বড় বাবা (৩য় পর্ব)
বড় বাবা (৩য় পর্ব)
শাহানাজ মিজান
অলিদ থতমত খেয়ে বললো ,
__না, মানে তোর বাবা যে রাগি মানুষ, আমি তো খুব ভয় পাই। আর তুইও তো এখনো দিপাকে কিছু বলিসনি। তাই বলছিলাম আর কি…
__হুম দিপাকে কালই বলবো।
ছাত্রছাত্রীরা একে একে সবাই বের হয়ে যাওয়ার পরে, দিপা বই খাতা গোছাচ্ছিলো। এ সময় রিফাত এসে বললো,
__দিপা তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।
দিপা মাথা নিচু করে, সবকিছু গোছাতে গোছাতেই বললো,
__আমি জানি আপনি কি বলবেন। কিন্তু…..
দিপাকে থামিয়ে দিয়ে রিফাত বললো,
__প্লিজ, দিপা। কথা বলার আগেই, কথার মাঝখানে কিন্তু বসিয়ে দিও না।
__কি করবো বলুন? কিন্তু যে বসাতেই হবে স্যার। কারণ ঐ কিন্তুটাই হলো আপনার আর আমার মধ্যে সবচেয়ে বড় দেয়াল। যা টপকানো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমার কাছে আপনি হলেন ঐ সীমাহীন আকাশের চাঁদ। চাঁদের আলো যতটুকু পৃথিবীর মাটিকে আলোকিত করে, আমি ততটুকুতেই খুশি। চাঁদ ধরার মতো দূঃসাহস দেখাতে চাই না….
__তাই বুঝি ! তাহলে তুমিতো এটাও জানো যে, চাঁদ আকাশে থাকলেও সে শুধু আকাশকে আলোকিত করার জন্য আলো ছড়ায় না। পৃথিবীকে আলোকিত করার মধ্যেই তার সার্থকতা….
দিপার চোখে পানি টলমল করছে। সে চোখ মুছে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
__সেটা তো চাদেঁর কথা। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের ভাঙা ঘরে চাদেঁর আলো আসে, সেটা আমরা দেখতে পারি কিন্তু তাকে ছুঁতে পারি না।
__আমি এতো কিছু শুনতে চাই না, বুঝতেও চাই না। আমি শুধু জানি আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। দিপা, আমি শুধু তোমার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই যে তুমি আমাকে ভালোবাস….
দিপা মুখে কিছু বলছে না। ওর চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝড়ছে। রিফাত দিপার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
__তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সব বুঝতে পেরেছি। তুমি যদি আমাকে ভালো না বাসতে, তাহলে তোমার চোখে অকারণে বর্ষা নামতো না।
দিপা লজ্জা পেয়ে চলে গেল।
আরও পড়ুন এ কে আজাদ দুলাল রচিত গল্প লালু
তারপর কি থেকে কি হয়ে গেল। বড় বাবাকে কিছু বলা হলো না অথচ গ্রামে এতোসব কথা রটে গেল। রিফাতের সমস্ত রাগ ফিরোজ মেম্বার আর ওর বাবার উপর। বাবাকে সে এমনিতেই বাবা বলে ডাকে না, সামনা-সামনি দেখা হলেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর ফিরোজ মেম্বারকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বড় বাবা, একজন সৎ সাহসী ও বিচক্ষন মানুষ। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনিই সবার বড়। নিজ গ্রাম এবং আশেপাশের দু- চার- দশ গ্রামের মানুষ তাকে খুব ভালোবাসে, সম্মান করে। তাইতো তিনি একবার নয়, বর্তমানে তিন মেয়াদ আছেন চেয়ারম্যান পদে।
তিনি দেশে বা দেশের বাইরে যেখানেই থাকেন না কেন, কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সব খবর তার জানা। তাইতো তিনি কাউকে কোনো খবর না দিয়েই দেশে ফিরেছেন। নিজ গ্রামে ঢোকার সাথে সাথে তার পিছনে অনেক মানুষ।
রিফাত তার কোচিং এর ঘরেই ছিলো। কিন্তু বড় বাবা যে বাড়িতে এসেছেন, তার কিছুই সে বুঝতে পারেনি। বড় বাবা কোচিং এর ঘরে গেলেন, রিফাত তখন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।
হঠাৎ করে বড় বাবাকে দেখে তাড়াতাড়ি আধাপোড়া সিগারেটটা পায়ের নিচে ফেলে চাপা দিলো। বড় বাবা সেদিকে না দেখে রিফাতের মুখের দিকে তাকালেন। ছেলের এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। তিনি রিফাতকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রিফাতও এতোদিন পরে বড় বাবাকে কাছে পেয়ে, ছোট বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো।
আরও পড়ুন শফিক নহোর রচিত গল্প বিষফুল
পরেরদিন সকাল দশটা। উঠোনে পারিবারিক মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। পরিবারের সবাই ছাড়াও বেশ কয়েকজন প্রতিবেশি উপস্থিত আছে। পাশাপাশি চেয়ারগুলোয় সবাই বসেছে। রিফাত বসেছে বড় বাবার পাশে। একটু দূরে রিফাতের বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে,তার পাশে ফিরোজ মেম্বার বসেছে।
বড় বাবা কথা শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি রিফাতের বাবাকে বললেন,
__আমি জানতাম তোমরা আমার সিদ্ধান্তের উপরে কোনো কথা বল না। কিন্তু আমি দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় তুমি এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলে?
__(একটু গলা উচিয়ে) কেন বড় ভাইজান, নিজের ছেলের ব্যাপারে কোনো কথা বলার অধিকার কি আমার নাই ?
__হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। কিন্তু গ্রামের মধ্যে আজ যে ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে তো শুধু তোমার ছেলে নয়, তার সাথে একটা মেয়েও জড়িত। পরের মেয়ের সম্বন্ধে এতো নোংরা কথা, নোংরা ঘটনা রটানোর অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
__আমি কিছু করি নাই। গ্রামের মানুষ যদি ঐ মেয়েটাকে নোংরা কথা শুনিয়ে থাকে, সেটা তাদের ব্যাপার। তাতে আমার কি? মেয়েটা তার নিজের দোষেই কথা শুনছে।
__মেঝ, তুই ভুলে যাচ্ছিস ঐ মেয়েটা যদি দোষী হয়, তাহলে তোর ছেলেটাও দোষী। শুধু তাই নয়, রিফাত একটু বেশিই দোষী। কারণ সেই তো ঐ মেয়েটা কে ভালোবেসেছে….
__(আরো রেগে গিয়ে) হ্যাঁ, হ্যাঁ বড় ভাইজান। আজ তো আপনি এই কথা বলবেনই। জীবনে একটা মেয়েকে ভালোবেসে সারা জীবন পার করে দিলেন। আপনি তো আর বিয়ে থা করেন নাই। নিজের কোনো সন্তান নাই। রিফাত তো আর আপনার নিজের ছেলে না। তাই পরের মেয়ের জন্য আপনি আমার ছেলেটাকে এভাবে….
আরও পড়ুন রাতুল হাসান জয় রচিত গল্প পরাজিত নাবিক
এতোগুলো মানুষের সামনে রিফাতের বাবার এমন কথায় বড় বাবা ভীষণ কষ্ট পেলেন। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, মুচকি হেসে সবার আড়ালে চোখের কোনা মুছে নিলেন। আর বললেন,
__মেঝ, আমি জানতাম তুমি এই ভাবেই কথা বলবে। তোমার স্বভাব তো মরলেও ভালো হবে না। তুমি সেই ছোটবেলা থেকেই একটু ঘাড় ত্যাড়া মানুষ। তাই তোমার কথায় কিছু মনে করছি না। (পেছন ঘুড়ে রিফাতের মায়ের দিকে তাকিয়ে) রিফাতের মা, ছেলে তো শুধু তার বাপের না। তুমি ছেলের মা। তোমার কি মতামত? তুমি যা বলবে তাই হবে….
রিফাতের মা, মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে দিয়ে বললেন,
__এসব কী বলছেন ভাইজান? আপনি থাকতে আমি মতামত দিব ?
__হ্যাঁ, অবশ্যই দিবে।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা গল্পের-
ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজে
বড় বাবা (৩য় পর্ব)