নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৭ম পর্ব ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৭ম পর্ব
- এ কে আজাদ দুলাল
আরও ঘণ্টা দুই লাগবে স্টেশন পোঁছাতে। গাড়ি যে গতিতে চলছে তাই মনে হলো মনিকার। এত সময় ধরে রাকা তার পৈতৃক ইতিহাস বলল। কিন্তু কেন ফুলঝুড়িতে যাচ্ছে তা জানা হলো না। আবার ডা. মাসুদ সেভাবে কিছু ভেঙে বলেননি।
— আচ্ছা রাকা, তুমি যে আমার সঙ্গে ফুলঝুড়িতে যাচ্ছো, কিন্তু কেন?
— মনিকাদি, এই ফুলঝুড়ির নামটা তোমার মুখে এই প্রথম শুনতে পেলাম। মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে সব জানেন। তবে তোমাকে আরও একটা মজার কাহিনি বলব।
— ইদানিং পর পর বেশ ক’টা রাতে একটা স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি। সচেতন, অচেতন বা অবচেতনে; তাকে কখনো মনের জগতে কল্পনা করিনি। এমনকি তার সাথে কোনো দিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। যাকে স্বপ্নে দেখি তাকে নিয়ে কেউ গল্পও করেনি। এই ধরুন দাদি-ফুফুকে নিয়ে গল্প বলা। তাদের চেহারা কেমন জানি না। আসলে আমার বাবা ছাড়া আরও কাউকে জানি না।
রাকার বুদ্ধি হওয়ার পর হতে তার বাবা তাকে নাম ধরে ডাকেনি। শুধু মা বলে ডাকেন। মাঝেমধ্যে অবাক দৃষ্টিতে রাকার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজতেন। জানতে চাইলে মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। তিন রাত পর পর স্বপ্নটা দেখার পর মনের ভেতরে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। তাই একদিন নাশতার টেবিলে স্বপ্নের কথা বলে।
— বাবা, গত তিন রাত ধরে একই স্বপ্ন দেখে আসছি।
— কী স্বপ্ন, মা?
— একজন বয়স্ক মহিলা পরনে সবুজ শাড়ি, খয়েরি রঙের পাড় এবং ব্লাউজ। কিন্তু তার মুখ আমি দেখতে পারিনি।
— তারপর?
— মস্ত বড়ো একটা সবুজ মাঠের মধ্যে দিয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে হেঁটে যাচ্ছেন।
— তিনি কি কিছু বলতেন?
— না। তারপর হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যেত। তখন তার জন্য আমার খুব মায়া হতো। মহিলার জন্য আমার খুব কান্না হতো। মনে হতো তিনি আমাকে কিছু বলতে চান। বাবা, তুমি তো মনোবিজ্ঞান বিষয় অনেক পড়াশোনা করেছ…
আরও পড়ুন পেতনি
বাবা কিছুটা সময় চুপ থেকে বলতেন,
— এটা তোমার অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা কোনো কল্পনা।
রাকিব আহমেদ তার ঘরে গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে হারিয়ে যেতেন কিশোরকালে। তার মা খয়েরি রঙের পাড়ে সবুজ রঙের শাড়ি পরতেন। কিন্তু রাকা এ ধরনের স্বপ্ন কেন দেখবে। সে তো কোনো দিন তার পৈতৃক পরিচয় রাকাকে বললেননি। তাহলে এমনটি হওয়ার কারণ কী। দুশ্চিন্তায় পড়ে য়ায় রাকিব আহমেদ। ডা. মাসুদকে ঘটনা বলাতে তার চেম্বারে কফি পানের দাওয়াত দেয়। ডা. মাসুদের চেম্বার আর বাসা একই বিল্ডিংয়ে। আর রাকার প্রিয় বাসা আর কফি তো আছেই।
সন্ধ্যার পর মেয়েকে নিয়ে ডা. মাসুদের চেম্বারে উপস্থিত হন রাকিব আহমেদ। রাকা সোজা তিন তলায় চলে যায় ড. মাসুদের মায়ের কাছে। রাকার খুব প্রিয় তিনতলা ফ্ল্যাট বাড়িটি। নিচ তলায় চেম্বার। দুটো দুই ভাই-বোন বসে, বাকি দুটো ভাড়া। দোতলা বোন এবং তিনতলায় মাকে নিয়ে থাকেন ড. মাসুদ। এ বাসার সবার প্রিয় রাকা। ডা. মাসুদের মা ইচ্ছে করেই রাকার দাদার পরিবার সম্পর্কের আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি রাকার কাছে। যে ঘটনা অনেক বছর আগে ঘটেছিল, সেটা স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। রাকিব আহমেদের উচ্চাঙ্ক্ষার কারণেই পিতৃপরিচয় দিতে বিরতি আছে, আবার এটা নাও হতে পারে। রাকিব আহমেদের পারিবারিক বিষয়।
আরও পড়ুন জোছনা মাখা আলো
কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি, তবে মিসেস রাকিব আহমেদ এ বাসায় বলতে গেলে খুবই কম এসেছে। রাত তখন নয়টা বাজে। রোগী দেখা প্রায় শেষ। ডা. মাসুদ জানেন, রাকিব চাচ্চু তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ডা. মাসুদ নিজে এসে রাকিব সাহেবকে চেম্বারে নিয়ে বসতে বলে কুশলাদি জেনে নিলেন। রাকার স্বপ্নের বিষয়টি খুলে বললেন। রাকা সঙ্গে এসেছে। বুঝতে বাকি রইল না রাকা এখন কোথায়। তিন তলায় আড্ডা দিচ্ছে। ডা. মাসুদ নিজেই ইন্টারকোম ফোনে রাকাকে আসার জন্য মিসেস মাসুদকে বললেন। রাকা বুঝতে পেরেছে তাকে কেন ডাকা হয়েছে। সেও চায় কেন সে একজন অচেনা মহিলাকে স্বপ্ন দেখে। রাকা চেম্বারে ঢোকার পরপরই রাকিব সাহেব বের হয়ে যান।
— ম্যাডাম রাকা, কেমন আছ?
— দুঃখিত। আগে ম্যাডাম শব্দটা তুলে নাও, তারপর জবাব পাবে।
— ঠিক আছে। তা বোনটি খবর কী?
— মানে, যিনি আমাকে রোগী হিসেবে মনোবিজ্ঞানী ডা. মাসুদ সাহেবের চেম্বারে নিয়ে এসেছেন তিনি কিছুই আভাস দেননি। আমার দুর্ভাগা দাদা-দাদি; তারা কী করতেন? তাছাড়া চাচা-ফুফু আছেন কি-না, তাও এ জীবনে জানা হলো না। জন্মের পর হতে শুধু মাতামোহের বংশ পরিচয় শুনে এসেছি। আর ভালো লাগে না। কোথায় যেন শূন্যতা বিরাজ করে। আমি তো দশজন মানুষের মতো। আমার বংশ পরিচয় কি জানা খুবই জরুরি। জানো, আমাদের অনেক বন্ধু আছে, তারা এখন বিদেশে জীবনযাপন করছে। তাদের কাছে বংশ পরিচয়টা ম্যাটার করে না। কিন্তু আমি আমার বংশ পরিচয় জানতে চাই।
— কেন, তোমার বাবা…
— বাবা! মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কেন জানি না। জানার চেষ্টা করিনি। জানো ভাইয়া, তোমাদের বাসায় এলে আমার মন আনন্দে নেচে উঠে। তোমার বাচ্চারা যখন ফুফুমনি বলে জড়িয়ে ধরে,তখন আমার নিজের অস্ত্বিত্ব খুঁজে পাই।
আরও পড়ুন মরিচপোড়া
এক পর্যায়ে কেঁদে উঠে রাকা। ডা. মাসুদ বুঝতে পারে রাকার দুঃখ কোথায়।
— আচ্ছা, তুমি যাকে স্বপ্নে দেখো তার মতো কাউকে নিয়ে কখনো কল্পনা করেছ? এই ধরো, তোমার দাদি এ রকমের চেহারা হতে পারে।
— তা কখনো মনে আসেনি। তবে বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখতেন।
অল্পতেই বুঝতে পারেন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ডা.মাসুদ। তার মানে দাঁড়ায়, দাদির চেহারার আদলে রাকার চেহারা। মা-র কাছ হতে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, মা দাদা-দাদিকে খুব ভালো করে জানতেন। তাদের চেহারা মনে আছে।
— ঠিক আছে, মন খারাপ করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু নরমাল মেডিসিন দিচ্ছি। ইচ্ছে করলে সেবন করতে পারো। আর এর চেয়ে বড়ো মেডিসিন তোমাকে দেব। প্রস্তুতি নিতে থাকো। তবে বিষয়টি একেবারে গোপন থাকবে। মনে করো, তুমি মানসিক পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও ভ্রমণে বের হচ্ছো। সাথে থাকবে একজন অভিজ্ঞ গাইড। তিনিই শুধু জানবেন, তুমি কোথায় যাচ্ছো। তাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তিনি একজন মেধাবী মহিলা। রাজি?
— রাজি।
ডা. মাসুদ তার মায়ের কাছে রাকার বিষয়টি বলে। তার মা এটা নিশ্চিত করেন যে, রাকার চেহারা তার দাদির আদলে, এটা সত্য। কিন্তু তার বাবা মানসিক অপরাধের জন্য মেয়েকে বলতে পারছেন না। বাবা-মেয়ে দুজনই মানসিক কষ্টে ভুগছে। রাকাকে সহায়তা করবে মনিকা চাকমা। রাকার দাদার এলাকায় মনিকা অনেক কাজ করেছে তার এনজিও’র মাধ্যমে। এছাড়া রাকার দাদার বাড়ির ঠিকানা তো মনিকাকে দিতেই হবে।
সুযোগ বুঝে মনিকাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে ডা. মাসুদ। মনিকা এক কথায় রাজি হয়ে যায়; নতুন একটা রোমাঞ্চকর ভ্রমণের জন্য। দিনক্ষণ ঠিক করে রাকাকে বলা হয়। এও বলা হয়, তার বাবা-মাকে বলবে একজন ভালো এবং বিশ্বস্ত মহিলা গাইডের সাথে বাংলাদেশকে দেখতে বের হচ্ছে। ব্যাস।
— মনিকাদি, তাই তোমার হাত ধরে অজানার পথে পা বাড়িয়েছি।
আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১দ পর্ব
১২দ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ৭ম পর্ব