-
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (শেষ পর্ব)
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (শেষ পর্ব) সৈকত আরেফিন কল্পনাসর্বস্ব জীবনানুভূতি নয়, বরং দেশ-কাল-জীবন-পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার নিরিখেই হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের মূল্যায়ন করতে হবে। বস্তুতপক্ষে, তাঁর মতো বহুবিচিত্র ও মাত্রিক বিষয় নিয়ে গল্প-উপন্যাস রচনার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের সাহিত্যে খুব বেশি নেই। ১৯৬০ সালে শকুন গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ক্রমে কথাসাহিত্যে প্রথমদিকে বিশেষত গল্পে, পরে উপন্যাসে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলেন তাঁর সৃষ্টিসম্ভারে। ‘মানুষ ও প্রকৃতির দুর্জ্ঞেয় রহস্য, শিশুর সারল্য, জীবনের ব্যাখ্যাতীত চৈতন্যকে তিনি গল্পের বিষয় করেছেন। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষকে বিষয় করে লেখা তাঁর গল্প-উপন্যাস সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র।’ ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার কারণে দেশভাগ তাঁর…
-
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৪র্থ পর্ব)
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৪র্থ পর্ব) সৈকত আরেফিন ৩. বিভাগোত্তর কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যে বেড়ে উঠে, যে সমস্ত লেখকের কথাশিল্পী বিকাশ ঘটে ষাটের দশকের কালখন্ডে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), রাবেয়া খাতুন (১৯৩৫-২০২১), শওকত আলী (১৯৩৬-২০১৮), রাজিয়া খান (১৯৩৬-২০১১), হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১), রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-২০১৯), মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) ও আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) প্রমুখ। সাহিত্যাদশের্র নিরিখে এ পর্যায়ের লেখকরা পুরনো রীতির গদ্য—মূলত গ্রামীণজীবনপ্রধান আরামপ্রিয় সাহিত্যরচনা থেকে বেরিয়ে এসে নব্য নাগরিক মধ্যবিত্তজীবনের বহুমাত্রিক জটিলতাকে অধিকার করতে চাইছিলেন। তাঁরা ‘বিরাটের জন্য, জীবনের ঐশ্বর্যের জন্য এদের ক্ষুধার কথা লিখেছেন কেউ, কেউ লিখেছেন অন্তর্লীন বিমর্ষতার কথা।…
-
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৩য় পর্ব)
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৩য় পর্ব) সৈকত আরেফিন ১৯৪২ সালে সওগাত পত্রিকায় ‘আয়েশা’ নামের একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে রশীদ করিমের আবির্ভাব হলেও তাঁর লেখকসত্তার স্ফূরণ ঘটে মূলত ষাটের দশকে। প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ (১৯৬১)-ভাষাগত বৈদগ্ধ, শাণিত বিশ্লেষণপ্রবণতা, আঙ্গিকশৈলী বিচারে সমকালীন অন্য কথাকারদের থেকে রশীদ করিমকে আলাদা করে দেয়। আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণধর্মী উপন্যাসে ‘এক বিরাট রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে আসা যে মধ্যবিত্ত এখনো স্থিত হয়নি, যার পশ্চাদভূমিতে আছে কলকাতা থেকে উৎসদেশের বেদনা নতুন সমাজের অশ্চিয়তা ও সংশয়, সর্বোপরি রাজনৈতিক মতাদর্শ প্ররোচিত আবহমান ইতিহাস ও সংস্কৃতির খণ্ডিত বিচারের দায় যে মধ্যবিত্তকে উচ্চকিত রেখেছে, তারাই এ উপন্যাসের অভিনিবেশকেন্দ্র। প্রথম…
-
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (২য় পর্ব)
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (২য় পর্ব) সৈকত আরেফিন ২. দেশবিভাগোত্তর কালে কথাসাহিত্যের বিভাগপূর্ব কালে সূচিত ধারাকে যাঁরা এগিয়ে নেন তাঁদের মধ্যে আছেন—সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১), শওকত ওসমান, সরদার জয়েনউদদীন (১৯১৮-১৯৮৬), আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করিম (১৯২৫-২০১১), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-১৯৯৭), শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৬-১৯৭১), আনোয়ার পাশা (১৯২৮-১৯৭১), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯) আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩৪-২০২২) প্রমুখ। সাহিত্যরুচির দিক বিবেচনায় বলা যায়, এ বর্গের লেখকরা কখনো গ্রাম থেকে মনোযোগ সরাননি। তবে এঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও রশীদ করিম নিজেদের পরবর্তীকালের কথাসাহিত্যে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। সত্যেন সেন বয়সে এ পর্যায়ভুক্ত অন্য লেখকদের তুলনায় বয়স্ক হলেও, বেশি বয়সে লিখতে শুরু…
-
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (১ম পর্ব)
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (১ম পর্ব) সৈকত আরেফিন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘দেশভাগ’ প্রপঞ্চটি বাঙালির মনোজগৎকে এক অব্যাখ্যেয় জটিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করে। যে আকাঙ্ক্ষা একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে দিতে পারতো, কিন্তু বিভাগোত্তরকালে জনগণের প্রতি বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাঙালির আশা ক্রমে হতাশায় রূপ নিতে থাকে। তাছাড়া সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা দুটো অঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবে সফল হবার সম্ভাবনা এমনিতেই কম ছিল। কেননা, যে প্রাচীন আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোয় পাকিস্তান রাষ্ট্র দাঁড়িয়েছিল, পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্ত কখনো তা সমর্থন করেনি। অথচ কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ ভূখন্ড তথা দেশভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের চেয়ে সমৃদ্ধ হলেও…
-
ও রিহানা (শেষ পর্ব)
ও রিহানা (শেষ পর্ব) সৈকত আরেফিন রিহানার সঙ্গে আমার নতুন জীবন শুরু হল। এরকম হবার কথা ছিল না। ব্যতিক্রম আমি পছন্দ করি না। অথচ বার বার আমাকে এই গাড্ডায় পড়তে হয়। আমার মাথার মধ্যে রিহানার জন্য একটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। বুকের মধ্যেও। শারমিন বুঝতে পারছিল আমার কিছু একটা হয়েছে। বাচ্চারাও। মেয়েটা সেদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বাবা তোমার কি অসুখ করেছে? আমার আসলে অসুখ করেছে। রিহানা-অসুখ। রিহানাকে আমি রি বলে ডাকি। ও আমাকে এবি বলে। বলে, এবি তুমি জানো না, কী জীবন আমি যাপন করি! রিহানা দিনে দিনে অনেক কথাই বলেছে আমাকে। খুব ছোট বয়সে বিয়ে…
-
ও রিহানা (১ম পর্ব)
ও রিহানা (১ম পর্ব) সৈকত আরেফিন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে দিন। কিছুতে এই ঘোর কাটছে না। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠছি, খাচ্ছি, বাইরে যাচ্ছি, ফিরে আবার ঘুমাচ্ছি। কিন্তু কিছুই যেন করছি না। রিহানা আমাকে যাদুঘোর বিহ্বলতায় বিপন্ন করেছে। সকালে ফোন দিয়েছিলাম রিহানাকে। ধরেনি। ও এখন আমার ফোন ধরে না। সিগারেটের দোকানে গিয়ে তিন প্যাকেট বেনসন এন্ড হেজেস নিলাম। সিগারেটের আগুনে কি যন্ত্রণা পোড়ে? আমার তো এমন হবার কথা নয়! ছেলে, মেয়ে বউ নিয়ে সুখে সংসার করার কথা আমার। ব্যতিক্রম কিছু আমার ভাল লাগে না। অথচ বারবার এই গাড্ডাতেই আমি পড়েছি। স্কুলে থাকতে কখনো ফার্স্ট হতে হবে—এমন কি সেকেণ্ড হবার…