মাকে হেড মাস্টার সাহেবের সাথে দেখা করে বিস্তারিত বলতে বললো। তিনি একটা কিছু করতে পারবেন। তারই স্কুলের ছাত্র ছিলো আনোয়ার। মেধাবী ছাত্র হিসেবে বেশ সুনাম আছে এখনো। হেড মাস্টার সাহেব খুব স্নেহ করেন এখন পর্যন্ত। বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় আনোয়ারকে নিজের ছেলের মতো করে দেখে থাকেন।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

আনোয়ারদের বাড়ি হতে প্রায় দু-মাইল দূরত্ব হেড মাষ্টার সাহেবের বাড়ি। তার বাড়িতে পোঁছেতে সূর্য অনেকখানি উঠে গেছে। আজ সূর্যের মিষ্টি রোদ। ফজরের নামাজ আদায় করে দক্ষিণমুখী বৈঠকখানায় চেয়ারে বসে আছেন। এমন সময় আনোয়ারের মা এবং তার ছোট ছেলে পানুকে নিয়ে উপস্থিত। তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। চেয়ার হতে উঠে এগিয়ে এলেন। পানু তার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। সে তার ভাইয়ের মতো মেধামী ছাত্র। পানুর কাছে বিস্তারিত শুনে নিলেন। হায়াত কাজীর প্রস্তাবের কথা খুলে বললো পানু। এবার আসল ঘটনা পরিস্কার হলো হেড মাস্টার সাহেবের কাছে। তিনি বাড়ির ভেতরে যেতে বলে নিজের মোবাইলে সময় দেখে নিলেন।

হেড মাস্টার সাহেব এক ছেলে, এক মেয়ের জনক। একমাত্র ছেলে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার এবং মেয়ের স্বামী বিসিবি (শিক্ষা) ক্যাডারের সহকারি অধ্যাপক। এছাড়া মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সজ্জন এবং সৎ ব্যক্তি। আনোয়ার একজন মেধাবী ছেলে, তার জীবন নষ্ট হতে পারে না। দেশের কাজে লাগবে। সকাল আটটা বাজে। খোকা সকালে ঘুম হতে ওঠে। সময় নষ্ট করা যাবে না।

আরও পড়ুন নতুন সূর্যের অপেক্ষায়-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!