প্রবন্ধ,  মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত (প্রবন্ধ),  সাহিত্য

ভাষা নিয়ে ভাবনা

ভাষা নিয়ে ভাবনা

ভাষা-নিয়ে-ভাবনা
অধ্যক্ষ মো. আব্দুল বাছেত
সাতবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, সুজানগর, পাবনা।

(ক).
দিবস নিয়ে আমাদের ভীষণ দূর্বলতা। কিন্তু সেই দিবসের তাৎপর্য , উপলব্ধি প্রাত্যহিক জীবনে প্রলম্বিত নয় বরং সূর্যাস্তেই তার পরিসমাপ্তি। অতঃপর নতুন দিবস, নতুন আয়োজন। একই অতিথি-বক্তা , আর শ্রোতা-দর্শক আগেরই।  প্রায়শ মঞ্চও একই থাকে। এক্ষেত্রে দেশের প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরাও  সেই দিবস নিয়ে বক্তব্য দেন, লেখালেখি করেন ঐ একদিনই। অতঃপর নতুন দিবস।

মহান একুশের একুশ উৎসব হলো। কত আয়োজন। প্রভাত ফেরি , পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনেকে  অনেক আগে কলাম লিখে রেখেছেন পত্রিকায় চাপাবেন, বক্তব্য রপ্ত করছেন, রাজনীতিবিদগণ ভাষা শহীদদের শোকে ও শ্রদ্ধায় কাতর হলেন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্বাচনেচ্ছুরা পোস্টার-ব্যানার বানিয়ে গাছে, ডালে, চালে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সে সবেও প্রচুর বানান বিভ্রাট!

আমাদের জাতি সত্ত্বা উন্মেষ, বিকাশ ও বৈশ্বিক বিস্তৃতির শেকড়ে আমাদের বাংলা ভাষা। আমার বর্ণমালা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে কোল দ্রাবিড়ের অপভ্রংশ হয়ে সংস্কৃত,  প্রাকৃত, মাগধি প্রাকৃত, অনার্য, শত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ একটা পরিপুষ্টতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষা। এ ভাষার রয়েছে আড়ম্বড়পূর্ণ ইতিহাস। পৃথিবীতে একটি মাত্র ভাষাশ্রেণির মানুষ বাঙালি, যারা তার মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রেরর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বুকে গুলি পেতে  মুখের বুলিকে সুসংহত করার প্রয়াসে আত্মাহুতি দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার  অনন্য এবং অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আরও পড়ুন বইমেলা ও সরদার জয়েনউদ্দীন

মাতৃভাষা নিয়ে ১৯৬১ সালে আসামের শিলচর, ১৯৭২ সালে করিমগঞ্জসহ বিচ্ছিন্ন ভাবে আন্দোলন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, মানুষ মরেছে। শুধু আমরাই – বাঙালিরা ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছি এবং জয়ী হয়েছি। ভাষার প্রতি ভালোবাসায় আমরা অদ্বিতীয়। সেই ১৯৫২’র মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে যদি আমরা জয়ী হতে না পারতাম, তাহলে আমাদের স্বাধীকার, স্বায়ত্বশাসন, লাল সবুজ পতাকা, আমাদের সার্বভৌমত্ব সকলই  অধরাই থেকে যেত।  সুতরাং ১৯৭১ এর জননী ১৯৫২। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি প্রীতি আমাদের সামান্যই। এখনো ষোল আনা বাঙালিয়ানা হতে পারিনি। শিক্ষা সংস্কৃতিতে নিত্য বিদেশি প্রভাব। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের শিক্ষকতার নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা ,পঁচাত্তর শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না এমনকি অনেক শিক্ষকও। অথচ আমার মাত্র ৪৯টি রক্তস্নাত প্রিয় দুঃখিনী  বর্ণমালা!

বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য কত কসরৎ। ইংলিশ গ্রামার শেখার জন্য, ভাষা শেখার জন্য, ইংরেজিতে কথা বলতে পারার জন্য কোচিং, প্রাইভেট গৃহশিক্ষক রাখি অথচ বাংলা ব্যাকরণ জানার , শুদ্ধ বানানে লেখার ন্যূনতম আগ্রহ নেই।

আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমার বাংলা বিভাগীয় প্রধান ও তৎপরবর্তী উপাচার্য ড. আব্দুল খালেক স্যারের এক সেমিনারে শ্রোতা ছিলাম। স্যার বললেন, “যদি কোন শিক্ষার্থী বাংলায় শুদ্ধভাবে চাকরির আবেদন করতে পারে,  তাহলে আমি নিশ্চিত তার চাকরি হবেই।”
তাঁর কথা কতখানি সত্য ইদানিং উপলব্ধি করি। বিজ্ঞানের ছাত্র , ইতিহাসের ছাত্র বাংলা বানান ভুল তো হবেই। বাহ্ কী আবদার! তুমি বাঙালি নও? এ ভাষা তোমার নয়? ইংলিশ বানান মুখস্থ করো, আর রক্তে কেনা ভাষা অশুদ্ধ বলো, লেখো। ধীক!

কবি আবদুল হাকিমের  দ্রোহের বাণী-

“যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”

আরও পড়ুন  গ্রন্থাগার আইন

ভালো ভাষাকে ভালবাসা। আমার বাংলা ভাষা ভালো ভাষা। বাংলা ভাষারও কৌলিন্য আছে। রস আছে। সে রসের  আস্বাদ উপভোগ করতে হবে। কি নেই বাংলার ভাষা ও সাহিত্যে? এ ভাষার প্রাচীন সাহিত্যিক নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ আছে। বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ মঙ্গল কাব্য গ্রন্থ, দৌলত উজির বাহরাম খানের  ‘লাইলি মজনু’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ আছে। এগুলো বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যের আদি রসাত্মক সাহিত্য।

পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক ভাষা ছিল। সে সব ভাষা প্রভাবশালী ভাষার চাপে অথবা বিশ্বমানের  সাহিত্য চর্চা করতে না পারার কারণে অনেকই বিলুপ্ত প্রায়। আর বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেট বিশ্বমানের। আমাদের রয়েছে বিশ্বমানের  মহাকাব্য। মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃত্তসংহার,যোগীন্দ্রনাথের ‘পৃথ্বীরাজ’ ‘শিবানী’, মানকুমারীর ‘বীর কুমার বধ’, কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’। মধুসূদনের প্রহসন নাটক ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ কালজয়ী সাহিত্য। বাংলা উপন্যাসের অমিত সম্ভারকে নিয়ে গর্ব করা যায়।

এ ভাষায় প্রথম উপন্যাস প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ ‘আনন্দ মঠ’ ‘ কৃষ্ণকান্তের উইল’, শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ ‘বিরাজ বৌ’ ‘দেনাপাওনা’  ‘শ্রীকান্ত।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ ‘ঘরে বাইরে’ এবং মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘গোরা’ সহ কাব্যধর্মী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ অনন্য, অসাধারণ ও স্বার্থক।

আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা

অনেকেরই অজানা যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তারা শংকরের ‘কবি’ বনফুলের ‘রাত্রি’ মহৎ সৃষ্টির পর্যায়ে উন্নীত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আকাশচুম্বি স্বার্থক উপন্যাস।
বাংলা ভাষার ছোট গল্প আমাদের অহংকার। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছোট গল্পের পথপ্রদর্শক ও শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা। প্রমথ চৌধুরীর ‘চার ইয়ারী কথা’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ঘনাদার গল্প’, শরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশের ডায়েরী’, কবি গুরুর  ‘নষ্টনীড়’ ‘চতুরঙ্গ’ ‘পোস্ট মাস্টার। যাক, এ বিষয়ে বিস্তারিত না বলে  আমাদের ভাষার ঐতিহ্য ও আভিজাত্য সম্পর্কে এটুকু বললেই হৃদয়ঙ্গম হয় যে,বর্তমানে বিদেশি ভাষাভাষীরাও  রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছেন।

১৯১৩ সালে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থ রচনা করে নোবেলজয়ী হন এবং এই কাব্যগ্রন্থটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
আমাদের সহজিয়া গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি,  জারি-সারি, লালন, হাছন , পালা গান, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান যে কী অমিত সম্ভার তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারিনি বলেই  এবং নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়েছি বলেই আজ একদিনের বাঙালি আমরা ।
যেন সেই গানের কথা ” একদিন বাঙালি ছিলাম রে।”
একদিন সকালে পান্তা ইলিশ খেয়ে বাঙালি।
একদিন স্বাধীনতা দিবস
একদিনই বিজয় দিবস
একদিনই ভালোবাসা দিবস
মা দিবস, নারী দিবস, শ্রম দিবস, কন্যা দিবস, শিক্ষক দিবস।
ভাষা শহীদ দিবস একদিন কিন্তু সেই দিবসের তাৎপর্য, মাহাত্ম্য, আদর্শ এবং আবেদন প্রাত্যহিক। নিত্য তার চর্চা,  সর্বস্তরে প্রয়োগের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের প্রয়াস হোক আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যয়।

আরও প্রবন্ধ সমকালীন ভাবনা

বিচার প্রার্থী বা আসামি কেউ বোঝে না কি রায় হলো। উকিল, মুন্সী বুঝিয়ে দেন। অথচ রায়টি বাংলায় লিখলে ও পড়লে আইন প্রয়োগে কতটা ব্যত্যয় হতো  জানি না, তবে এটা রক্তস্নাত দুঃখিনী বর্ণমালার প্রতি অবজ্ঞা, শহীদদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অপমান এবং জাতি সত্ত্বার প্রতি ঊন্নাসিকতা। অথচ  আমার ভাষায়  বিশ্বে ত্রিশ কোটি মানুষ কথা বলে। নিত্য ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান চতুর্থতম। কত গর্ব  আমাদের  ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ – ইউনেস্কো প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারি কে “আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস”হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০২০ সাল থেকে   জাতি সংঘের সদস্য দেশগুলো “জাতি সংঘের দাপ্তরিক ভাষা” হিসেবে  ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দিনে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
আমার বাংলা ভাষাকে ভালবাসা,
আমার বাংলাদেশেকে ভালবাসা,
আমাদের অস্তিত্বে আস্থারাখা এবং  ন্যূনপক্ষে বারো আনা বাঙালিয়ানা – হোক মহান একুশের অঙ্গীকার।

(খ).
শুনতে পাই পৃথিবীতে  আঠারো হাজার সৃষ্ট জীব। স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা  মানুষ।  শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ  এবং জৈবিকতার  বহু রকমের মিল বিভিন্ন প্রজাতির জীবের সঙ্গে  রয়েছে মানুষের। আমিলও  আছে। সম্ভব পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ চিৎ হয়ে ঘুমায়, সশব্দে হাসে, সুখ ও দুঃখের অনুভূতি বহুমাত্রিক ভঙ্গিতে  অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারে। একমাত্র মানুষই জেগে- ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। সৃষ্টিশীল চিন্তন শক্তি আছে, মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার সম্পন্ন প্রাণি মানুষই। কিন্তু জীবজগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের শ্রেষ্ঠ প্রামানিক ও অনন্য নিদর্শন তার বাচনিক সক্ষমতা- ভাষা। অন্যান্য প্রাণীর বাকযন্ত্র থাকলেও বাগার্থ নেই । শুধুমাত্র মানুষ অর্থবহ ধ্বনি সহযোগে  অন্তরের গভীরের অনূভবকেও  বাহিরের কাছে প্রকাশ করতে পারে। অর্থাৎ একমাত্র মানুষেরই আছে ভাব প্রকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যমে ভাষা।

আরও পড়ুন  গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার

পবিত্র কোরআনে সূরা  ‘ আর রহমান ‘ এর তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “খ্বলাক্বল ঈনছান : য়াল্লামাহুল বাঈয়ান ” ( সৃষ্টি করেছেন মানুষ : তাদের দিয়েছেন বাচনিক শিক্ষা)।
অর্থাৎ  মানুষের ভাব ও ভাবনা প্রকাশে  বাকযন্ত্রের মাধ্যমে মুখনিঃসৃত অর্থবহ  ধ্বনি উচ্চারণে মানুষের সক্ষমতা  স্রষ্টার বিশেষ অনুকম্পা যা কেবলই মানুষকে বিশেষত্ব দান করেছে, শ্রেষ্ঠ করেছে, মহামান্বিত করেছে। তাই শুধু মানবিক ও পাশবিক  বৃত্তিতে ও আঙ্গিক ভিন্নতায় নয় বরং ভাষার জন্য,  বাচনিক সক্ষমতার জন্যই মানুষ বিশেষ, অন্যেরা নির্বিশেষ। একজন মানুষ, যে মূক – শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ কিন্তু যার বাকযন্ত্র নিষ্ক্রিয় তার জীবনের মূল্য কি? তাহলে কথার কত দাম! অথচ আমরা রক্তে কেনা ভাষাকে কতটুকু মর্যাদাবান করার প্রয়াস পাই?

বাংলাদেশে বহু উপজাতিদের বাস। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। তাদের ভাষা স্থানিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ। এদের মধ্যে কোনো কোনো ভাষার  নিজস্ব বর্ণমালাও রয়েছে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ও বিকাশের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি বলে এবং সাহিত্যে প্রয়োগ উপেক্ষিত হয়েছে বলে সে সকল ভাষাসম্পদ বিলুপ্ত প্রায়। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে ভাষার প্রায়গিক ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের  বোধ ও অভ্যাস, পরম্পরা লালন , কিছু ক্ষেত্রে মাটি ও জলবায়ুর ভিন্ন বৈশিষ্টের কারনে এবং তজ্জন্য দৈহিক গঠনরুপের কিছুটা ভিন্নতা  বিধায় আঞ্চলিক ভাষার শাব্দিক ব্যবহার ,উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যরুপও আলাদা।

এই ভিন্ন স্বাদের কথামালায় সাহিত্য চর্চা হতে পারে কিন্তু সেই সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চান না উঁচু দরের সাহিত্যিকেরা কারন পাঠক মহলে কাটতি কম হবার আশংকা! কিন্তু আমার মনে হয় তাঁরা এক আধবার ঝুঁকি নিতে পারেন এবং তাঁদের শঙ্কা- সফলতায় পরিনত হতে পারে। গ্রামীণ জনজীবন সমাজ ও সংস্কৃতি সাহিত্যের উপজীব্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় বলে মনে করতেন প্রমথ চৌধুরী। নাকি বর্তমান লেখকেরাও ভূগছেন বীরবলী উন্নাসিকতায়?

আরও পড়ুন একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত আইনী সংশোধনী

অলংকার  শিল্পীরা খাঁটি সোনার সাথে খাদ মিশিয়ে অনেক উঁচু দরের আকর্ষনীয় অলংকার তৈরি করেন। তা সাহিত্যেও সম্ভব। আমাদের নিত্য গ্রামীণ জনজীবন- জীবনাচার ,দৈনন্দিন অভ্যাস ও সংস্কৃতি নিয়েও সাহিত্য চর্চা সম্ভব। তাতে বাংলা লৌকিক ভাষাশ্বৈর্যের সমৃদ্ধি ঘটে এবং শ্রীবৃদ্ধি হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাতৃভাষার প্রতি অপ্রীতি ও অবজ্ঞা ছিল একসময় (কাব্য লক্ষী স্বপ্নে আদেশ করে ফিরিয়ে এনেছেন স্বদেশী ভাষায়)! স্বার্থক বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ধর্মীয় পক্ষপাত প্রদর্শন করেছেন সাহিত্যে, প্রমথ চৌধুরী উন্নাসিকতা প্রকাশ করেছেন গ্রামীণ জীবন চরিত নিয়ে। অথচ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের “নক্সী  কাঁথার মাঠ”, সোজন বাদিয়ার ঘাট”  কী অনন্য উচ্চতায় আসীন! তাঁর কবর  কবিতায়-

“এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনা মুখ
নাওয়ায়ে চোখের জলে–“

পাঠকের চোখে জল এনে দেয়। আমাদের গ্রামীণ জনজীবনের নিত্য ব্যবহার্য আথাল, মাথাল,গোয়াল,  ডানকানা মাছ ,এমনকি সামান্য ‘ঘুটে’কেও তিনি অসামান্য করে তুলেছেন কবিতায়। আমাদের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় নাটক “নূরুল দীনের সারা জীবন” আঞ্চলিকতার প্রভাবকে অতিক্রম করে নন্দিত সাহিত্যিক আবেদন অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আর ঐ  একটি আহ্বান, একটি স্লোগান
“কোনঠে বাহে জাগো সবায়…এটি শুধু সংলাপ নয়, একটি আন্দোলনের মশাল , একটি ইতিহাস। আর তাঁর  “পরানের গহীন ভিতর”  কবিতা গুচ্ছ আঞ্চলিক শব্দ অনবদ্য ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আরও পড়ুন কামাল লোহানীর বিপ্লব মন্ত্রের প্রথম পাঠশালা

নাট্য সাহিত্যের বরপুত্র সেলিম আল দীন  “হাত সদাই” তে ব্যবহার করেছেন গ্রামীণ শব্দ সম্ভার কিন্তু তা স্বার্থকতার কতক্ষানি উচ্চতায় অধিষ্ঠিত যে মঞ্চায়নে বহু দর্শক উপস্থিতিই প্রমান করে।
এছাড়াও  আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের” চিলে কোঠার সেপাই” ও “খোয়াব নামা” বগুড়ার স্থানিয় ভাষায় অনন্য সৃষ্টি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধ্রুপদী উপন্যাস ” লালসালু-“র উক্তি-আপনারা জাহেল, বেআলেম, আনপাড়াহ্ , একটা মোদাচ্ছির পীরের মাজার এভাবে ফেলি রাখছেন?” এই  একটা বাক্যই ধর্মাশ্রয়ী সমাজের চরিত্র উন্মোচন করে। মজিদ, খালেক ব্যাপারী, হাসুনির মা, রহিমা আমেনা চরিত্রগুলো  বাংলার গ্রাম্য এবং আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষার শব্দ উচ্চারণ করলেও তা আর্ন্তজাতিক সাহিত্য হিসেবে নন্দিত। লালসালু  উপন্যাস  ১৯৬৭ সালে ইংরেজি ভাষায় এবং কলিমুল্লাহ উর্দু ভাষায়, আ্যান-মারি-থিবো ফরাসি ভাষায় অনূবাদ  করেছেন। বলা বাঞ্ছনীয়, ১৯৬১ সালে  মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পান।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ” পদ্মা নদীর মাঝি” গ্রামীণ ধীবর শ্রেণির মানুষের  জীবন গাঁথা নিয়ে রচিত  বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। –নুকূল্যা কি লো হারামজাদি,  জ্যাঠা কইবার পার না’
বাবা নিজের মেয়েকে এভাবে ভদ্রতা শেখানোর দৃষ্টান্ত জেলে পল্লীতেই চলে। কারণ “ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্রপল্লীতে  জেলে পাড়ায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না!” ১৯৬৩ সালে প্রকাশ হওয়ার পর এ উপন্যাস ভারতের একাধিক প্রাদেশিক ভাষাসহ ইংরেজি, চেক,হাঙ্গেরিয়ান, লিথুয়ানিয়ান, সুইডিশ, রুশ, নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ তথ্য সেবা ও তথ্য অধিকার আইন

তারা শংকরের ‘হাঁসুলী  বাঁকের ইতিকথা’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘কাশ বনের কন্যা’ ও ‘সমূদ্র বাসর’,  হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’ পুরোটাই খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা।
তাহলে বর্তমানে কেন এমন স্বার্থক সাহিত্য আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হচ্ছে না? ঔপনিবেশিকতার প্রভাব? ঠিক তাই। আমরা  শেকড়ের, রক্ত এবং অস্তিত্বের বন্ধনকে ছিন্ন করার বহুধা  ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থাপন করেছি।আমরা যে বাঙালি! উফ্,গাঁও-গেরাম ? কী লজ্জা!  কী লজ্জা! আমাদের নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী জেলার আঞ্চলিক ভাষা তো ঐ জেলা বাসীর কাছে মাতৃস্তন স্বরুপ।

আমাদের  বাংলা ভাষার প্রানৈশ্বর্য বিভিন্ন অঞ্চলের আদিশব্দ, গ্রামাঞ্চলের লেখাপড়া না জানা মানুষের নিত্য ব্যবহৃত শব্দ, পথকবি-লোক কবিদের হৃদয়ের স্পন্দন ঐ শব্দ সম্ভারেই অর্ন্তলীন। ইংরেজি অর্থনৈতিক ভাষা ও বিশ্ব যোগাযোগের ভাষা আর বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা , অস্তিত্বের ভাষা। তাই বৈচিত্র্যময় আমাদের ভাষার সকল রুপবৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের বিদগ্ধ সাহিত্যিকদের, লেখকদের
এবং বাংলা একাডেমীর।  নইলে   সংস্কৃত ভাষার মতো বাংলাও  বৈচিত্র্য সংকটে পড়ার আশঙ্কামুক্ত থাকবে না বলে মনে করি। যে দেশের আশি শতাংশ মানুষের জন্ম গ্রামে এবং তাদের পিতামহদের  পঁচাত্তর শতাংশ   এবং  পিতা-মাতার ন্যূনপক্ষে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি তাদের উত্তরসূরী যদি ভাদাল, বোহরি, ভাট্যেলা, তপন, সাঁজাল, না চেনে তাহলে  কাকের কোকিল হবার শখ বৈ নয়। অন্যথা  এই আত্মপ্রবঞ্চনার অন্য নাম – রুচির দূর্ভিক্ষ!

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

ভাষা নিয়ে ভাবনা

Facebook Comments Box

অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারিতে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের মালিফা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।   তাঁর লেখায় চলমান জীবনের বাস্তবতা এবং গ্রামীণ জীবন চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। গ্রামের প্রাচীন শব্দ সম্ভারকে পূনুরুদ্ধার ও  লেখায় সংরক্ষণ করার চেষ্টারত আছেন।

error: Content is protected !!