নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৯ম পর্ব ।। ধারাবাহিক উপন্যাস
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৯ম পর্ব
- এ কে আজাদ দুলাল
আজকের বিকেলেটা অন্য রকম। বাড়িটির পশ্চিমে পাকা রাস্তা, তারপর সবুজ ঘন বড়ো বড়ো গাছের সমারোহ। দারুণ লাগছে রাকার। বিকেলের সূর্যটা লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে সবুজ ঘন গাছের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে। আর মাস্টার বাড়ির পরিবারের সদস্য এবং আগত অতিথি বিশেষ করে রাকার মনের ভেতরে চলছে অজানা স্নায়ুযুদ্ধ। এ যুদ্ধ হয়তো একটা ভাঙা সম্পর্ক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হবে। রাকার মনে প্রশ্ন সে কী সঠিক জায়গায় পা দিয়েছে না-কি আবার অজানা পথে পা বাড়াতে হবে। কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারার সাথে বাবার চেহারায় অনেকটাই মিল। যদি তাই হয়, তাহলে এদের মধ্যে কী এমন ঘটেছিল, এতকাল বিচ্ছিন্ন কেন। এই কেনোর উত্তর পেতে হবে। তবে কৌশলে আবেগে নয়। এবার বুঝতে পারছে ড. মাসুদের পরিকল্পনা। মনিকাদির কাছে ধরা দিবে না রাকা। মনিকা এগিয়ে এসে আগে নিজের পরিচয় দেয়।
— আমি মনিকা, আর ওর নাম রাকা।
রাকা ছালাম বিনিময় করল। ভদ্রলোক এগিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন।
— রাশিদ আহমেদ। সবাই রাশিদ বলে জানেন, আর পাশে আমার সহধর্মিণী। রাশিদ আহমেদ নাম শুনে রাকার মনের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রাকিব আহমেদ। সংক্ষিপ্ত রাকিব। রাশিদ আহমেদ। সংক্ষিপ্ত রাশিদ। অতিথিদের নিয়ে ভেতরে ঢোকে। চোখে পড়ে দু’পাশে দোতলা দুটো বিল্ডিং। গ্রাম হলেও আধুনিকতার ছাপ আছে নির্মাণে। ডান পাশের বিল্ডিং রাশিদ আহমেদের; ইঙ্গিতে বুঝা গেল। বামের বিল্ডিং-এ দরজার গায়ে বড়ো একটা তালা ঝুলছে। আরও দুটো আধাপাকা ঘর চোখে পড়ল রাকার।
আরও পড়ন স্বপ্নজল
এরপর একটু দূরে মাঝারি ধরনের একটা পুকুর। পুকুরের পর সবুজ মাঠ। মাঠ পেরিয়ে সবুজ গ্রাম। মনে হচ্ছে অর্ধবৃত্ত। গ্রামগুলো ধুঁ ধুঁ করছে। এমন দৃশ্য এর আগে কখনো রাকার চোখে পড়েনি। সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যায়। মিসেস রাশিদ আহমেদ এসে নিজের বাসার ড্রইংরুমে নিয়ে বসতে বললেন। ইতোমধ্যে চা-নাশতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
— পাশে ওয়াশ রুম আছে। হাতমুখ ধুয়ে চা-নাশতা খেয়ে নিন, পরে কথা হবে।
দু’জন নাশতা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আরামে সোফায় বসে। মিসেস রাশিদ জানতে চাইলেন,
— আমাদের অবগতি না করে আসার কারণ কী?
— দুঃখিত। আপনাদের কোনো মোবাইল নম্বর আমাদের দেওয়া হয়নি। যিনি পাঠিয়েছেন তার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের ফিরে যেতে হবে না এবং অযত্ন হবে না। রাকার খুব ইচ্ছে গ্রাম দেখা।
— আসলে কী তাই? তবে কতদিন থাকবেন?
— সেটা নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর।
পাশে গেস্ট রুম। বিশ্রাম নেন। রাতে খাবার টেবিলে আলোচনা হবে। অল্প সময়ের ব্যবধানে এদের আতিথিয়তা এবং আন্তরিকতা মনিকা-রাকা মুগ্ধ হলো।
গেট রুমে পাশাপাশি দুটো সিঙ্গেল খাট। আলনা, ড্রেসিং টেবিল আর বসার জন্য ডাবল সিটের সোফা এবং অ্যাটাস্ট বার্থরুম। মনিকা ভাবছে এটা বাসা বাড়ি না-কি রিসোর্ট। ভেতরে সুন্দর করে সাজানো। ভদ্র মহিলার কথাবারতা বেশ মার্জিত। সন্ধ্যায় বিজলি বাতি জ্বলে ওঠে। রুমটা আলোয় ভরে ওঠে। ক্লান্ত শরীরে দু’জন বিছানায় শুয়ে পরে। বিচিত্র ভাবনা শরীরের ক্লান্তি কোথায় যেন দূর হয়ে গেল। বাড়িটির প্রতি মমত্ববোধ জেগে ওঠে রাকার মনে। এদের জানতে এবং বুঝতে আরও কিছুটা সময় দিতে হবে। প্রায় রাত আটটার দিকে খাবার টেবিলে ডাক পড়ে। ডাইনিং-এ ঢুকতেই ভদ্রলোক দুটো চেয়ার দেখিয়ে বসতে অনুরোধ করেন। একজন গৃহকর্মী খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। মহিলা এবার মুখ খুললেন।
আরও পড়ুন পথভোলা এক পথিক
— আমি এ বাড়ির মেজো বউ। স্থানীয় একটা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। পাশে বসা আমার কর্তা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। প্রয়াত শ্বশুর-শ্বাশুড়ির অনুরোধে আমরা উভয়েই শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেছি। তবে আমাদের সন্তানরা অন্য পেশায় নিয়োজিত। তাদের ব্যক্তি ইচ্ছের ওপর বাধা দেইনি। আমরা মান্য করলেও আমাদের ছেলে-মেয়েরা সেটা যে রক্ষা করবে, এটা এ যুগে আশা করা ঠিক না। তাদের ইচ্ছের প্রতি সম্মান দেখানো উচিৎ। যাহোক, দুটো ছেলে-মেয়ে সবাই শহরে চাকরিরত এবং ঘর-সংসার করছে।
রাকা রাশিদ আহমেদের মুখোমুখি বসেছে। বার বার রাকার দিকে দৃষ্টি। দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা মায়া ভরা। অনেক দিনে জানা-শোনা।
— ওর ছোটো ভাই মানে এ বাড়ির ছোটো ছেলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সরকারি কলেজের শিক্ষক। বলতে গেলে এ পরিবারের সবাই শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। ওদের একমাত্র বোন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কলেজে শিক্ষক হিসেবে আছেন। তাদের একমাত্র ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক। শ্বশুর সাহেব ছিলেন এলাকার সবচেয়ে পুরাতন ম্যাট্রিক পাশ এবং প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে পূরণ করেছেন তাঁর সুযোগ্য সন্তানরা। এলাকার লোকজন মাস্টার বাড়ি বলে জানে।
— তাই বুঝি মাস্টার বাড়ি।
— ঠিক তাই।
— কিছু মনে করবেন না। একটা প্রশ্ন করতে পারি, যদিও সেটা আপনাদের পারিবারিক হয়ে যাবে?
— জানি কী প্রশ্ন করবেন। এবার আপনাদের পরিচয় জানা প্রয়োজন।
রাশিদ আহমেদ রাকাকে দেখার পর হতে ভেবেই চলছে মেয়েটির চেহারা তাদের মায়ের আদলে বলতে গেলে আশি ভাগ। মা-র গায়ের রং খুব বেশি উজ্জ্বল ছিল না। কিন্তু মেয়েটির গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল। হয়তো শহরে বসবাস করে বলে। রাকার হাঁটা, কথা বলার ঢং এবং হাসি মায়ের মতো। বড়ো ভাইয়ের চেহারা এখন কেমন হয়েছে কে জানে। যৌবনে খুবই সুদর্শন ছিল। কিছুটা ছোটো বোনের ছেলে সাগর পেয়েছে। রাকা হয়তো জানতে চাইবে তাদের বড়ো ভাই কোথায়। তার কথা কেন বলা হলো না। তাই বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ছোটো ভাই-বোন আগামীকাল সকালে সপরিবারে আসবে। মোবাইলে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন রোদেলা দুপুর কাঁদে
মনিকা একটু মিথ্যের আশ্রয় নিল।
— আমি একজন এনজিওকর্মী। এটা আমার পেশা। আমাদের এনজিও হতে অবহেলিত স্কুল- কলেজে ফান্ড প্রদান করে থাকে। আপনাদের স্কুলটি শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্কুল; তাই আমাদের তালিকায় আছে। আপনাদর অনুমতি পেলে সরেজমিনে দেখতে পারি। আর রাকা বাংলাদেশ দেখতে চায়, তাই আমার সঙ্গী হয়েছে। ও দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়েছে। গ্রামবাংলা দেখা হয়নি। স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করবে। মাটির সাথে সম্পর্ক গড়তে চায়। শহরের বুনিয়াদি ঘরের মেয়ে হয়ে ঢাকায় অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হতে নারাজ।
মেয়েটি বিদেশে মানুষ হয়েছে; চেহারায় তাই মনে হয়। তবে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার চিন্তা-ভাবনা এটা এক ধরনের আবেগ। জীবনে কত মানুষের তো দেখা মিলেছে। খাওয়া শেষ হয়েছে।
— আপনারা রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেন। আগামীকাল কথা হবে। রাতে চায়ের অভ্যাস থাকলে বলতে পারেন। ব্যবস্থা আছে।
ধন্যবাদ দিয়ে রাশিদ আহমেদ নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। আজ রাকা নামের মেয়েটির পরিচয় জানা হলো না। মনিকা নামের এনজিওকর্মী কী কৌশলে এড়িয়ে গেল। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। রাত পোহালে অন্যরা এসে যাবে, তখন বিষয়টি আরও খোলাসা হবে মেয়েটি কে। ছোটো বোন আর ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী যা ঘাগু গোয়েন্দা। পেটের কথা বের করতে বেশি সময় লাগবে না।
রুমে এসে দু’জন পাশাপাশি সোফায় বসে।
— মনিকাদি, কিছু আন্দাজ করতে পেরেছ?
— দেখ, দীর্ঘদিন ধরে মনোবিজ্ঞানী ডা. মাসুদ স্যারের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। প্রথম দর্শনে কিছুটা তো আন্দাজ করা যেতেই পারি। ভদ্রলোক তোমাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। তোমার পরিচয় জানতে চাইলেও আমি কৌশলে আমার পরিচয় এবং আসার কারণ বলি। যদিও মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি কী গল্প শেষ করা যায়। ও ভালো কথা, তোমার বাবার সাথে জরুরি কথা বলে নিও। মাসুদ স্যারকে বিস্তারিত বলা হয়েছে। শুনে খুব খুশি হয়েছেন।
আরও পড়ুন পক্ষিরাজের ডানা
বাকি কথাগুলো রাকার কাছে গোপন রাখা হলো। ঠিক জায়গায় পা রাখা হয়েছে।
— আর একটা কথা, তোমার প্রশ্ন ছিল তাদের বড়ো ভাইকে নিয়ে। কিন্তু তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেলেন। আমিও একটু চালাকি করলাম। ভদ্রলোক খুশি হননি। আগামীকাল অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৯ম পর্ব