-
কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব)
কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান পরদিন রাতেই বিয়ে হয়ে গেল লতুর। নিতান্তই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। বরপক্ষের লোকজন এসেছিল জনা বিশ-পঁচিশের মতো। পাত্রপক্ষের ইচ্ছা এখন শুধু কাবিন করে রাখা। অগ্রহায়ণের শেষে নতুন ফসল ওঠার পর ধুমধাম করে মেয়েকে তুলে নেবে। বাড়িতে ব্যান্ডপার্টি ও সানাই না বাজলেও আহার-বিহারের কোনো কমতি করেনি তালেব মিয়া। পোলাও রোস্ট থেকে শুরু করে মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথা। মাছ, রেজালা, দই সবকিছুরই এন্তেজাম করেছিল। বরপক্ষের লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে দেশলাইয়ের কাঠি ভেঙে দাঁত খিলাল করতে করতে বলছিলেন, “তালেব মিয়ার আতিথেয়তার তারিফ না করে পারা যায় না। প্রতিটি ব্যঞ্জনই সুস্বাদু। আহা! অমন…
-
কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব)
কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফেরে তালেব। জোবেদা খাতুন লতুর মাথায় তেল দিচ্ছিলেন। লতুর মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে তালেব মিয়াকে উদ্দেশ করে জোবেদা বললেন, “খাবারের গামলা ও থালাবাসনগুলো ঘরের দাওয়ায় রাইখে আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। লতুর চুল আছড়ানি শ্যাষ হলি আমি আপনাক গুড়-মুড়ি দিচ্ছি।” মেয়ের পাশে বসলেই এক অজানা কারণে জোবেদা খাতুনের মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। যদিও লতুর গায়ের রংটা খোসা ছাড়ানো তেঁতুলের মতো কিন্তু মেয়ে তার দেখতে বেশ আকর্ষণীয়া। দীর্ঘাঙ্গী। সব সময় পরিচ্ছন্ন পরিপাটি চলাফেরা। লতুর শরীর থেকে সবসময় জবাকুসুম তেল আর শিউলিফুলের সুবাস মেশানো সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়। জোবেদার ইচ্ছা…
-
কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব)
কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান তালেব মিয়াকে দেখলে যে কোনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরই চমকে ওঠার কথা। এত মানুষ নয়, যেন জীবন্ত এক কঙ্কাল। পার্থক্য বোধকরি এতটুকুই, যেখানে মানুষ সাদা কঙ্কাল দেখে অভ্যস্ত, সেখানে হয়তো তারা দেখে জাজ্বল্যমান কালো এক কঙ্কাল। মুখ বুজে কাজ করছে কামারশালায়। লিকলিকে, দির্ঘাঙ্গী ও কুচকুচে কালো হাত-পাগুলো এতটাই শীর্ণ যে, শরীরের হাড়গুলো যেন চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসার জন্য সদা উন্মুখ। হাড়চর্মসার মানুষটি যখন উবু হয়ে বসে হাপরটা টানতে থাকে, তখন খানিকটা দূর থেকে সত্যি বোঝা যায় না কোনটা হাপর আর কোনটা তার পেট। জীর্ণ ও কৃষ্ণাভ লুঙ্গিটা হাঁটু ডিঙ্গিয়ে চলে যায় একেবারে উরু…
-
সাহিত্য চর্চার একাল ও সেকাল
সাহিত্য চর্চার একাল ও সেকাল সাইফুর রহমান সেটা সম্ভবত ১৯৮৮ কিংবা ৮৯ সালের কথা। আমার বাবা চাকরি করতেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তিনি ছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সরকারি পরিদর্শক হিসেবে একবার বাবাকে পাঠানো হল চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি উপজেলায়। এ ধরনের সরকারি ট্যুরগুলোতে বাবা সাধারণত আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বাবার সফর সঙ্গী হয়ে সেবার আমিও ঘুরে বেড়িয়েছিলাম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালি, লোহাগড়া, পটিয়া ইত্যাদি উপজেলাগুলো। বাঁশখালি উপজেলায় গিয়ে একটি ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হল। প্রত্যেক উপজেলাতেই আমাদের রাত্রিবাস হতো সাধারণত সরকারি সার্কিট হাউসে। কিন্তু বাঁশখালিতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন ওই অধিদফতরের একজন সহকারী প্রকৌশলী। অনেক পীড়াপীড়িতে বাবা তার আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন।…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (শেষ পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান চিনেখরা ব্রিজ থেকে আনুমানিক বিশ-বাইশ গজ দূরে কিছুটা ঝোপঝাড় ও জঙ্গল গোছের একটি জায়গা বেছে নিয়ে, সেখানে লম্বা আড়াআড়িভাবে বড় একটি বাঙ্কার খনন করা হলো। এন্তার ও ফেকের দুজনেই পেশায় কামিন। মাটি কাটা তাদের নিত্যদিনের অভ্যেস বলে খুব দ্রুতই বাঙ্কারটি খোঁড়া হয়ে গেল। তবে রেজেকসহ অন্যরাও হাত লাগাল সমানতালে। বাঙ্কারটি খনন করা হলো গলাসমান করে, যাতে মাথাটি ঈষৎ উঁচু করে যুদ্ধ করা যায়। ১৫ তারিখের আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেল। ঢাকা থেকে ডিনামাইট ও প্রয়োজনীয় রসদগুলো সময়মতো চলে এসেছে ক্যাম্পে। এখন শুধু এখানকার কিছু প্রস্তুতি। ১৪ তারিখ ভোর রাতে লোহার ব্রিজটার…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৪র্থ পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৪র্থ পর্ব) সাইফুর রহমান এবারের অপারেশন হবে বনকোলা নামক গ্রামে। সেখানে জনা পঞ্চাশেক মিলিটারির একটি ক্যাম্প গঠিত হয়েছে। যেকোনো মূল্যে সে ক্যাম্পটিকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। বনকোলা গ্রামটি একেবারে গাজনার বিলের তীর ঘেঁষে। সেই হিসেবে জলপথেই আক্রমণ সবচেয়ে সুবিধা ও নিরাপদ। তিনটি নৌকায় তোলা হলো মোট বিশ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুটি ভাউলিয়া নৌকা ও একটি জেলে ডিঙি। ভাউলিয়া নৌকাটির পেছন থেকে অর্ধেক পর্যন্ত বাঁশের শক্ত চাতালের মতো ছই। সামনেরটুকু একেবারেই ফাঁকা। এতে করে বেশ সুবিধাই হয়। পাকসেনাদের নিয়োজিত অনুচরদের আর সন্দেহ থাকে না যে সেগুলোতে আসলে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে। ভাউলিয়া নৌকাটি ক্ষুদ্রাকার, অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যবর্জিত ও হালকা। অপেক্ষাকৃত কম…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৩য় পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৩য় পর্ব) সাইফুর রহমান রেজেক বাড়ি ফিরতেই লক্ষ করে, মোমেনাও আসন্ন যুদ্ধবিগ্রহে শঙ্কিত ও চিন্তাগ্রস্ত। মোমেনা রেজেককে উদ্দেশ করে বলে, ── পাকিস্তানিরা নাকি সত্যই আমারে দেশের মানষির মাইরে ফেলাচ্ছে। ইডা কেমন কতা? ওরা না মুসলমান। মুসলমান হয়া আরেক মুসলমানরে মারতিছে। ওদের কি ধর্মটর্ম কিছু নেই তালি? ── কী আর কবো রে মোমেনা। পাকিস্তানি মিলিটারিরা কাশিনাথপুর ক্যাম্প গাড়েছে। ওরা নাকি আমারে গিরামেও আসপি। অল্প বয়স্ক বেটা-ছেলেদের নাকি ধইরে নিয়ে যাচ্ছে। কী হরবো, কিছুই বুঝবের পারতেছিনে। মোমেনা উৎকণ্ঠিত গলায় বলে, আগে আপনি হাটে যান। গ্রামের অনেকেই চাল-ডাল-নুন-তেল মজুত করতিছে। যুদ্ধ শুরু হয়া গেলি মানুষজন খাবি-পরবি কেবি কইরে? ──…
-
আলাদীপুর, গল্প, তালিমনগর, নাজিরগঞ্জ, নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, সাইফুর রহমান, সাতবাড়িয়া, সাহিত্য
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান প্রত্যুষে উঠে পেটের ধান্দাটাই আগে করতে হয় রেজেকের। তাকে যেতে হয় রসু মিয়ার বাড়ি। রসু মিয়ার কাছে তিন মাস আগের পেঁয়াজ বিক্রির কিছু পাওনা বাকি পড়ে আছে। বেশ কয়েক মাস ধরে টাকাটা আটকে রেখেছে রসু মিয়া। চাইলেই শুধু গাইগুই করে। সাথে নানা রকম টালবাহানা, ওজর-আপত্তি ও ভাঁওতাবাজি প্রতিজ্ঞা। টাকাটা তুলতে পারলে কয়েক দিনের সংসার খরচটা আপাতত সামাল দেওয়া যায়। এরপর তাকে যেতে হবে লালডাঙ্গী বটতলায়। যেখানে হুজুর আস্তানা গেড়েছে, সেখানটায়। হুজুরের নাম শাহ সুফি কুতুব উদ্দিন জালালাবাদী। রসু মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পথে কুতুব উদ্দিন জালালাবাদী সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথাই শুনতে পায় রেজেক।…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান কাশিনাথপুর থেকে যে প্রধান পাকা সড়কটি পাবনা শহরে গিয়ে মিশেছে, তারই মাঝে একটি জায়গার নাম আলাদিপুর। আলাদিপুর থেকে একেবারে দক্ষিণ বরাবর আরেকটি কাঁচা রাস্তা নদীর মতো এঁকেবেঁকে নেমে গেছে লালডাঙ্গী হয়ে গাজনার বিলে। নদী ও মানুষের মন দুটোই আঁকাবাঁকা হবে, এটাই মনে হয় প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম। রেজেক আলী সদাইপাতি ভর্তি চটের থলেটি শক্ত করে ধরে কুমিরের পিঠের মতো কর্দমাক্ত রাস্তাটিতে ছোট ছেলে-মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলার মতো করে পা টিপে টিপে এগোতে থাকে লালডাঙ্গী বরাবর। আলাদিপুর থেকে লালডাঙ্গীর দূরত্ব মাইল দেড়েক। শুধু নামেই গ্রামের নাম লালডাঙ্গী। বর্ষা মৌসুমে যখন গাজনার বিল উপচে লালডাঙ্গীতেও…
-
মরিচপোড়া (শেষ পর্ব)
মরিচপোড়া (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ময়েজ শেখের বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। ভূত- তাড়ানি দেখতে জমায়েত হয়েছে প্রায় শ-খানেক লোক। ময়েজ শেখ যে ঘরটায় থাকেন সেই ঘরের বারান্দার চাল ঘেঁষে বিশাল এক নারিকেল গাছ আকাশ ছুঁয়েছে। সেই গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা মিতুজা। একটু দূরে শীতল পাটির উপর জায়নামাজ বিছিয়ে বসেছেন হেকমত কবিরাজ । তার সামনে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র-একটা বড় কাঁচের বোতল, সরিষার তেল, ধুতরাপাতা, ঝাঁটা, গামছা, ধূপ ও তিনটা রক্তরঙা লম্বা লম্বা শুকনা মরিচ। ছোট একটা মালসায় ধরানো হয়েছে আগুন। জায়নামাজে বসে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন হেকমত কবিরাজ। উপস্থিত মানুষজনদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন- আপনাদের…