-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৩য় পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৩য় পর্ব) সাইফুর রহমান রেজেক বাড়ি ফিরতেই লক্ষ করে, মোমেনাও আসন্ন যুদ্ধবিগ্রহে শঙ্কিত ও চিন্তাগ্রস্ত। মোমেনা রেজেককে উদ্দেশ করে বলে, ── পাকিস্তানিরা নাকি সত্যই আমারে দেশের মানষির মাইরে ফেলাচ্ছে। ইডা কেমন কতা? ওরা না মুসলমান। মুসলমান হয়া আরেক মুসলমানরে মারতিছে। ওদের কি ধর্মটর্ম কিছু নেই তালি? ── কী আর কবো রে মোমেনা। পাকিস্তানি মিলিটারিরা কাশিনাথপুর ক্যাম্প গাড়েছে। ওরা নাকি আমারে গিরামেও আসপি। অল্প বয়স্ক বেটা-ছেলেদের নাকি ধইরে নিয়ে যাচ্ছে। কী হরবো, কিছুই বুঝবের পারতেছিনে। মোমেনা উৎকণ্ঠিত গলায় বলে, আগে আপনি হাটে যান। গ্রামের অনেকেই চাল-ডাল-নুন-তেল মজুত করতিছে। যুদ্ধ শুরু হয়া গেলি মানুষজন খাবি-পরবি কেবি কইরে? ──…
-
আলাদীপুর, গল্প, তালিমনগর, নাজিরগঞ্জ, নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, সাইফুর রহমান, সাতবাড়িয়া, সাহিত্য
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান প্রত্যুষে উঠে পেটের ধান্দাটাই আগে করতে হয় রেজেকের। তাকে যেতে হয় রসু মিয়ার বাড়ি। রসু মিয়ার কাছে তিন মাস আগের পেঁয়াজ বিক্রির কিছু পাওনা বাকি পড়ে আছে। বেশ কয়েক মাস ধরে টাকাটা আটকে রেখেছে রসু মিয়া। চাইলেই শুধু গাইগুই করে। সাথে নানা রকম টালবাহানা, ওজর-আপত্তি ও ভাঁওতাবাজি প্রতিজ্ঞা। টাকাটা তুলতে পারলে কয়েক দিনের সংসার খরচটা আপাতত সামাল দেওয়া যায়। এরপর তাকে যেতে হবে লালডাঙ্গী বটতলায়। যেখানে হুজুর আস্তানা গেড়েছে, সেখানটায়। হুজুরের নাম শাহ সুফি কুতুব উদ্দিন জালালাবাদী। রসু মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পথে কুতুব উদ্দিন জালালাবাদী সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথাই শুনতে পায় রেজেক।…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান কাশিনাথপুর থেকে যে প্রধান পাকা সড়কটি পাবনা শহরে গিয়ে মিশেছে, তারই মাঝে একটি জায়গার নাম আলাদিপুর। আলাদিপুর থেকে একেবারে দক্ষিণ বরাবর আরেকটি কাঁচা রাস্তা নদীর মতো এঁকেবেঁকে নেমে গেছে লালডাঙ্গী হয়ে গাজনার বিলে। নদী ও মানুষের মন দুটোই আঁকাবাঁকা হবে, এটাই মনে হয় প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম। রেজেক আলী সদাইপাতি ভর্তি চটের থলেটি শক্ত করে ধরে কুমিরের পিঠের মতো কর্দমাক্ত রাস্তাটিতে ছোট ছেলে-মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলার মতো করে পা টিপে টিপে এগোতে থাকে লালডাঙ্গী বরাবর। আলাদিপুর থেকে লালডাঙ্গীর দূরত্ব মাইল দেড়েক। শুধু নামেই গ্রামের নাম লালডাঙ্গী। বর্ষা মৌসুমে যখন গাজনার বিল উপচে লালডাঙ্গীতেও…
-
মরিচপোড়া (শেষ পর্ব)
মরিচপোড়া (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ময়েজ শেখের বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। ভূত- তাড়ানি দেখতে জমায়েত হয়েছে প্রায় শ-খানেক লোক। ময়েজ শেখ যে ঘরটায় থাকেন সেই ঘরের বারান্দার চাল ঘেঁষে বিশাল এক নারিকেল গাছ আকাশ ছুঁয়েছে। সেই গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা মিতুজা। একটু দূরে শীতল পাটির উপর জায়নামাজ বিছিয়ে বসেছেন হেকমত কবিরাজ । তার সামনে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র-একটা বড় কাঁচের বোতল, সরিষার তেল, ধুতরাপাতা, ঝাঁটা, গামছা, ধূপ ও তিনটা রক্তরঙা লম্বা লম্বা শুকনা মরিচ। ছোট একটা মালসায় ধরানো হয়েছে আগুন। জায়নামাজে বসে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন হেকমত কবিরাজ। উপস্থিত মানুষজনদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন- আপনাদের…
-
মরিচপোড়া (২য় পর্ব)
মরিচপোড়া (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান সন্ধ্যার পরপরই তোমার মা বসলেন ইলিশ মাছ ভাজতে। মাছের সে কী সুগন্ধ। মনে হয় আধমাইল দূর থেকেও সেই মাছের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মাছ তো নয় যেন ননির চাপ কেটে ভাজা হচ্ছে কড়াইয়ে। ইলিশ মাছের গন্ধে ভুরভুর করতে লাগল চারপাশ। সমস্ত বাড়ি ক্রমশ হয়ে উঠল ইলিশময়। তোমার মা নিজেকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারলেন না। এক টুকরো, দু টুকরো করে এক সময় সম্পূর্ণ মাছটিই খেয়ে ফেললেন। কাঁসার বড় থালাটিতে পড়ে রইল শুধু ল্যাজ আর ছোট ছোট দু-এক টুকরো মাছ। হঠাৎ তোমার মায়ের খেয়াল হলো, সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোন ফাঁকে তিনি মাছগুলো সব খেয়ে নিয়েছেন বুঝতেও…
-
মরিচপোড়া (১ম পর্ব)
মরিচপোড়া (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান আমি যখন বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালাম, সূর্য তখন মধ্য গগন থেকে অল্প একটু হেলে পড়েছে পশ্চিমে। চারদিকে ঝাঁ ঝাঁ সোনা গলানো রোদ। আমিও এসেছি বহু পথ অতিক্রম করে। কত হবে? হাজার লক্ষ ক্রোশ। মাপজোক নেই। আমি কিছুটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। যদিও রোগ, শোক, জরা আমাকে তেমন একটা ছুঁতে পারে না; তারপরও এই নশ্বর পৃথিবীর সবকিছু যেহেতু একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, আমিই বা অবিনশ্বর থাকি কী করে। আমি যখন গৃহটিতে প্রবেশ করলাম মিতুজা তখন ঘরের ডুয়া লেপাপোছায় ব্যস্ত। বালতিতে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ তৈরি করে সেগুলো দিয়ে লেপাপোছার কাজটি করছিল সে। গৃহের মূল ফটকে এসে…
-
পক্ষিরাজের ডানা (শেষ পর্ব)
পক্ষিরাজের ডানা (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর উঠলো জানে আলমের শরীরে। রাত যত গভীর হতে লাগলো, জ্বরও ততটাই প্রকট আকার ধারণ করতে লাগলো। সকাল বেলা দেখা গেল জ্বরের প্রকোপে জানে আলম সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। মাজেদ শেখ ছেলের শরীরে হাত দিয়ে দেখলেন ভয়ানক তাপে শরীর যেন একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই উত্তাপে খৈ, মুড়ি ভেজে নেওয়া যায় অনায়াসে। পাশ থেকে জুলেখা বিবি মাজেদ শেখকে উদ্দেশ্য করে আর্তনাদ করে বললেন, _দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া তামশা না দেইখে টপ কইরে ডাক্তার ডাইকে নিয়ে আসেন। জ্বরে ছেলেডার সারা শরীর পুইড়ে যাচ্ছে। মাজেদ শেখ ছুটলেন ডাক্তারের খোঁজে। হাতেম…
-
পক্ষিরাজের ডানা (৩য় পর্ব)
পক্ষিরাজের ডানা (৩য় পর্ব) সাইফুর রহমান পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন পর যথারীতি রেজাল্ট বেরুলো। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেল জানে আলম শুধুমাত্র বাংলা ছাড়া আর সবগুলো বিষয়েই ফেল করেছে। স্কুলের হেড মাষ্টার আবুল কাশেম জানে আলমের বাবা মাজেদ শেখকে স্কুলে ডেকে পাঠালেন। তাকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, __ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দিকে নজর দিতে পারো না তো ওদের স্কুলে পাঠাও কেন মাজেদ মিয়া। ক্ষেত খামারে কাজে লাগালেও তো এর চেয়ে বেশি লাভবান হতে। কথাগুলো যে প্রধান শিক্ষক বিদ্রুপাত্মক সুরে বলছেন মাজেদ শেখের সেটাও সম্ভবত মাথায় ঢোকে না। __ঠিকই কয়ছেন মাষ্টার সাব। আমিও তাই ভাবতিছি ওক আমি মাটেই লাগা দেবো।…
-
পক্ষিরাজের ডানা (২য় পর্ব)
পক্ষিরাজের ডানা (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান পূর্ব-দক্ষিণ কোণে কুচকুচে কালো মেঘ। ভাবে মনে হচ্ছে বড় ধরনের ঝড় আসবে শীঘ্রই। এক পাল সাদা বক পূর্ব দিক থেকে উড়ে যায় পশ্চিমে। পূর্বদিকের কোন অঞ্চলে হয়তো ইতোমধ্যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আর সেজন্য পাখ-পাখিরা দল বেঁধে সব পালিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে। আসন্ন বিপদের আঁচ পেয়ে গরুগুলোকে নিয়ে জানে আলম বাড়ির পথে পা চালায় দ্রুত। জানে আলম তার গরুগুলোকে উঠোনের শেষ প্রান্তে খড়ের গাদার পাশে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেয় শক্ত করে। বাড়ির ভেতর থেকে জানে আলমের বাবা মাজেদ শেখ চিৎকার করে ওঠে “তোর কি কোন জ্ঞান কাণ্ড নেইরে আলম, গরু গুলেক…
-
পক্ষিরাজের ডানা (১ম পর্ব)
পক্ষিরাজের ডানা (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান চৈত্র মাস প্রায় শেষের দিকে। সুজানগরের গাজনার বিলের বিস্তীর্ণ নাবাল অঞ্চল এ সময়টাতে সাহারা মরুভূমির মত শুষ্ক ও উষ্ণ। অথচ ভরা বর্ষায় এই গাজনা বিলের প্রমত্ত উত্তাল ঢেউ ও জলরাশি দেখে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে, গ্রীষ্মে এই বিলের কী এক করুণ পরণতি দৃশ্যমান হয়। যদিও চৈত্র-বৈশাখের খরতাপে অনেক প্রান্তিক কৃষক গভীর নলকূপ গেঁড়ে বোরো ধান জন্মানোর জন্যে সেচ ব্যবস্থাটি চালু রাখেন। কিন্তু তারপরও পেঁয়াজ ও অন্যান্য রবি শষ্যের জমিগুলো বেশিরভাগই বিরান, আবাদহীন ও পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকে বর্ষা নামার পূর্ব পর্যন্ত। তবে এটা দেখে আশান্বিত হতে হয় যে বিরান এই…