রৌদ্রডোবা-চাঁদ-২য়-পর্ব
আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব)

রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব)

আবু জাফর খান

 

সে রাতের কথা বিদিতা কখনো কোন বন্ধুকে বলেনি। রুদ্রকে সে যতদূর চেনে, সে নিশ্চিত, রুদ্রও কাউকে কিছু বলেনি। রুদ্র-বিদিতার দূরে সরে যাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ওদের বন্ধুরা। তারা ভেবেছিল এটি সাময়িক চিড়। কেউ কেউ মধ্যস্থতা করতে এসেছিল। বিদিতা রাজি হয়নি। নাক উঁচু বলে তাকে নিয়ে বন্ধু মহলে এক ধরনের গুঞ্জন আছে। সে বরাবরই একটু জেদি টাইপের। বিদিতা ভেবেছিল রুদ্র নিজেই এসে ক্ষমা চাইবে। তাহলেই সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তা হয়নি। রুদ্র আসেনি আর। সেটি ছিল ফাইনাল ইয়ার। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ছিটকে গেল এদিক-সেদিক।

কেউ কারও ঠিকানা রাখেনি। বিচ্ছিন্ন হবার প্রথম দিকে বিদিতা কখনো সখনো কোন না কোন বন্ধুর মাধ্যমে রুদ্রর খোঁজ-খবর পেত। অতপর ধীরে ধীরে সময়ের ব্যবধানে কালের নিয়মে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল নিজ নিজ বলয়ে। জীবন বুঝি এরকমই। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বৃত্তের বাইরে এসে কারও সন্ধান করা হয়ে ওঠে না আর। কিন্তু বিদিতার আলো-আঁধারের জাফরি কাটা অন্তরমহলে রুদ্র একেবারে তাঁবু গেড়ে বসল। বিদিতার জীবনের প্রথম পুরুষ স্পর্শের সেই স্মৃতি ফিকে তো হলোই না বরং প্রাণিত উদ্ভাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে রইল। মাঝের একযুগ তার দেখা পায়নি ঠিকই, কিন্তু স্মৃতিতে মিশে ছিল প্রমূর্ত প্রাখর্যে। আজ নিয়তির আশ্চর্য নিবন্ধে সেই রুদ্র তার সহযাত্রী। সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি তার পাশে তার গা ঘেঁষে বসে আছে।

আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম

রুদ্র মুখে অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে বলল,
“এই যাহ্, তোর সঙ্গে তো আলাপ করিয়ে দেয়াই হয়নি।”
বলেই পাশের ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইনি আমার মা।”
তারপর বিদিতার দিকে তাকিয়ে হাসল,
“আর এ বিদি। ইউনিভার্সিটিতে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।”
বিদিতা দুহাত জড়ো করে হাসল,
“আমার নাম বিদিতা কমল। ও দুষ্টুমি করে আমায় বিদি বলে ডাকতো।”
“ভারি মিষ্টি নাম তো!” ভদ্রমহিলা সালামের প্রত্যুত্তরের ভঙ্গি করে বললেন।
“কিন্তু আমার মেয়ে প্রেমার বিয়েতে তোমায় দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। রুদ্রর সকল বন্ধুই তো এসেছিল। এমন আলোর ফুলকির মতো মেয়েকে একবার দেখলে তো ভোলার কথা নয়। বেস্ট ফ্রেন্ড সেদিন অ্যাবসেন্ট ছিল বুঝি?”
বিদিতা আড়চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে।
তারপর ভদ্রমহিলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
“আসলে তখন আমার এমন একটি জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল…।”
তারপর প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আপনারা কতদূর যাচ্ছেন?”
“চিটাগং। রুদ্র একটি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করে। গত বছর ওর বাবা চলে যাবার পর ছেলে কিছুতেই আমায় একা থাকতে দিতে চায় না।”
ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আরও পড়ুন গল্প ঊর্মিমালা

একটু আগে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকেছে। চোখ বুজে নানা আকাশ-পাতাল ভাবছে বিদিতা। যা কিছু আঁকড়ে ধরে সাধারণ কোনো মেয়ে সুখের সাগরে ভাসে, সবই তার রয়েছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং বড় ব্যবসায়ী স্বামী, ফুটফুটে একটি সন্তান, সাজানো গোছানো বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি, কী নেই তার! ঘরে বন্দি নিঃসঙ্গ গৃহবধূও সে নয়। মোটা বেতনের ভালো একটি চাকরিও করে। তবুও ভালো না লাগার একটি জটিল আবর্তে ঢুকে বসে আছে বিদিতা। এক ধরনের বিষণ্নতা যেন তাকে সর্বদা জড়িয়ে ধরে থাকে ঢুলু ঢুলু পৌষালি সন্ধ্যার হিম কুয়াশার মতো। এই সমস্ত আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ যে কেটেছে আর কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে জানে না সে।

“এই বিদি, চা খাবি?”
চোখ কচলে বিদিতা দেখে একটি স্টেশনে ট্রেন দাড়িয়ে আছে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় হাতে জানালার বাইরে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র।
ঘুমচোখে বিদিতা বলল,
“এটি কোন স্টেশন?”
“ফেনী।”
চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিল রুদ্র।
“ওদিককার টয়লেটটি মোটামুটি পরিষ্কার এবং ফাঁকা আছে। ঘুরে আসতে পারিস। পরে আবার ভিড় হয়ে যাবে।”
তাড়া দিল রুদ্র।
“যাচ্ছি রে বাবা। তোর ছটফটে স্বভাব এখনো সেই আগের মতোই আছে! বড় হোসনি একটুও!”
টয়লেট থেকে ফিরে সিটে বসেছে বিদিতা। ততক্ষণে রুদ্র বিদিতার লাগেজ গুছিয়ে সিটের পাশে রেখেছে।
“বিদি, তোর ছোটখাটো এই জিনিসগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নে। লাগেজগুলো আমি গুছিয়ে তোর সিটের পাশে রেখেছি। আর হ্যাঁ, ইভনিং স্ন্যাকক্সের অর্ডারও দিয়ে দিয়েছি। এসে যাবে শীঘ্রই।”
কোনো মানে হয়! এটিই প্রথম নয়, এমন এমব্যারাসিং অবস্থায় এর আগেও বিদিতাকে ফেলেছে রুদ্র। সহসা গালে জমা হলো লাজ রক্তকণিকার দল। আড়চোখে রুদ্রর দিকে কটমটিয়ে তাকাল বিদিতা।
বাবু কিন্তু দিব্যি ভাবলেশহীন। তার সমস্ত মনোযোগ জানালার ওপাশের চলমান দৃশ্যাবলির দিকে।

আরও পড়ুন গল্প বেলীফুলের ঘ্রাণ

ট্রেন সীতাকুণ্ডু স্টেশনে এসে দাঁড়াল। সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগে। স্টেশনটি বেশ ফাঁকা। হকারদের আনাগোনাও যেন কম। বাইরে প্লাটফর্মে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জন্য অনেকগুলো ফাইবারের চেয়ার পাতা রয়েছে। ছেলেমানুষের মতো লোভ হলো বিদিতার। সে ট্রেন থেকে নেমে ধীর পায়ে গিয়ে একটি চেয়ারে বসল। রুদ্রও কখন যেন এসে তার পাশের চেয়ারে বসেছে সে খেয়ালই করেনি।
নীল রঙের দীর্ঘ ট্রেনটিকে বাইরে থেকে সাপের মতো মনে হচ্ছে। অনেকটা পথ বুকে হেঁটে এসে যেন গা এলিয়ে শীতঘুম দিচ্ছে।
“তোর সংসারের কথা তো কিছু জানা হলো না রে রুদ্র। কোথায় বিয়ে করেছিস? বউ নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে তোকে? বাবা হয়েছিস কি?”
রুদ্র হো হো করে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎই আনমনা। যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে।
“বিদি, যাকে ভালোবেসেছিলাম এবং পথের সাথী করব বলে মনস্থ করেছিলাম, সে কোনো এক রাতে আবেগ বিহ্বল রুদ্রর স্পর্শকে লাম্পট্য ভেবে তিরস্কার করে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। সে রাতে সেই অতি প্রিয় মানুষটির অবহেলায় আমার মনের পোষিত স্বপ্ন দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। আমি হয়েছিলাম চূর্ণ-বিচূর্ণ। তাই আর ওপথে পা বাড়াইনি। আমার আবার সংসার!”

আরও পড়ুন গল্প কপিশ নয়ন

বিদিতা অকস্মাৎ জড়পিণ্ড। তার মনের গহিনে বহুদিনের জমাট মেঘ সহসা আরও ঘনীভূত হয়ে বুকের ওপর চেপে বসল। সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি নয়, রক্ত ঝরছে অবিশ্রান্ত ধারায়। যাকে সেও একদিন পেতে চেয়েছিল, ক্ষণিক অভিমানে তাকে ছেড়ে স্বার্থপরের মতো নিজেকে জড়িয়েছে সুগতর সঙ্গে। অবলীলায় সন্তানের মা হয়েছে। আর রুদ্র!
বিদিতার জন্য তার সংসারী হওয়া হয়নি! নিজের এই ক্ষুদ্রতা, এই নিচুতার জন্য নিজেকে কখনই ক্ষমা করা সম্ভব হবে না তার। নিজেকে তার অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছে। এই তুচ্ছতার দুর্বহ ভার আমৃত্যু তাকে বহন করে যেতে হবে।
“সেই রাতে জোর করে কেন মেয়েটিকে নিজের করে নিলি না তুই? কেন তার কপট বাধা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলি না? সেও যে তোকে ভালোবাসতো, আজও বাসে! সে যে তোকেই পেতে চেয়েছিল রুদ্র!”
“আমার টাইপ তো তুই জানিস বিদি! জোর খাটানো সম্ভব ছিল না। আমি তাকে ভালোবাসতাম। সে স্বেচ্ছায় সমর্পিত হবে, আমি সেটিই চেয়েছিলাম।”

আরও পড়ুন রৌদ্রডোবা চাঁদ-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

কবি ও কথাশিল্পী আবু জাফর খান নিবিড় অন্তর অনুভবে প্রত্যহ ঘটে চলা নানান ঘটনা, জীবনের গতি প্রকৃতি, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, ব্যক্তিক দহনের সামষ্টিক যন্ত্রণা তুলে আনেন নান্দনিক উপলব্ধির নিপুণ উপস্থাপনায়। তাঁর লেখায় ধ্বনিত হয় বিবেক কথনের অকৃত্রিম প্রতিভাষা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পাথর সিঁড়িতে সূর্যাস্ত বাসনা, অনির্বেয় আকাঙ্ক্ষায় পুড়ি, যে আগুনে মন পোড়ে, যূপকাঠে যুবক, একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, সোনালী ধানফুল, রাতভর শিমুল ফোটে, বীজঠোঁটে রক্তদ্রোণ ফুল, স্যন্দিত বরফের কান্না, প্রত্নপাথর মায়া; গল্পগ্রন্থ: মাধবী নিশীথিনী, পথে পথে রক্ত জবা, উপন্যাস: মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ, জ্যোৎস্নায় ফুল ফোটার শব্দ, কুমারীর অনন্তবাসনা, জ্যোৎস্নাবাসর, মেঘের বসন্তদিন, রূপোলী হাওয়ার রাত, একাত্তরের ভোর, তৃতীয় ছায়া। তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!