-
ভেঙে পড়া শব্দের রং
ভেঙে পড়া শব্দের রং আবু জাফর খান এই যে আমি বেঁচে আছি অনন্ত জীবন ধরে ঘুরছি অরণ্যের ছায়াপথে উড়তে উড়তে ছুঁয়ে ফেলি আকাশ এবং একদা নিজেই ধূসর নক্ষত্রের পথ ধরে হেঁটে যাই, এই-ই কি জীবনের গল্প? ধুলো ওড়ে ধূলোরা উড়তে উড়তে একটি ঘূর্ণি তৈরি করে সন্ধ্যার শাঁখ বাজে বনের গহ্বরে পায়ের তলায় ঘাসেদের স্নানজল, বাল্মীকির বিমূর্ত সভ্যতা; এইসব শাপ কেন দুহাতে আমার! বনের পথে শালের ধূপ মাহুল লতা জড়ানো সেগুনের শরীর ডালপালা ডুবে গেলে নিঃস্ব হয়ে যায় গাছ: আমি গাছের নিঃস্বতা নিয়ে এত পথ হেঁটেছি… শুধু কথা ও রোদের ঠোঁটে গোপন চুমুর বাসনা জড়িয়ে, অথচ তুমি আদিকালের বিলীন মাঠে পতিত…
-
প্রেম ও নির্জনতা
প্রেম ও নির্জনতা আবু জাফর খান কত আর তাঁবু পালটানো যায়? চোখের ভেতর রৌদ্র পোড়ে, সুর মেলাতে পারি না ডাহুক ওড়ে যন্ত্রের মতো স্বপ্ন টলে; আমি এতকাল নির্জন খুঁজে… শমেশ্বরীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে না পেয়েছি ওমের জল না জোনাকির বাতিঘর। আঙুলের ভাঁজে শূন্যতার শোক আমাকেই দেখে! না বিপুল তুষার না তেতে ওঠা আগুন, কিচ্ছু নেই বারবার শরণার্থী হতে গিয়ে পুড়ে গেছে ঠোঁটের ঘ্রাণ, হারিয়েছি পাতার শরীর; হিম ডিঙিয়ে অগ্নি-আতশের দিকে দীর্ঘ সফর আসলে… জলের ভেতরে জমে ওঠা অন্ধকার ছাড়া কিছু নয়। জানালার রৌদ্রালোক ধীর হতে ধীরে… ঘন হয় যখন, আমরা বিভাজন করি বিকেল-সন্ধ্যা, কিংবা পাহাড়ের গা বেয়ে রোদ…
-
মাধবী নিশীথিনী (শেষ পর্ব)
মাধবী নিশীথিনী (শেষ পর্ব) আবু জাফর খান কুপির আবছা আলোয় দেখে, কুচকুচে কালো কারুকার্যময় পালঙ্কে রক্তিম মখমলের বিছানায় শায়িত এক নারী। গোটা শরীর ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা। শুধু মুখ অনাবৃত। যেন একটি মমের শব। গোটা মুখে হীরকের ঔজ্জ্বল্য। যেন মমির দেশের কোনো রাণীকে মমি করে রাখা হয়েছে। শাওনের ছুটে পালানোর কথা। কিন্তু সে সম্মোহিতের মতো পালঙ্কের দিকে এগিয়ে যায়। তার দৃষ্টি শবের মুখমণ্ডলে নিবদ্ধ। দৃষ্টি ফেরানোর ক্ষমতা যেন হারিয়ে গেছে। ভীষণ চেনা এই মুখ, বড় আপন! কে ইনি? “শাওন, এসেছিস?” শবের ঠোঁট মৃদু নড়ে ওঠে। তিনি অতি ক্ষীণ স্বরে ফিসফিস করে বলেন। রুদ্র শাওন কেঁপে ওঠে। ছিটকে সরে যায়।…
-
মাধবী নিশীথিনী (১ম পর্ব)
মাধবী নিশীথিনী (১ম পর্ব) আবু জাফর খান ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না? কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না? ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে॥’ সত্তর দশকের গোড়ার কথা। রুদ্র শাওন গুনগুন করতে করতে হনহন করে হাঁটছে। তার হাঁটার গতি দেখে যে কেউ বলবে, কোনো জরুরি কাজে বহুদূর পথ পেরবে। অবিশ্যি যারা চেনে, তারা বলবে না। দৈবাৎ দেখা হলে বরং পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে। রুদ্র শাওন খান পরিবারের একমাত্র বংশধর। এই তরুণ যুবক যে বদ্ধ পাগল, তাতে ঐ তল্লাটের কারও বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। রুদ্র শাওন…
-
যে রঙে রং নেই
যে রঙে রং নেই আবু জাফর খান কারও কারও প্রেম থাকে কেউ কেউ প্রেমে যায় অস্থিরন্ধ্রের আর্দ্র ঢেলে তারপর বিমূর্ত শিল্পের মতো ছেঁড়া কাগজের রং… ভাসানের মৌন ফিউনারাল। শোকযাত্রার রং কখনো কালো কখনও বৈধব্যের পালক-ওড়া বকফুল; আদতে ভাসানের এইসব কিছুই থাকে না আগুনে পোড়া হাওয়ার মতো কিছু দাহ থাকে শুধু। প্রেম কখনও বাতাসে দোলা বনের আকুল অনঙ্গ প্রভার মতো বৈজু বাওরার গান; কখনও জল কখনও ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের রতিবিলাস কখনও ভিনসেন্ট ভ্যানগগের মতো খ্যাপা কিংবা পল গঁগ্যার মাওরি প্রেমিকা তহুরার আদিম নগ্নতা। প্রেম মাখে না কোনও কিছুই! জলে ভেজা বনস্থলির ছায়া ছায়া মাটির গন্ধ… থাকুক বা না থাকুক কখনও…
-
রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব)
রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব) আবু জাফর খান দুজনই চুপচাপ বসে আছে। হয়তো একযুগ আগের কোনো উচ্ছ্বল মুহূর্তে দুজনই বিভোর। ট্রেন হুইসল বাজিয়েছে। লোকজন দ্রুতপায়ে ছুটছে ট্রেনের দিকে। বিদিতা উঠে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র কী ভাবনায় যেন মগ্ন। তাকিয়ে আছে দূরের অন্ধকারের দিকে। বোধ হয় হুইসলের শব্দ শোনেনি রুদ্র।বিদিতা চেঁচিয়ে বলল, “অ্যাই রুদ্র, কী রে, চল ওঠ, ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে যে!” অন্যমনস্ক রুদ্র মুখ ঘুরিয়ে বিদিতার দিকে তাকাল। চোখ দুটি কী ভীষণ নির্জন! বিদিতার বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। ঘোর-লাগা মানুষের মতো রুদ্র ফিসফিস করে বললো, “যদি আর না যাই? তবে কেমন হয়?” “মানে?”…
-
রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব)
রৌদ্রডোবা চাঁদ (২য় পর্ব) আবু জাফর খান সে রাতের কথা বিদিতা কখনো কোন বন্ধুকে বলেনি। রুদ্রকে সে যতদূর চেনে, সে নিশ্চিত, রুদ্রও কাউকে কিছু বলেনি। রুদ্র-বিদিতার দূরে সরে যাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ওদের বন্ধুরা। তারা ভেবেছিল এটি সাময়িক চিড়। কেউ কেউ মধ্যস্থতা করতে এসেছিল। বিদিতা রাজি হয়নি। নাক উঁচু বলে তাকে নিয়ে বন্ধু মহলে এক ধরনের গুঞ্জন আছে। সে বরাবরই একটু জেদি টাইপের। বিদিতা ভেবেছিল রুদ্র নিজেই এসে ক্ষমা চাইবে। তাহলেই সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তা হয়নি। রুদ্র আসেনি আর। সেটি ছিল ফাইনাল ইয়ার। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ছিটকে গেল এদিক-সেদিক। কেউ কারও ঠিকানা রাখেনি। বিচ্ছিন্ন…
-
রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব)
রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব) আবু জাফর খান সুবর্ণ আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব বাজার স্টেশন ছেড়ে একটু আগে বেরিয়েছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে মিষ্টি বিকেলটির দিকে তাকিয়ে আছে বিদিতা। দূরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে কয়েকটি মেয়ে হেঁটে আসছে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় রাঙানো তাদের মুখ। খানিক বাদেই আলোটি মুছে গেল জানালা থেকে। একটি শ্বাস ফেলে ভেতরের দিকে তাকাল বিদিতা। ট্রেনটি ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পেরিয়ে গেল। বিদিতার পাশের সিট এখনো খালি। আখাউড়ায় ট্রেন দাঁড়াল বেশ কিছুক্ষণ। টিকেট এগজামিনার এলেন কামরায়। তখনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ট্রেনে উঠলেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক, সঙ্গে এক প্রৌঢ়া। ডেনিম জিন্স আর খয়েরি শার্টের মানুষটিকে দেখে চমকে…
-
একজন পূজারী ও প্রণয়কাল
একজন পূজারী ও প্রণয়কাল আবু জাফর খান ধরো, নিকষ মেঘে ঢাকা বৈশাখের রাত্রি নিবিড় এই তমসায়ও কিন্তু মন খারাপ স্পষ্ট ঠাহর করা যায়। অদৃশ্যমানতাই কি নিয়তি? আমার আসলে বক্ষবর্ম বলে কিছু নেই। যোজন দূরত্ব যেখানে- তার নাম বিপুল বালিয়াড়ি; অদর্শনের নাম প্রবল খরা আমার আভূমি পাথর-পাঞ্চালে তেত্রিশ বছরের অনাবৃষ্টি। ঠিক কতদিন নিরুপায় আটকে আছে পা- আমি ভুলে গেছি সেসব; জনবিরল ইচ্ছেগুলি রোজ নিভিয়ে রাখি ধুলোর দানাগুলি চোখে করে বসে থাকি রোজ; আলোছায়াহীন মাটির পাতাল- হেডিসের হিম-প্রাসাদ আমায় টানেনি কোনদিন। দেবী, আমি কেবল তোমার সোনালি সৌকর্যের পূজারি! একদিন আপ্রাণ মেঘলা হোক অঝোর বৃষ্টি ভালোবাসার মতো শুষে নিক মাটি তোমার চিরহরিৎ…
-
নিশুতি রাতের সনদ, রাতের ভূচিত্র
নিশুতি রাতের সনদ আবু জাফর খান মধ্যরাতে মুখোশ পরা কজন লোক- একটা ডেডবডি এনে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, লিখে দিন মেয়েটা সুইসাইড করেছে’। না লিখলে – কাল খবরের কাগজের শিরোনাম হবেন, ‘আততায়ীর হাতে একজন চিকিৎসকের মৃত্যু’ লিখে দিন! বিষাদ চোখে তাকালাম – মৃত মেয়েটির দিকে, জ্যোৎস্নায় ভরে গেল ঘর ভেসে গেল বুক বানভাসা জলের তোড়ে, আমার আকাশে কাজল মেঘ! লিখে দিলাম, যেভাবে লেখা হয় ভেজা শালিকের গল্প যেভাবে লেখা হয় কাতর প্রেমের কবিতা যেভাবে কফিনে পেরেক পুঁতি আমরা যেভাবে দেয়ালে তৈরি করি ক্ষত, যেভাবে নাজারেথের যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করব বলে- তৈরি করি ইতিহাস, যেভাবে অসমাপ্ত কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করেন কবি, সেভাবে…