সুতা-ছেঁড়া-ঘুড়ি-১০ম-পর্ব
উপন্যাস,  তাহমিনা খাতুন,  সাহিত্য

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১০ম পর্ব)

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১০ম পর্ব)
তাহমিনা খাতুন

বিশ.
নূরপুরের মধ্যপাড়ায় কলিমউদ্দিন খন্দকারের বড়ো ঘরটার পিছনে ফলের বাগানের বিশাল বিশাল আম, লিচু গাছের ডালগুলো মুকুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। পিছনের বড়ো মগডালে বসে একটা কোকিল মধুর সুরে ‘কু-উ-উ কু-উ-উ’ স্বরে ডেকে যাচ্ছে। উঠানের এক পাশে একটা সুপারি গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা দুটো ছাগল একটানা ‘ম্যা ম্যা’ করে চলেছে। উঠানের আরেক কোণে একটা পলোর নিচে কয়েকটা মুরগির বাচ্চা পলোর বাইরে আসার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পলোর বাইরে মা মুরগি ছানাদের বাইরে বের হয়ে আসার জন্য ডেকে চলেছে। একটা চিল মুরগি ছানাগুলোকে লক্ষ্য করে কয়েকবার হানা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
ঘরের বারান্দায় বাড়ির পোষা বিড়ালটা মাঝে মাঝে একচোখ খুলে আবার বন্ধ করে দিবা নিদ্রা উপভোগ করতে চাইছে।

ফাল্গুন মাসের এক সকাল। উঠানের এক কোণে একটা পেয়ারা গাছ। পেয়ারা গাছের বাঁকা হয়ে আসা ডালটায় কলিমউদ্দিন খন্দকারের তিন বছর বয়সের নাতনি মিলি পাশের বাড়ির চাচাতো বোন শিল্পীর সাথে পা দুলিয়ে দুলিয়ে বসে পেয়ারা খাচ্ছে আর গল্প করছে। সকালের মিষ্টি রোদ বাড়ির উঠানের পাশের কাঁঠাল গাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে উঠানে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলির বড়ো বোন সকালের সিদ্ধ করা ধান রোদে শুকানোর জন্য কাঠের আগায় বাঁধা একটা সারপাট (স্থানীয় ভাষায় ফসল শুকানোর বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্র) দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কলিমউদ্দিন খন্দকারের বিধবা স্ত্রী ছমিরন বিবি ঘরের বারান্দায় বসে ‘জাঁতি’ দিয়ে সুপারির খোসা ছাড়াচ্ছিলেন। পেয়ারা খাওয়া শেষ করে মিলি দৌড়ে এসে দাদির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“দাদিমা, খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।”
“তুই না এতক্ষণ পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খেয়ে এলি। এখুনি খিদে পেয়ে গেল?
“ওই ছোটো ছোটো পেয়ারা খেয়ে বুঝি খিদে যায়! ভাত দাও।”
“আচ্ছা একটু সবুর কর। আর কয়েকটা সুপারির খোসা ছাড়ানো বাকি আছে, শেষ করেই খাবার দিচ্ছি।”

কলিমউদ্দিন খন্দকারের দুই ছেলে। বড়ো ছেলে আফতাব উদ্দিন এবং ছোটো ছেলে সিরাজ উদ্দিন। বড়ো ছেলে আফতাব উদ্দিন চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়োগ পায় এবং পরিবার নিয়ে অধিকাংশ সময় কর্মস্থলে থাকে। ছমিরন বিবি ছোটো ছেলে সিরাজ উদ্দিনকে নিয়ে নূরপুরেই অবস্থান করেন। তিন বছর আগে সিরাজের স্ত্রী হোসনে আরা সবার ছোটো মিলির জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। সিরাজের বড়ো মেয়ে সীমার বয়স তখন তেরো বছর।
সিরাজের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে ছমিরন বিবিসহ অনেকেই সিরাজকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু সিরাজ রাজি হয়নি। সিরাজের যুক্তি ছিল যদি দ্বিতীয় স্ত্রী তার কন্যাদের সঙ্গে ভালো আচরণ না করে, সেটা সংসারে অশান্তির সৃষ্টি করবে। এছাড়া সীমা এখন বেশ বড়ো হয়েছে। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সীমা সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করতে পারে। কাজেই সেধে ঘরে অশান্তি টেনে এনে লাভ নাই।
সুতরাং হোসনে আরা মারা যাওয়ার পর থেকে ছমিরন বিবিকেই সিরাজের মেয়েদের দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিরাজ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। মাস কয়েক আগে সিরাজ উদ্দিন দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে এনেছে। সিরাজের দ্বিতীয় স্ত্রী কোহিনূর ঘরে আসার পরে তার প্রথম লক্ষ্য ঠিক করেছে সিরাজের বড়ো মেয়ে সীমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দিতে। বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যেই কোহিনূর নিজে উদ্যোগী হয়ে সিরাজের বড়ো মেয়ে সীমাকে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে সরানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিয়ের পরে স্বামীর বাড়িতে আসার সময়ে নিজের ছোটো ভাই, বড়ো ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে এসেছে। বিয়ের মাস কয়েক পরেই নিজের পিতাকেও পাকাপাকিভাবে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে এসেছে। সিরাজ স্ত্রীর এসব তৎপরতার কোনো প্রতিবাদ না করে চুপচাপ সব মেনে নিয়েছে! পাড়ার লোকজন চুপিসারে সিরাজের এমন নত শিরে নতুন স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করা নিয়ে হাসাহাসি করে।
সন্ধ্যার খানিক পরে কোহিনূরের ছোটো ভাই সুজন এসে বলল,
“বুজি, দুলাভাইকে বলে আমাকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দাও। আমি একটা ব্যবসা করি। এভাবে আমরা এতগুলো মানুষ দুলাভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাওয়াটা খুবই খারাপ দেখায়।”
রাতে সিরাজ ঘরে এলে কোহিনূর সুজনের ব্যবসা শুরুর আগ্রহের কথা জানাল।
“আমার কাছে তো নগদ টাকা নাই। দেখি কি করা যায়।”
অগত্যা পৈতৃক সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে সুজনকে ব্যবসার টাকা দিল সিরাজ। ব্যবসা শুরু করল সুজন। কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসায় সাফল্য এল। এর মধ্যে কেটে গেছে বারো-তেরো বছর। সিরাজের দ্বিতীয় স্ত্রী কোহিনূর সিরাজের মেয়েদের তেরো চৌদ্দ বছর বয়স হওয়া মাত্রই এক এক করে সবাইকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করেছে। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে মারা গেছেন সিরাজের মা করিমন বিবি। সিরাজের পৈতৃক ভিটায় পাকাপাকিভাবে বসতি গড়ে নিয়েছে কোহিনূরের ভাই সুজন ও তার পরিবার। দাদিমার আদরের সেদিনের সেই ছোট্ট মিলিও আর দেখতে আসে না দাদিমার লাগানো কালো আমের গাছ, বিশাল জায়গা জুড়ে ঝাঁকড়া লিচু গাছ, পেয়ারা কিংবা গোলাপ জাম গাছ। উঠানের কোণের পাত কুয়ার পানি ও মিলির চোখের পানির সাথে মিলে মিশে বুঝি একাকার হয়ে গেছে!

একুশ.
অনেক বছর পার হয়ে গেছে। অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের মা হয়েছে মোমিনা। হাবিবুর রহমান কৃষি কাজের পাশাপাশি ব্যবসাও করছে। ছেলে-মেয়েরা সবাই লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে।
একদিন মোমিনা সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, এমন সময় এক ভিখিরি এসে ভিক্ষা চাইল। দয়ার্ত হৃদয়ের অধিকারী মোমিনা কখনও কোনো সাহায্য প্রার্থীকে বিমুখ করে না। একটা পাত্রে খানিকটা চাল নিয়ে ভিখিরিকে দিল। ভিখিরির বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের মতো। ভিক্ষা নেওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল মোমিনার মুখের দিকে। তার পর বলল,
“মা, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
মোমিনা একটু অবাক হয়ে বলল,
“মনে করব কেন? বল, কি জানতে চাও?”
“মা, আপনার বাবার বাড়ি কি শাজাহানপুরে?”
“হ্যাঁ। কেন? তুমি কি শাজাহানপুরের কাউকে চেন?”
ভিখিরি চোখে আঁচল দিয়ে কেঁদে উঠল।
মোমিনা আরও বেশি অবাক হয়ে ভিখিরিকে জিজ্ঞেস করল,
“কি ব্যাপার? কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
কিছুক্ষণ কান্নার পর ভিখিরি বলল,
“মা আপনি শাজাহানপুরের মৃত জয়নাল মিয়ার মেয়ে?”
“হ্যাঁ! তো কি হয়েছে?”
“আমি শাজাহানপুরের মোবারক প্রামাণিকের মেয়ে। আপনার বাবার মৃত্যুর পরে আপনার ফুফু আপনার মায়ের নিকট থেকে জোর করে আপনার বাবার কিছু জমির দলিল আমার বাবার কাছে রেখে এসেছিল। আমার বাবা বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই জমিগুলো নিজের নামে দলিল করে নিয়েছিল। তার বিশ্বাসঘাতকতার ফল তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। তার জালিয়াতির ফল আজ তার মেয়ে ভোগ করছে। পাপের ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। আমার বাপের পাপের ফল আমি ভোগ করছি। ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। বিধাতার কি নিষ্ঠুর পরিহাস! যার মায়ের সঙ্গে এত বড়ো অন্যায় করেছিল আমার বাপ, আজ তার মেয়ের দরজায় এসে আমাকে হাত পাততে হচ্ছে।”
“থাক, এসব কথা বলে আর কি হবে? যার যা বিবেকের কাজ, সে তা করেছে। তোমার বাপের বিরুদ্ধেও আমার কোনো অভিযোগ নাই। তোমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। তা তোমার বাপ কি বেঁচে আছে?”
“না মা। আজ দুই বছর হলো আমার বাপ মারা গেছে। এত জালিয়াতি করে যে সব জমি-জমা আত্মসাৎ করেছিল, সে সবই বেঁচে দিতে হয়েছে। পক্ষাঘাতে বিছানায় পড়েছিল কয়েক বছর। ছেলেরাও কেউ দেখতো না। আমার বাপের শেষ সময়টা খুব খারাপ অবস্থায় কেটেছে। আপনি পারলে আমার বাপকে মাফ করে দিবেন মা।”
“আমি তাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। আমার মা আজও আমার বাপের ভিটা ছেড়ে কোথাও যায়নি। তার সে সব দিনে কষ্ট তো আর কেউ মুছে দিতে পারবে না।”

কিছুদিন ধরে আট নয় বছর বয়সের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে নূরপুরের মধ্যপাড়ায় এসেছে। কোথায় বাড়ি, বাবা মা কোথায়, আপন জন কেউ আছে কি না-কিছুই বলতে পারে না। শুধু নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ‘জাহানারা’। সারা দিন এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বেড়ায়, কোনো বাড়ির বাসন ধোয়া, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করা, ধান সিদ্ধ করা, রোদে শুকানো ইত্যাদি কাজ করে দেয়। বিনিময়ে সেই বাড়ির লোকজন তার খাবারের চাহিদা মিটায়। পাড়ার লোকজনকে মা, বাবা, ভাই, বুজি ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে। মোমিনাকে ‘মা’ বলে ডাকে। কয়েকদিন জাহানারার দেখা নাই। একদিন বিকেলে হঠাৎ কোথা থেকে কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। মোমিনা দেখল, মেয়েটার ডান হাতটা পুড়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল,
“কী রে, কীভাবে হাত পুড়িয়েছিস?”
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“নদীর ওপারে কাদের মোল্লার বাড়িতে রাতে ধান সিদ্ধ করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখন চুলার আগুনে হাতটা পুড়ে গেছে।”
দয়ালু মোমিনা তক্ষুনি জাহানারার সেবায় লেগে গেল। হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিল। যে কয় দিন জাহানারার হাতের ঘা পুরোপুরি ভালো না হলো, মেয়েটাকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিল।

আষাঢ় মাস। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। বাইরের দরজায় আঘাতের শব্দ শুনে মেজো ছেলে রাব্বিকে পাঠাল দেখে আসতে এ সময় কে এল।
“মা, এক মহিলা দুটো বাচ্চাকে নিয়ে বাইরের দরজার কাছে বসে আছে। তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”
“কি ব্যাপার? কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? কি চাও এই অবেলায়?”
“মা, আমি অনেক বিপদে পড়ে এসেছি। বাচ্চা দুটোকে আজ দুদিন ধরে কোনো খাবার দিতে পারিনি। আমাকে যদি আপনাদের বাড়িতে একটু থাকতে দিতেন, আমি আশেপাশের বাড়িতে কাজ করে বাচ্চা দুটোর মুখে এক মুঠো খাবার দিতে পারতাম।”
“তা তোমার স্বামী কোথায়?”
মোমিনার কথার জবাব না দিয়ে মহিলা কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ কান্নার পর বলল,
“কি বলব মা। আমার স্বামী যদি কোনো কাজ করত, তাহলে কি আর আমার এত কষ্ট হয়। সে কোনো কাজ করে না। সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়। কাজ করার কথা বললে আমাকে মারধোর করে। নিরুপায় হয়ে আমি বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। দয়া করে আমাকে একটা থাকার জায়গা দেন।”
মোমিনার দয়ায় আশ্রয় জুটল অসহায় জৈতুনের।

রাত আটটা সারে আটটা হবে। শীতের রাত। কয়েক দিন ধরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। মোমিনার বড়ো মেয়ে কনা লেপ মুড়ি দিয়ে বসে পূবপাড়ার রুস্তম আলির স্ত্রী সেলিনাকে গল্পের বই পড়ে শোনাচ্ছে। সেলিনা মুগ্ধ হয়ে গল্পের বই পড়া শুনছে। কনার গল্পের বইপড়া এবং সেলিনার মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনার এই দৃশ্য গ্রীষ্ম বর্ষা, শীতের প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই সেলিনা তিনটি ছেলে মেয়েসহ মধ্যপাড়ায় থাকছে।

নূরপুরের পূর্বপাড়ার হাসমত আলির ছেলে রুস্তম আলি। অল্প বয়স থেকেই ছেলেটি মানসিক রোগগ্রস্ত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে। কয়েক দিন ভালো থাকে তো আবার মানসিক সমস্যা বাড়ে। পাবনার মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়েছে। তেমন কোনো উন্নতি হয় নাই। রুস্তমের বয়স যখন তেইশ চব্বিশ বছর, রুস্তমের বাপ-মাকে গ্রামের কয়েকজন পরামর্শ দিল রুস্তমকে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার জন্য। লোকজনের পরামর্শে বাপ-মায়েরও বিশ্বাস হলো ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলে হয়তো সে সুস্থ হয়ে যাবে। সেই আজব ভাবনা থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নিল, রুস্তমকে বিয়ে দেওয়ার। মানসিক রোগগ্রস্ত ছেলের মানসিক সমস্যার কথা গোপন করে বেশ দূরের গ্রাম ভাগলপুরের হতদরিদ্র দেওয়ান আলির মেয়ে সেলিনার সঙ্গে রুস্তমের বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের পর কয়েক বছর মোটামুটি ভালো থাকল রুস্তম। চারটি সন্তানের জন্ম হলো সেলিনার। পরিবারের সবার মধ্যে একটা স্বস্তি দেখা দিল। কিন্তু রুস্তমের বয়স যখন ত্রিশ বত্রিশ বছর, সেই সময় আবার মানসিক সমস্যা দেখা দিল এবং বর্তমানের সমস্যা আগের চেয়ে আরও বেশি জটিল হয়ে দেখা দিল।
এক দিন সকালে সেলিনা তিনটা শিশুসহ মোমিনার বাড়িতে এসে হাজির। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“চাচি, আমাকে আপনাদের কাছে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
“কেন কি হয়েছে? এত সকালে বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে এসেছ?”
“চাচি এ পাগলের সাথে থাকলে ও আমাকে মেরেই ফেলবে। ইদানীং ওর মানসিক সমস্যাটা এত বেড়েছে যে ওর সঙ্গে থাকাটা বিপজ্জনক হয়ে গেছে। যেকোনো সময় মারাত্মক কিছু করে বসতে পারে। তিন চার দিন আগে রান্না একটু দেরি হয়েছিল। খাবার দিতে দেরি হওয়ায় আমাকে খোলা মাঠে নিয়ে লোকজনের সামনে আমাকে বিবস্ত্র করে গাছের সাথে বেঁধে এমন মার মেরেছে যে লোকজন না বাঁচালে ওই দিনই মরে যেতাম। কাল রাতে হাট থেকে একটা কাঁঠাল কিনে এনেছে। রাতেই কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছে। মাঝ রাতে আমার ঘুম থেকে জাগিয়ে সেই কাঁঠালের সেই ভেজা বিচি ভেজে দেওয়ার জন্য আমাকে মারতে শুরু করল। বাচ্চাগুলো ভয়ে চিৎকার শুরু করায় পাশের বাড়ির লোকজন আমাকে বাঁচিয়েছে। এজন্য ভোর হতেই আপনার কাছে এসেছি।
“ঠিক আছে, বসো। দেখি কি করা যায়।”
মোমিনা তার ননদ জান্নাতুল ফেরদৌসের সাথে কথা বলল সেলিনার দুর্দশা নিয়ে।
“ঠিক আছে ভাবি। একটা মানুষকে তো আর জেনে শুনে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় না। আমার ঘরের পিছনের বারান্দায়-যেখানে সুন্দরী পাগলি থাকত ওখানে একটা চৌকি আছে। ওখানেই ওকে থাকার ব্যবস্থা করে দেই। আর পাড়ার সবার বাড়িতে কাজ করে বাচ্চাদেরসহ নিজের খাবারের বন্দোবস্ত করতে পারবে।”

আরও পড়ুন সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি-   
১ম পর্ব
২য় পর্ব 
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১১তম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১০ম পর্ব)

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!