সুতা-ছেঁড়া-ঘুড়ি-৩য়-পর্ব
উপন্যাস,  তাহমিনা খাতুন,  সাহিত্য

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৩য় পর্ব)

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৩য় পর্ব)

তাহমিনা খাতুন

চার.
দুইদিন পর জয়নালকে নৌকা করেই গঞ্জে পরেশ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল শাহাবুদ্দিন। সকাল দুপুর গড়িয়ে গেল। জয়নালকে নিয়ে শাহাবুদ্দিন ফিরলো না। উৎকণ্ঠায় ঘরে পায়চারি করছে হালিমা। বিকালের দিকে দুইজন লোক ধরে ধরে অসুস্থ জয়নালকে শাহাবুদ্দিনের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। শাহাবুদ্দিন কোথায় জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে লোক দুজন বেরিয়ে গেল। জয়নালকে জিজ্ঞেস করলে সেও চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠল সে।
“তোমার ভাই আমার অনেক বড়ো সর্বনাশ করেছে। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে গেছে। আমি সামান্য কয়েকটা টাকা ধার নিয়েছিলাম তার কাছ থেকে। অসুস্থ হয়ে না পড়লে এতদিন ওই টাকা ফেরত দিয়ে দিতে পারতাম। আমি যদি আর সুস্থ না হয়ে উঠি, সেই আশঙ্কায় তোমার ভাই আমার পনের বিঘা পৈতৃক সম্পত্তি ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে জোর করে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। এমন বিশ্বাস ঘাতকের বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকবে না আমি। আমাকে এই মুহূর্তে এখান থেকে নিয়ে চল। এ বাড়িতে থাকলে আমাকে মেরে ফেলবে তোমার ভাই।”
এ কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল হালিমার। শাহাবুদ্দিনের নৌকার মাঝি হাবিবকে ডেকে বলল,
“একটা নৌকার ব্যবস্থা দেন।”
শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী গোলাপ জান বিবিও মোটেই সুবিধার মানুষ না। হালিমা তার অসুস্থ স্বামী আর সন্তানকে নিয়ে এখানে আসায় একটা উটকো ঝামেলা মনে করে মনে মনে বেশ বিরক্ত ছিল। হালিমাকে অসুস্থ স্বামী আর শিশু কন্যাকে নিয়ে চলে যেতে দেখেও কিছু বলল না। বরং মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অসুস্থ স্বামী এবং একটা অবোধ শিশুকে নিয়ে নৌকায় চড়ে বসল হালিমা।
ফিরে আসার পর সারা রাত অস্থিরতায় কাটালো জয়নাল। বার বারই ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে লাগল আর বলতে লাগল,
“আপনজন হয়ে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে করতে পারল ভাইজান, আপন ছোটো বোনের স্বামীর সঙ্গে? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের এত বড়ো অন্যায়ের কি জবাব দিবে হালিমা!

 আরও পড়ুন তিলতাল

পরদিন সকালে গ্রামের দলিল লেখক আনসার আলিকে ডেকে পাঠালো। আনসার আলির সঙ্গে জমি জমা নিয়ে আলাপ করল। পরের দিন আবার এল আনসার আলি। প্রায় দুপুর পর্যন্ত আনসার আলিকে নিয়ে দলিল লেখালেখির কাজ শেষ করল। এরপর হালিমাকে ডাকল। গলা পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দরজার এককোণে এসে দাঁড়াল হালিমা। জয়নাল হালিমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আনসার আলির। বলল,
“শোন হালিমা, ইনি হলেন আনসার ভাই। আমার অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন একজন মানুষ। আমার অবশিষ্ট জমিজমা যা আছে, তার বেশিরভাগই আমার মেয়েটার নামে লিখে দিয়ে গেলাম। বাকি জমি আমার নামেই থাকল। মোমিনার নামের জমির দলিলপত্রগুলো আনসার ভাইয়ের কাছেই নিরাপদে থাকবে। তোমার নামে কিছু লিখে দিলাম না। আমি জানি, তোমার নামে জমি লিখে দিয়ে গেলে আমি মারা যাওয়ার পরদিনই আমার বোন আর তোমার ভাই মিলে তোমার কাছ থেকে জালিয়াতি করে সব কিছু নিজেদের নামে লিখে নিবে। মোমিনা যেহেতু নাবালক, সে জন্যে ওর নামে করা দলিল পরিবর্তন করা সহজ হবে না। আমার মেয়েটা যখন বড়ো হবে, ওর জমিজমা আনসার ভাইয়ের নিকট থেকে বুঝে নিতে পারবে।”
এতগুলো কথা বলে দুর্বল জয়নাল হাঁপাতে লাগল।
রাতের দিকে জয়নালের অবস্থা আরও খারাপ হলো। যেন আদরের মেয়ের ভবিষ্যতকে একটু নিরাপদ করার জন্যই হয়তোবা একটু সময়ের জন্য জীবনীশক্তি ফিরে পেয়েছিল সে। প্রদীপের শিখা যেমন নিভে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে ওঠে, জয়নালও যেন ঠিক তেমনি করে জ্বলে উঠেছিল। রাতে কোনো খাবারও খেতে পারল না। সারারাত অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী জয়নালের শিয়রে বসে নির্ঘুম, ভয়ংকর রাত্রি পার করল পনের বছরের হালিমা। চোখের পানিতে শাড়ির আঁচল ভিজিয়েছে। জয়নালের বিছানার পাশেই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে এক বছর বয়সের মোমিনা। নিষ্পাপ শিশু এখনও জানে না তার জন্য অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত।

আরও পড়ুন প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

রাত শেষ হয়ে এসেছে। আরও একটা নতুন দিন শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে পৃথিবী। একটু একটু করে ফিকে হতে শুরু হচ্ছে রাতের আঁধার। শাজাহানপুর গ্রামের মসজিদ থেকে ভেসে এল ফজরের আজানের মধুর ধ্বনি। চারদিকে ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। একটু পরে মোরগের ডাক শোনা গেল।
সারা দিন রাতের শারীরিক আর মানসিক ধকলে ভোরের দিকে একটু সময়ের জন্য চোখ দুটো লেগে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ জয়নালের ডাকে ধরমর করে উঠে বসল হালিমা। জয়নালের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখে ভয় পেয়ে গেল। কোনো সাহায্য ছাড়াই জয়নাল উঠে বসল বিছানায়। হাঁপাতে হাঁপাতে হালিমাকে বলল,
“আমার মেয়েটাকে একটু আমার কোলে দাও। ওকে একটু ভালো করে দেখি, একটু আদর করি শেষবারের মতো।
চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘুমন্ত মোমিনাকে জয়নালের কোলে তুলে দিল হালিমা। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় একটু কেঁদে উঠেই বাবার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটি।
একটু পরেই বলল,
“নাও ওকে। আমার মেয়েটাকে অনেক আদর দিয়ে বড়ো করিও। আমাকে মাফ করে দিও। তোমাকে আর আমার মেয়েটাকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে গেলাম। মহান আল্লাহর হাতে তোমাদের সঁপে দিয়ে গেলাম।” বলেই অস্থির হয়ে শুয়ে পড়ল।
দিশেহারা হালিমা ছুটে গেল পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ হাতেম আলিকে ডাকতে। হাতেম আলি তখন ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য অজু করে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কান্নারত হালিমাকে দেখে দৌড়ে জয়নালের ঘরে ঢুকলেন। পিছনে হালিমা। ততক্ষণে জয়নালের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিনের রোগে ভোগা জয়নালের বুকটা হাপড়ের মতো ওঠা-নামা করছে। হাতেম আলি জয়নালের শেষ শয্যার পাশে বসে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন। হালিমাকে বললেন জয়নালের মুখে এক চামচ পানি দিতে। কাঁপা কাঁপা হাতে জয়নালের মুখে পানি ঢেলে দিল হালিমা। ঠোঁটের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে গেল। একটা হেঁচকি তুলে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল জয়নাল। হাতেম আলি জয়নালের গায়ের চাদরটা দিয়ে মুখটা ঢেকে দিলেন। আকাশ বিদীর্ণ করা হালিমার চিৎকারে ভরে গেল চারপাশ। মাত্র পনের বছর বয়স তখন হালিমার। বাবার পাশে এক বছর বয়সের মোমিনা তখনও গভীর ঘুমে।

আরও পড়ুন পরাজিত নাবিক

পাঁচ.
“খালা জান আমি তো আর বাঁচব না। যে মরণব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে, এর হাত থেকে তো আজ পর্যন্ত কেউ বাঁচতে পারেনি। আমারও সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমার অবোধ ছেলেমেয়েগুলো মানুষ করে যেতে পারলাম না। ওদের মা তো আমার আগেই চলে গেল। আমার শেষ ভরসা আপনি আর বু জান। আপনাদের কাছেই আমার বাচ্চাগুলোকে রেখে গেলাম। আমি মারা যাওয়ার পর আমার বাচ্চাদের দেখবেন খালা জান”, হাঁপাতে হাঁপাতে কথা কয়টি বলে বড়ো বোন আর খালার মুখের দিকে তাকালো নূরপুর গ্রামের আফতাব খন্দকারের ছেলে মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন খন্দকার।
শিহাব উদ্দীনের কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন শিহাব উদ্দীনের মাথার পাশে বসা সেজো খালা জমিলা বেগম।
“এমন কথা বলিস না বাপ। কি বা বয়স হয়েছে তোর। আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই তোর বাচ্চাদের উপর এমন নারাজ হবেন না। তিনি দয়াময়। তিনি নিশ্চয়ই তোকে সুস্থ করে তুলবেন”, শিহাব উদ্দীনের বাঁ দিকে বসা সেজো খালা জমিলা বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললেন।
“সে আর হবে না খালা জান। আমি জানি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে।”
বিছানার অপর প্রান্তে বসা বড়ো বোন লাইলী বেগমও নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। বললেন,
“আমি যদি বেঁচে থাকি, আমার ছেলেমেয়েদের মতোই তোর ছেলেমেয়েরাও মানুষ হবে।”

আরও পড়ুন বড়ো বাবা

কয়েকদিন আগে শিহাব উদ্দীনের স্ত্রী মায়মুনা গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মাত্র চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই শিহাব উদ্দিনও মায়মুনার মতোই অকালে চিরবিদায় নিল।
শাজাহানপুর থেকে কয়েক মাইল দূরের গ্রাম নূরপুর। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে গ্রামটিকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে মধ্যপাড়ায় মাত্র কয়েকটি পরিবার যারা বৃটিশ শাসন আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আশেপাশের অনেক গ্রাম থেকে এমনকি নূরপূরের দক্ষিণ এবং পূর্বপাড়া থেকে অনেকখানি এগিয়ে। অনেকেই তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইনি পেশা অথবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছেন বা লেখাপড়া করছেন। কেউ কেউ আবার লেখালেখি, পত্রিকা সম্পাদনা ইত্যাদিও করে থাকেন।
নূরপুরের দুটি পরিবার প্রধানত সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। খন্দকার পরিবার এবং কাজি পরিবার।
দুই পরিবারের লোকজনই শিক্ষাদীক্ষায় বেশ এগিয়ে। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশীর আম্রকাননে পরাজিত করে ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে এবং শেষ পর্যন্ত সিপাহি বিদ্রোহে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে পরবর্তী প্রায় দুশো বছর ভারত শাসন করে। মুসলমান শাসকদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার কারণেই হয়তোবা প্রচন্ড অভিমান থেকে ভারতের মুসলমান সমাজ ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহী ছিল অথবা পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের দাপ্তরিক ভাষা আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করার অভ্যাস বজায় রেখে অভিজাত মুসলিম পরিবারগুলোতে আরবি, ফার্সি উর্দু ভাষায় শিক্ষাগ্রহণকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হতো। যে সময় পুরুষদের শিক্ষার চর্চা তেমন একটা ছিল না, সেই সময়েই কাজি পরিবার ও খন্দকার পরিবারের নারীরা আরবি, ফারসি এবং উর্দু ভাষায় শিক্ষিত ছিলেন। শিহাব উদ্দীনের বড়ো বোন এবং খালাজান আরবি, উর্দু এবং ফারসি ভাষায় বেশ দক্ষ ছিলেন। একই কথা খাটে কাজি পরিবারের বেলায়।

আরও পড়ুন গল্প হলেও সত্য

কাজি পরিবারের প্রধান আব্দুস শুকুর। এলাকার লোকজন তাঁকে শুকুর কাজি নামেই চেনে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালোই অর্থ বিত্ত, জমি জমার মালিক হয়েছেন। শুকুর কাজির স্ত্রী রহিমা বেগম তিন ছেলে রেখে চতুর্থ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অত্যন্ত অল্প বয়সে মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। শুকুর কাজি কষ্টে তিন ছেলেকে বড়ো করেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। শুকুর কাজির মৃত্যুর পর তিন ভাই সম্পত্তি ভাগ বণ্টন করে যার যার মতো সংসার করছে।
শুকুর কাজির মেজো ছেলে নুরুল ইসলাম কয়েক মাইল দূরের গোপালগঞ্জ মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করে খানিকটা সমাজ সেবকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে তাঁর চেষ্টায় নূরপুরে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি ডাকঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার কারণে মধ্যপাড়ার সব ছেলেমেয়েই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারে। দুই একজন আবার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কয়েক মাইল দূরের বটতলা হাইস্কুলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে যায়।
এছাড়া নুরুল ইসলাম গ্রামের লোকজনের আভ্যন্তরীণ ছোটো ছোটো বিবাদ সালিসের মাধ্যমে মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। তাঁর পক্ষপাতহীন সালিশে গ্রামের লোকজনও বেজায় খুশি।
নূরপুরের দক্ষিণ এবং পূর্বপাড়ার দুই একটা পরিবার ছাড়া অধিকাংশই কৃষিজীবী অথবা ভূমিহীন বর্গাচাষী। কেউ কেউ আবার একটু অবস্থাপন্ন কৃষক পরিবারে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কয়েকজন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়না নদী কিংবা কড়ই খালি বিলে মাছ ধরে সংসার চালায়।

আরও পড়ুন  চোখে দেখা নীলকণ্ঠ

আফতাব উদ্দিন খোন্দকারের দুই ছেলে শিহাব উদ্দিন ও সুজাউদ্দিন। শিহাব উদ্দিন গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে মাইল দুয়েক দূরের গোপালপুর মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করেছে। শিহাব উদ্দিন গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেন এবং সুজা উদ্দিন গোপালপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। সুখে দুখে ভালোই চলছিল নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবন।
হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নূরপুরে প্রাদুর্ভাব ঘটলো গুটি বসন্তের। এর মধ্যেই দক্ষিণপাড়ার কয়েকজন আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। গ্রাম জুড়ে থমথমে পরিবেশ। সবাই আতঙ্কিত। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই পূর্বপাড়া আর মধ্যপাড়ায়ও হানা দিল ভয়ংকর মরণব্যাধি। মাত্র দিন সাতেকের মধ্যে ছয়, চার এবং দুই বছর বয়সের তিন অবোধ শিশুকে অকূলে ভাসিয়ে শিহাব উদ্দীনের স্ত্রী মায়মুনা চিরবিদায় নিল। ছোটো ছোটো তিন শিশুকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়ল শিহাব উদ্দিন! শিহাব উদ্দীনের এই মহা বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ালেন শিহাব উদ্দীনের বড়ো বোন লাইলী বেগম ও সেজ খালা জমিলা বিবি। শিহাবুদ্দিন ও সুজাউদ্দীনের স্নেহময় পিতা খোন্দকার আব্দুল মতিন এবং মা হনুফা বেগম অল্প বয়সে দুই শিশু সন্তানকে রেখে মৃত্যু বরণ করেছেন। বড়ো বোন আর সেজ খালার স্নেহ মমতায় তারা দুই ভাই বেঁচে আছে। আর আজ তার তিন শিশু সন্তানকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে। এটা ভেবে অঝোরে কেঁদে চলেছে সে।
গুটি বসন্তের মতো ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগীকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি কোনো কবিরাজ। নিজেদের বিপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এই দুই মহীয়সী নারী নির্দ্বিধায় শিহাব উদ্দীনের সেবা করে চলছেন। মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিন অবোধ শিশু পাঁচ বছরের হাবিব, তিন বছরের ফজর ও এক বছর বয়সের জান্নাতুল ফেরদৌসকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে গেছে মায়মুনা। মায়মুনা মারা যাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় শিহাব উদ্দিন ও একই পথের যাত্রী হলো।

আরও পড়ুন সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি-   
১ম পর্ব
২য় পর্ব 
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১তম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন ছড়া, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছেন। পেশায় একজন আইনজীবী। তিনি ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!