কবি ও কথাশিল্পী আবু জাফর খান নিবিড় অন্তর অনুভবে প্রত্যহ ঘটে চলা নানান ঘটনা, জীবনের গতি প্রকৃতি, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, ব্যক্তিক দহনের সামষ্টিক যন্ত্রণা তুলে আনেন নান্দনিক উপলব্ধির নিপুণ উপস্থাপনায়। তাঁর লেখায় ধ্বনিত হয় বিবেক কথনের অকৃত্রিম প্রতিভাষা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পাথর সিঁড়িতে সূর্যাস্ত বাসনা, অনির্বেয় আকাঙ্ক্ষায় পুড়ি, যে আগুনে মন পোড়ে, যূপকাঠে যুবক, একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, সোনালী ধানফুল, রাতভর শিমুল ফোটে, বীজঠোঁটে রক্তদ্রোণ ফুল, স্যন্দিত বরফের কান্না, প্রত্নপাথর মায়া; গল্পগ্রন্থ: মাধবী নিশীথিনী, পথে পথে রক্ত জবা, উপন্যাস: মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ, জ্যোৎস্নায় ফুল ফোটার শব্দ, কুমারীর অনন্তবাসনা, জ্যোৎস্নাবাসর, মেঘের বসন্তদিন, রূপোলী হাওয়ার রাত, একাত্তরের ভোর, তৃতীয় ছায়া। তিনি ১৯৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

  • যে-রঙে-রং-নেই
    আবু জাফর খান,  কবিতা,  সাহিত্য

    যে রঙে রং নেই

    যে রঙে রং নেই আবু জাফর খান   কারও কারও প্রেম থাকে কেউ কেউ প্রেমে যায় অস্থিরন্ধ্রের আর্দ্র ঢেলে তারপর বিমূর্ত শিল্পের মতো ছেঁড়া কাগজের রং… ভাসানের মৌন ফিউনারাল। শোকযাত্রার রং কখনো কালো কখনও বৈধব্যের পালক-ওড়া বকফুল; আদতে ভাসানের এইসব কিছুই থাকে না আগুনে পোড়া হাওয়ার মতো কিছু দাহ থাকে শুধু। প্রেম কখনও বাতাসে দোলা বনের আকুল অনঙ্গ প্রভার মতো বৈজু বাওরার গান; কখনও জল কখনও ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের রতিবিলাস কখনও ভিনসেন্ট ভ্যানগগের মতো খ্যাপা কিংবা পল গঁগ্যার মাওরি প্রেমিকা তহুরার আদিম নগ্নতা। প্রেম মাখে না কোনও কিছুই! জলে ভেজা বনস্থলির ছায়া ছায়া মাটির গন্ধ… থাকুক বা না থাকুক কখনও…

  • রৌদ্রডোবা-চাঁদ-শেষ-পর্ব
    আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

    রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব)

    রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব) আবু জাফর খান   দুজনই চুপচাপ বসে আছে। হয়তো একযুগ আগের কোনো উচ্ছ্বল মুহূর্তে দুজনই বিভোর। ট্রেন হুইসল বাজিয়েছে। লোকজন দ্রুতপায়ে ছুটছে ট্রেনের দিকে। বিদিতা উঠে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র কী ভাবনায় যেন মগ্ন। তাকিয়ে আছে দূরের অন্ধকারের দিকে। বোধ হয় হুইসলের শব্দ শোনেনি রুদ্র।বিদিতা চেঁচিয়ে বলল, “অ্যাই রুদ্র, কী রে, চল ওঠ, ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে যে!” অন্যমনস্ক রুদ্র মুখ ঘুরিয়ে বিদিতার দিকে তাকাল। চোখ দুটি কী ভীষণ নির্জন! বিদিতার বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। ঘোর-লাগা মানুষের মতো রুদ্র ফিসফিস করে বললো, “যদি আর না যাই? তবে কেমন হয়?” “মানে?”…

  • রৌদ্রডোবা-চাঁদ-২য়-পর্ব
    আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

    রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব)

    রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব) আবু জাফর খান   সে রাতের কথা বিদিতা কখনো কোন বন্ধুকে বলেনি। রুদ্রকে সে যতদূর চেনে, সে নিশ্চিত, রুদ্রও কাউকে কিছু বলেনি। রুদ্র-বিদিতার দূরে সরে যাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ওদের বন্ধুরা। তারা ভেবেছিল এটি সাময়িক চিড়। কেউ কেউ মধ্যস্থতা করতে এসেছিল। বিদিতা রাজি হয়নি। নাক উঁচু বলে তাকে নিয়ে বন্ধু মহলে এক ধরনের গুঞ্জন আছে। সে বরাবরই একটু জেদি টাইপের। বিদিতা ভেবেছিল রুদ্র নিজেই এসে ক্ষমা চাইবে। তাহলেই সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তা হয়নি। রুদ্র আসেনি আর। সেটি ছিল ফাইনাল ইয়ার। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ছিটকে গেল এদিক-সেদিক। কেউ কারও ঠিকানা রাখেনি। বিচ্ছিন্ন…

  • রৌদ্রডোবা-চাঁদ-১ম-পর্ব
    আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

    রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব)

    রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব) আবু জাফর খান   সুবর্ণ আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব বাজার স্টেশন ছেড়ে একটু আগে বেরিয়েছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে মিষ্টি বিকেলটির দিকে তাকিয়ে আছে বিদিতা। দূরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে কয়েকটি মেয়ে হেঁটে আসছে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় রাঙানো তাদের মুখ। খানিক বাদেই আলোটি মুছে গেল জানালা থেকে। একটি শ্বাস ফেলে ভেতরের দিকে তাকাল বিদিতা। ট্রেনটি ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পেরিয়ে গেল। বিদিতার পাশের সিট এখনো খালি। আখাউড়ায় ট্রেন দাঁড়াল বেশ কিছুক্ষণ। টিকেট এগজামিনার এলেন কামরায়। তখনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ট্রেনে উঠলেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক, সঙ্গে এক প্রৌঢ়া। ডেনিম জিন্‌স আর খয়েরি শার্টের মানুষটিকে দেখে চমকে…

  • একজন-পূজারী-ও-প্রণয়কাল
    আবু জাফর খান,  কবিতা,  সাহিত্য

    একজন পূজারী ও প্রণয়কাল

    একজন পূজারী ও প্রণয়কাল আবু জাফর খান   ধরো, নিকষ মেঘে ঢাকা বৈশাখের রাত্রি নিবিড় এই তমসায়ও কিন্তু মন খারাপ স্পষ্ট ঠাহর করা যায়। অদৃশ্যমানতাই কি নিয়তি? আমার আসলে বক্ষবর্ম বলে কিছু নেই। যোজন দূরত্ব যেখানে- তার নাম বিপুল বালিয়াড়ি; অদর্শনের নাম প্রবল খরা আমার আভূমি পাথর-পাঞ্চালে তেত্রিশ বছরের অনাবৃষ্টি। ঠিক কতদিন নিরুপায় আটকে আছে পা- আমি ভুলে গেছি সেসব; জনবিরল ইচ্ছেগুলি রোজ নিভিয়ে রাখি ধুলোর দানাগুলি চোখে করে বসে থাকি রোজ; আলোছায়াহীন মাটির পাতাল- হেডিসের হিম-প্রাসাদ আমায় টানেনি কোনদিন। দেবী, আমি কেবল তোমার সোনালি সৌকর্যের পূজারি! একদিন আপ্রাণ মেঘলা হোক অঝোর বৃষ্টি ভালোবাসার মতো শুষে নিক মাটি তোমার চিরহরিৎ…

  • নিশুতি-রাতের-সনদ
    আবু জাফর খান,  কবিতা,  সাহিত্য

    নিশুতি রাতের সনদ, রাতের ভূচিত্র

    নিশুতি রাতের সনদ আবু জাফর খান   মধ্যরাতে মুখোশ পরা কজন লোক- একটা ডেডবডি এনে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, লিখে দিন মেয়েটা সুইসাইড করেছে’। না লিখলে – কাল খবরের কাগজের শিরোনাম হবেন, ‘আততায়ীর হাতে একজন চিকিৎসকের মৃত্যু’ লিখে দিন! বিষাদ চোখে তাকালাম – মৃত মেয়েটির দিকে, জ্যোৎস্নায় ভরে গেল ঘর ভেসে গেল বুক বানভাসা জলের তোড়ে, আমার আকাশে কাজল মেঘ! লিখে দিলাম, যেভাবে লেখা হয় ভেজা শালিকের গল্প যেভাবে লেখা হয় কাতর প্রেমের কবিতা যেভাবে কফিনে পেরেক পুঁতি আমরা যেভাবে দেয়ালে তৈরি করি ক্ষত, যেভাবে নাজারেথের যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করব বলে- তৈরি করি ইতিহাস, যেভাবে অসমাপ্ত কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করেন কবি, সেভাবে…

  • রাতের-মিনার
    আবু জাফর খান,  কবিতা,  সাহিত্য

    রাতের মিনার, দূরে বাজে

    রাতের মিনার আবু জাফর খান   কখন সকাল হবে? খুব ভোরের দোয়েল আমায় ডাকে! আমি রাতের দুয়ার বন্ধ করে দিই রাতপ্রহরী হাক দেয় না আগের মতো। শালিকের ভেজা ডানায় অলীক মেঘের তাবু? আমি প্রার্থনায় থাকি অলৌকিক বিষাদ নিয়ে! না, কোনো চাঁদের দৃশ্যে লুনাটিক নই আর প্রাচীন শব্দেরা করতলে, ভিখিরি চোখ অরণ্যে যাব বলে বাতাসের তরণি বাই। ও রাত্রি, মিনার পেরিয়ে যাও! ও রাত্রি, ছোট হয়ে গৈরিক বিন্দু হও! আমার একটি ভোর, ঘাসফুলের জীবন পাক! আমার ঈশ্বর এখন উলটোডাঙার বাসক আমার ঈশ্বরের চোখে হিমরাতের তুক! THE NIGHT MINARET When it will be morning! The wagtail of the morning calls me. I…

  • কপিশ-নয়ন-শেষ-পর্ব
    আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

    কপিশ নয়ন (শেষ পর্ব)

    কপিশ নয়ন (শেষ পর্ব) আবু জাফর খান   ছয়. মধ্যরাত। কে যেন আব্দুর রহিত ব্যাপারীর সদর দরজায় কড়া নাড়ে। একবার দুবার নয়, অনবরত। ব্যাপারীর তন্দ্রামতো এসেছিল। সে উঠে বসে। রাগে বিরক্তিতে তার হাত-পা কাঁপছে। ভয়ও পেয়েছে। তার শত্রুর অভাব নেই। চারপাশে বৈরিতা। শত্রুসংকুল পরিবেশে তার বাস। সুহৃদ বলে কেউ নেই। আগে তবু আড়ালে আবডালে চলত। ইদানিং অনেকটা প্রকাশ্যেই চলে। “কে? কে কড়া নাড়ে?” রহিত ব্যাপারীর গলা কেঁপে যায়। “মামা আমি। আমি শাওন। দরজা খুলুন। প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসেছি। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। একটু তাড়াতাড়ি করুন।” শাওন গলা চড়িয়ে বলে। “এত রাতে আমাকে উদ্ধার করতে এসেছে! যতসব অপদার্থের…

  • কপিশ-নয়ন-৩য়-পর্ব
    আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

    কপিশ নয়ন (৩য় পর্ব)

    কপিশ নয়ন (৩য় পর্ব) আবু জাফর খান   পাঁচ. রুদ্র শাওনের মন ভীষণই খারাপ। সে দিনের পর দিন উপোস করে কাটিয়েছে, তবুও এত মন খারাপ হয়নি। বছর ঘুরে এল মজু মামার খোঁজ নেই। সে চরকির মতো ঘুরে ঘুরে তাঁকে খুঁজেছে। পায়নি। শাওনের মেজাজ সপ্তমে চড়তে থাকে। সে রোষে ফুঁসতে ফুঁসতে হাটে। ক্রুদ্ধ শাওনের সমস্ত কোপ আব্দুর রহিত ব্যাপারীর ওপর। সে আর একবারই স্বার্থপর লোকটির মুখোমুখি হবে। থলির বিড়াল বের করে জনসমক্ষে লোকটিকে উদোম করে দেবে। ব্যাটা লেবাসধারী কঞ্জুস। শাওনকে চেনো না তুমি। মজহাব চৌধুরীকে বাড়িতে দেখেই আব্দুর রহিত ব্যাপারীর রক্ত ফুঁসে ওঠে। এই শালা আবার কোত্থেকে উদয় হলো! নিশ্চয়ই মাগি…

  • কপিশ-নয়ন-২য়-পর্ব
    আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

    কপিশ নয়ন (২য় পর্ব)

    কপিশ নয়ন (২য় পর্ব) আবু জাফর খান তিন. মজহাব চৌধুরী ওরফে মজু মামা উচ্চ বংশীয় মানুষ। পুরুষ পরম্পরায় তাঁদের আভিজাত্য যেমন ছিল, ধন সম্পদেরও কমতি ছিল না। তাঁর বাবা ব্রিটিশ এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের আমলে পদস্থ পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি ছিলেন কর্মনিষ্ঠ অতি সজ্জন। উদারহস্ত এই পুলিশ কর্মকর্তা দু’হাতে দুঃস্থ মানুষদের দান করতেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অতি সুখের সংসার ছিল তাঁর। ছেলে-মেয়েরা অতিশয় মেধাবী। মজহাব চৌধুরী পাকিস্তান আমলে ম্যাট্রিকুলেশনে রাজশাহী বোর্ডে প্রথম হন। তিনি ইংরেজি বিষয়ে ছিলেন তুখোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরজিতে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন। তাঁর মতো একজন মানুষের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও তিনি হয়ে যান ভবঘুরে ধরনের এক…

error: Content is protected !!