নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৮ম পর্ব ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৮ম পর্ব
- এ কে আজাদ দুলাল
পরবর্তী স্টেশনে নামতে হবে। রেল স্টেশনটি ছোটো হলেও অনেক পুরাতন। ব্রিটিশ শাসক তাদের সুবিধামতো রেল স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ করেছিল। আমাদের বংশপরম্পরা তা ভোগ করে আসছি; অন্তত এই দুটো জায়গায় তাদের স্মরণ করা যায়। স্টেশনটি সে রকম জাঁকজমকপূর্ণ নয়। ব্রিটিশ আমলের জীর্ণশীর্ণ দুটো ভবন দাঁড়িয়ে আছে অতীত স্বাক্ষী হয়ে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্রেনটি স্টেশনে থামবে। যাত্রীরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সংখ্যা বেশি নয়। পাঁচ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করবে না তাই যাত্রীদের বেশ তাড়াহুড়া। ট্রেন থামতেই লালজামা পরিহিত একজন কুলি এসে মনিকার সামনে দাঁড়ায়। সে যাত্রীদের চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছে এই যাত্রীর কুলি প্রয়োজন।
— আপা মনি, কোন হানে যাইবোন? কুলি লাগব?
কুলির কথা শুনে রাকার হাসি পায়; এ ধরনের ভাষা এই প্রথম সে শুনতে পেল। আর মনিকার কাছে এটা কোনো বিষয় নয়। সে এই বাংলার মেয়ে। বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। গ্রামাঞ্চলের কথ্য ভাষার মানুষের সাথে পরিচয় আছে।
— বাসস্ট্যান্ডে লইয়া যাইবা। কড লইবা?
— আপনাগোর দুডো বেগোজ দেড়শো ট্যাহা দেবেন।
কথা না বাড়িয়ে কুলির কথায় রাজি হয়ে যায়। কুলির পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে। রাকার অপরিচিত জায়গা। মনের ভেতরে কেমন যেন ভয় লাগছে। মাসুদ ভাই আগেই বলেছেন মনিকা একজন বিশ্বস্ত এবং সাহসী মহিলা। এখন বেলা তিনটা বাজে। খিদে পেয়েছে। কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়ে আর কত সময় থাকা যায়। কিন্তু মনিকাদি একবারের জন্যও খাওয়ার কথা মুখে আনেননি।
আরও পড়ুন নীলভোর
মনিকাদি বলেছে, প্রথমে বাসে তারপর আধা ঘণ্টা ভ্যানগাড়ি। নামগুলো শুনে রাকার মনের ভেতরে রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে। এটা একটা দুঃসাহসিক ভ্রমণ। না ভ্রমণ নয় অ্যাডভেঞ্চার। সামনে এর চেয়ে আরও কঠিন কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে কি-না কে জানে; মন শক্ত রাখতে হবে। হঠাৎ বাবার মুখখানী চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিদায় নেওয়ার সময় বাবার মুখখানা কেমন যেন বিষণ্ণতায় ভরা ছিল। দুটো চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু পড়ে। তাড়াতাড়ি করে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয় রাকা।
— তা রাকাদি, কেমন লাগছে? মনে হয় খিদে পেয়েছ।
— এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না-কো তুমি; এই হলো আমার অনুভূতি।
বাস স্ট্যান্ডে এসে গেছে। ফুলঝুড়ির লাইন বাসে উঠিয়ে দিয়ে লম্বা একটা সালাম দিয়ে কুলি বিদায় নিল। দু’জন ডাবল সিটে বসে পরে। হেলপারকে বলে রাখে তারা ফুলঝুড়ি বাসস্ট্যান্ডে নামবে। মোটরযানের অবস্থা এবং যাত্রীদের চেহারা দেখে রাকার খুব কষ্ট হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ কত দরিদ্র! শহরের মানুষের জন্য কত কী করে যাচ্ছে সরকার, অথচ আশিভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে।
— রাকাদি কিছু ভাবছ?
— অনেক কিছু। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কত পার্থক্য। ট্টেনের ভেতরে লক্ষ্য করেছি। এখানে এসে আরও পার্থক্য চোখে পরছে।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রাকা।
মনিকা ভাবছে মেয়েটি কোনো ধাতুর তৈরি। শুনেছে বিদেশে জন্ম। আবার দ্বৈত পাসপোর্টধারী। শুধু তাই নয়, প্রাক্তন সিএসপি কর্মকর্তা একমাত্র কন্যা মানে রাজকন্যা। যাহোক ডা. মাসুদ স্যারর নির্দেশ মোতাবেক গন্তব্যস্থলে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে। তারপর নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষা। আরও ঘণ্টা দেড়েক। রাকা জানলার পাশে বসে বাইরে চোখ মেলে।
আরও পড়ুন পাথরে শৈবাল খেলে
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।”
মনিকা আশ্চর্য হয়ে যায় রাকার মিষ্টি কণ্ঠে গান শুনে।
— তোমার তো দারুণ গলা! এত সুন্দর বাংলা বলতে পারো, আবার গানও গাইতে পারো! তুমি কী বাংলা গান গাইতে পারো?
— আলবৎ। আমি ছোটোবেলা হতে বাংলা শিখেছি, পাশাপাশি গান শিখেছি। জানেন, ছুটির দিনে বাবা নিজে ড্রাইভ করে বাংলাপাড়ায় নিয়ে যেতেন। সেখানে বাঙালিরা বাংলা ভাষা, গান, কবিতা আবৃত্তি এবং বিভিন্ন ধরনের গান শিখত। বাবা বলতেন, কিশোর বয়সে সবকিছুর গোড়াপত্তন করতে হয়। বয়স বেড়ে গেলে শিক্ষার আগ্রহ কমে যায়। কথাটা একদম সত্য। তাই বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কিন্তু আমার দুটো বড়ো ভাই বাংলা ভাষার প্রতি কোনো রকম আগ্রহ প্রকাশ করেনি। বাসায় মা-র সাথে উর্দু এবং বাবার সাথে ইংরেজিতে কথা বলত। আমার সাথে তাদের খুব কমই কথা হতো। তাদের উর্দুভাষী অনেকগুলো কাজিন আছে। মনিকাদি, এখানে দেখি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে সবাই প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কেউ শুদ্ধভাবে মাতৃভাষাটা শেখে না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এক, আর ভাষা শেখা আলাদা বিষয়।
— এখানে অনেক কিছু আছে, রাকা।
— তা জানি, শ্রেণি বিভাগ। কী যেন বলে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত।
রাকা কথা শেষ করে মনিকার দিকে তাকিয়ে একটু জোরে হেসে উঠে।
— ডলার-পাউন্ডের তলায় চাপা পরে যায় নিজের শিকড়। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আসতে পারে না তাদের শেষ বিদায়ে। কী করুন, তাই না রাকা?
রাকা মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
আরও পড়ুন স্বপ্ন গোধূলি
— রাকা, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তোমার মতো একজন বাঙালিমনা মেয়েকে পেয়ে গর্বিত।
মনিকার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বাইরে চোখ মেলে রাকা। বাবা কী এমন দিগন্ত সবুজভরা মাঠ কখনো দেখেছেন। বাবা কার উপর অভিমানে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন। মাসুদ ভাইয়ের মা বলেছিলেন,
— মা রাকা, তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে; তোমার দেখা সেই মহিলাকে, যাকে তুমি স্বপ্নে দেখতে পাও।
সেই ভরসায় একজন মেয়ে হয়ে পথে নেমেছে। পথ হারাবে না। হেলপারের ডাক শুনে নিজেকে সামলে নেয় রাকা। ফুলঝুড়ি বাজারে এসে থামে গাড়ি। তাদের সাথে জনাপাঁচেক যাত্রী। মনিকার সাথে রাকা গাড়ি হতে নেমে দাঁড়ায়। হেলপার লাগেজ দুটো নামিয়ে দেয়। পাশে দাঁড়ানো ছিল ভ্যানগাড়ি। নতুন যাত্রী, তাও আবার মহিলা।
— ফুলঝুড়ি যাবেন?
ভ্যানগাড়ির চালকদের মধ্য থেকে একজন বলল,
— আপনারা কি শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্কুলের নতুন ম্যাডাম? তয় আমার গাড়িতে বইতে পারেন।
— আপনি চেনেন না-কি?
— আমার মাইডা ক্লাস টেনে পড়ে। সকল নতুন মাস্টার প্রথমে মাস্টার সাহেবের বাড়িতে উডে।
মনিকা মনে মনে ভাবে মেঘ না চাইতে জল। জিনিসপত্র ভ্যানেগাড়িতে উঠিয়ে দু’জন সামনে বসে।
— কত সময় লাগবে, ভাই? বেলা ডুবার আগে পোঁছানো যাবে তো?
— চিন্তা করবেন না। বেলা ডোবার অনেক আগেই মাস্টার সাহেবের বাড়িতে লইয়া যাইমু।
রাস্তার দু’পাশ দিয়ে সারি সারি গাছ। তারপর কাঁচাপাকা বাড়ি। আবার অনেক বাড়িতে টিনের ঘর। ঘরগুলো এলোমেলো। দরিদ্রদের ছাপ দেখলেই বুঝা যায়। রাস্তা-ঘাট দেখলে মনে হয় সবেমাত্র উন্নয়নে ছোঁয়া লেগেছে। রাকা অবাক হয়ে দেখছে কী সুন্দর গ্রামবাংলা। মনে হয় মানুষগুলো খুব সহজ-সরল।
আরও পড়ুন ও রিহানা
কিন্তু তার দাদার বাড়ি কোথায়। তার বাবার কী এমন একটা গ্রামে জন্ম! হয়তো নিজের পজিশনের কথা চিন্তা করে গোপন রেখেছে তার মেয়ের কাছে। আবার এও হতে পারে মায়ের সাথে অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে, যা তার আদরের মেয়ে রাকাকে বলতে পারছে না। বাবার জন্য কষ্ট লাগছে রাকার। এত বড়ো একজন আমলা তার ব্যক্তিজীবনে কোথায় যেন অন্ধকার। প্রায় পনের মিনিটে একটা বাজারে এসে ঢোকে ভ্যানগাড়ি। বাজার পেতেই দক্ষিণপাশে একটা লম্বা টিনের ঘর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে সাইনবোর্ডে স্কুলের নাম লেখা। স্কুলের পাশে খেলার মাঠ। কিছু সংখ্যক ছেলেরা ফুটবল খেলছে, আবার অনেকে গোল হয়ে বসে মোবাইলে গেম খেলছে।
— আপনারা এই স্কুলের ম্যাডাম?
— কেমন করে বুঝলেন?
— আমার মেয়ে কইচিলো তাদের নতুন টিচার আইবো।
দু’জনে হাসে। কোনো জবাব দেয় না।
— এই তো, বাঁকটুকু পার হলেই মাস্টার বাড়ি। অনেক সুনাম এই বাড়ির। শুধু তাই নয়, এলাকার পুরাতন বাড়ি। লোক কয় এই বাড়ির বড়ো পোলা মস্ত বড়ো বিদ্বান, বড়ো চাকরি করে। দুঃখের কতা তারে এলাকার মানুষ চামড়ার চোখে দেহে নাই। শুধু নামই হুনছে।
— ও তাই!
রাকার মনের ভেতরে অজানা একটা সন্দেহ জেগে ওঠে। তাহলে মাসুদ ভাইয়ের কী এটা একটা পরিকল্পনা। বাবা জানেন। মনিকাদি অবশ্যই জানেন। তবে সে নিজেকে গোপন রাখবে যতই কষ্টই হোক।
আরও পড়ুন সোনালী সকাল
অবশেষে পড়ন্ত বিকেলে একটা লোহার গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায় ভ্যানগাড়ি। গেইটটা বেশ পুরাতন। সেভাবে দেখভালো করা হয় না। গেইটের সামনে গিয়ে চাচাজান বলে ডাকতে থাকে ভ্যানওয়ালা। ডাক শুনে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত ষাটোর্ধ্ব একজন ভদ্র লোক গেইট খুলে বাইরে এলেন। চেহারার মধ্যে একটা অভিজাত্যভাব, তবে অহংকারী বলে মনে হলো না রাকার। দেখতেই ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে যায়। মনের ভেতরে যে ভয়টা কাজ করছিল তা অনেকখানি দূর হয়ে যায়।
— চাচাজান, এরা দুজন আপনাগো বাসায় এসেছেন।
ভদ্রলোক রাকার দিকে তাকাতেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। তাৎক্ষণিক কোনো কথা বলতে পারলেন না। ইতোমধ্যে আরও তিন-চার জন মহিলা এবং বাচ্চা ছেলে-মেয়ে এসে দাঁড়ায়। অচেনা দু’জন মহিলার হঠাৎ আগমন। স্কুলের কেউ এলে হেড স্যার আগেই বলে রাখেন। কিন্তু এবার? মনের ভেতরে বেশ কৌতূহল বয়ে যায় এই বাড়ির মালিকের। চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটা মেয়ে এসে বলল,
— এরা আমাদের স্কুলের ম্যাডাম। ভেতরে নিয়ে যাই, চাচি মা?
ভদ্রলোক আগেই মনিকা-রাকাকে ভেতরে যেতে অনুরোধ করে। মনিকা ভ্যানওয়ালাকে একশত টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, ফেরত দিতে হবে না।
আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৮ম পর্ব