সাতচল্লিশ-থেকে-একাত্তর-১ম-পর্ব
প্রবন্ধ,  সাহিত্য

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (১ম পর্ব)

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (১ম পর্ব)

সৈকত আরেফিন

 

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘দেশভাগ’ প্রপঞ্চটি বাঙালির মনোজগৎকে এক অব্যাখ্যেয় জটিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করে। যে আকাঙ্ক্ষা একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে দিতে পারতো, কিন্তু বিভাগোত্তরকালে জনগণের প্রতি বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাঙালির আশা ক্রমে হতাশায় রূপ নিতে থাকে। তাছাড়া সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা দুটো অঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবে সফল হবার সম্ভাবনা এমনিতেই কম ছিল। কেননা, যে প্রাচীন আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোয় পাকিস্তান রাষ্ট্র দাঁড়িয়েছিল, পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্ত কখনো তা সমর্থন করেনি। অথচ কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ ভূখন্ড তথা দেশভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের চেয়ে সমৃদ্ধ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্র শোষণের পথই বেছে নেয়।

তাদের এই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অসম আচরণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর সুষ্ঠু বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। পাকিস্তানি শাসকচক্র সৃষ্ট এই সামগ্রিক অসমতা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে একটি পরিকল্পিত শৃঙ্খলে আটকে দেয়। সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-উৎপাদন কাঠামো নাগরিক মধ্যবিত্তের বিকাশকেও দুরূহ করে তোলে। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে মূলত ঢাকা নগরকেন্দ্রিক একটি নতুন ও অঙ্কুরোপম মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হতে থাকে, দেশভাগের সময় তারা নবীন চারাগাছ হয়ে উঠলেও মহীরূহ হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে, অসংগঠিত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের সহজ সুযোগ পেয়ে যায় পাকিস্তানি শাসকেরা। ধর্মীয় মেলবন্ধনের নামে এদেশের ধনিক শ্রেণি ও আভিজাত্য-গর্বিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রক্ষমতা ও উৎপাদন ব্যবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠে। এরপরও গুটিকয়েক মানুষ, যারা এসব নিপীড়নমূলক আধিপত্যকামিতার বিপরীতে আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের প্রশ্নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তাদের উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিতে পাকিস্তানি শাসকেরা ধর্মকে রাষ্ট্রশাসনের কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলে।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ সাহিত্য চর্চার একাল সেকাল

পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব-অংশে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন স্বভাবতই কম মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়। নতুন রাষ্ট্রে, এতে করে উদার গণতন্ত্রকামী, মুক্ত চেতনাপন্থী, মানবতাবাদী ও মার্কসীয় চেতনাপুষ্ট শিক্ষিত প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে সামন্ত-মূল্যবোধে বিশ্বাসী পাকিস্তানি শাসকচক্রের অনুগামী শ্রেণির বিভেদরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাছাড়া, পাকিস্তানি শাসকচক্রের কেবল দমিয়ে রাখার প্রবণতায় একদিকে বৈষম্য বাড়তেই থাকে, অর্থনৈতিক সামাজিক জীবনের গুণগত পরিবর্তনও থমকে যায়।

যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নে বাঙালি জনগোষ্ঠী কিঞ্চিৎ আশাবাদী হয়ে দেশবিভাগের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিল, সে আকাঙ্ক্ষাও হতাশায় পরিণত হয়—পাকিস্তান-স্বপ্ন ভেঙে যায়। ভাষা আন্দোলনের মতো ঘটনা তো ঘটেই, ধর্মাদর্শনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের নামে পাকিস্তানি শাসকচক্রবর্গ বাংলাদেশে জাতি-শোষণ, শ্রেণিশোষণের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং ধর্মরক্ষার নামে সাংস্কৃতিক অবরোধ আরোপ করে। কিন্তু ক্রমাগত দমননীতির ফল দাঁড়ায় এই যে—উদারপন্থী বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি অস্তিত্বের প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের সক্রিয়তা, দ্বিধা ও হতাশাগ্রস্ত বাঙালিমানসকে পুনরায় জাগিয়ে তোলে এবং সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়। দেশভাগ-পূর্ব থেকে দেশভাগোত্তর সময়ে বিবিধ সংকটময় পরিস্থিতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, রক্তরঞ্জিত রাজপথের আবেগসম্ভূত চেতনাবোধ ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচন-সাফল্য পূর্ববঙ্গের মানুষের চিন্তনপ্রক্রিয়াকেই বদলে দেয়।

এহেন, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আবহে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কথাকারগণ অখন্ড বঙ্গদেশের কথাসাহিত্যের পরম্পরায় নিজেদের সৃজনশৈলীতে নতুনতর বিন্যাস আনেন। ফলত, পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের কথাসাহিত্য স্বতন্ত্রধারায় নিজের গন্তব্য খুঁজে নেবার পথে অগ্রসর হয়।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ ব্রিটিশ লাইব্রেরির কথা

১.

১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগেই যাঁদের প্রথম উপন্যাস কিংবা গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে ইতোমধ্যে লেখক হিসেবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের কারো কারো জন্ম উনিশ শতকের শেষার্ধে, কারো জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে। যুদ্ধপূর্ব পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ আর যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ কোনোভাবে মানুষের মনোজাগতিক গড়নবিন্যাসে পার্থক্য তৈরি করে দেয় কি না, তা জানা না গেলেও এই লেখকদের সাহিত্যকর্মের বিষয় ও ভাষাশৈলী পরবর্তীকালের লেখকদের চেয়ে আলাদা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বাস্তবতা যেন তাঁরা ধারণ করতে ততটা স্বচ্ছন্দ নন। ফলে, তাঁদের কথাসাহিত্যে আধুনিক  মননের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই কম।

চৌচির (১৯৩৪) উপন্যাস রচনা করে বিভাগপূর্বকালেই ঔপন্যাসিক স্বীকৃতি পেয়ে যাওয়া আবুল ফজল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের উদ্গাতা। তাঁর উদার জীবনচিন্তা ও মানবতাবোধপ্রসূত আদর্শবাদ কখনো শিল্পকে ম্লান করে দেয়, কখনো-বা সমাজ-সংস্কারের মোহ উপন্যাসের সহজ গতিকে ব্যাহত করে ঠিকই, কিন্তু তাঁর মতাদর্শ ও প্রচার-মনস্কতা যে বিশেষ শিল্পচেতনার ফল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত তিরিশোত্তর পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যরীতিকে আত্মস্থ করতে চেয়ে জীবনপথের যাত্রী (১৯৪৮) উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান কিংবা রাঙাপ্রভাত (১৯৫৭) উপন্যাসে রূপায়িত করতে চান বুদ্ধিনির্ভর সমাজতান্ত্রিক চেতনা।

আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা

কিন্তু কল্লোল গোষ্ঠীর শিল্পসফলতা তিনি স্পর্শ করতে পারেন না। কারণ আবুল ফজল পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণির মতো শত বছরের বুর্জোয়া অর্থনৈতিক অন্ত-অসঙ্গতি, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা, বুর্জোয়া মানবতাবাদের প্রতারণার অভিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিক্ষত মূল্যবোধের উত্তরাধিকার নন। পূর্ববঙ্গীয় মধ্যবিত্তশ্রেণি-ইতিহাসের পাঠ নিয়ে কল্লোলের চেতনা আবুল ফজল বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করেন বটে—জীবনের সমগ্রতা দিয়ে আত্মস্থ করতে পারেন না। এ কারণে আবুল ফজলে চেতনার শুদ্ধ জ্যামিতিক প্রমাণ আছে—মন ও মননের, ঘটনা এবং প্রতিক্রিয়ার, চরিত্র এবং ব্যাখ্যার—অনিবার্য শব্দ, বাক্য ও দৃষ্টিভঙ্গিজাত চিত্রকল্প নেই।

বিভাগপূর্ব কালে উপন্যাস পরিত্যক্ত স্বামী (১৯৪৭) দিয়ে কথাসাহিত্যজীবন শুরু করেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। প্রথম জীবনে মানবেন্দ্র রায় (১৮৮৭-১৯৫৪)-এর ‘র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র যুক্ত থেকে তাঁর যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিকতাবোধ ও সমাজপ্রগতির মানস তৈরি হয়েছিল, কথাসাহিত্য রচনায় তা বিশেষ প্রভাবদায়ী হয়। গণমানুষের সংগ্রাম ও উদার মানবতাবাদ আবু জাফর শামসুদ্দীনের গল্প-উপন্যাসে এক বিশেষ মাত্রা নিয়ে হাজির হয়। তাঁর কিছু গল্পে রঙ্গব্যঙ্গের ছোঁয়া আছে, তা আবুল মনসুর আহমদের আয়না ও ফুড কনফারেন্সকে মনে করিয়ে দেয়। ‘হনুমান রাজ’, ‘নেতা’, ‘জয়ঢাক’, ‘নৈশভোজ’, ‘আধুনিক সাহিত্যিক’, প্রভৃতির মতো গল্পে যে ব্যঙ্গ আছে তার চেয়ে ‘তালাক’, ফাঁসি’, ‘জ্যোৎস্না’, প্রভৃতি গল্পে রূঢ় বাস্তব ও জীবনের মোহভঙ্গের চিত্র নিরাসক্তভাবে ফুটে ওঠে। তাঁর উপন্যাস ত্রয়ী (Trilogy) ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান (১৯৬৩), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৭৪) ও সংকর সংকীর্তন (১৯৮০)।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনায় গ্রন্থাগার

উনিশ শতকের শেষার্ধে ওয়াহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান পড়ে কোনো কোনো সমালোচকের প্রশ্ন তোলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন কি রিভাইভালিস্ট? তা তিনি নন, কিন্তু ওয়াহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের দুটি দিক, তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে—এর ধর্মীয় বিশুদ্ধবাদ ও এর ইংরেজবিরোধী চেতনা। সংকর-সংকীর্তন ত্রয়ীর শেষখ- হলেও কাহিনি-ধারাবাহিকতায় এর স্থান ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান-এর পরেই। আবদুর রশীদের বেনামিতে নবাব আবদুল লতিফের কাহিনির সংকর-সংকীর্তন-এর কাহিনির যেখানে শেষ তার কিছু পর থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-র আখ্যানের শুরু। ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কালগত পটভূমিতে এর স্থানিক পটভূমি ঢাকা জেলার একটি গ্রাম, ঢাকা ও কলকাতা শহর। বস্তুত, আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতিতে বর্ণিত বহু ঘটনায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় উপন্যাসিক রূপ লাভ করে। তাঁর গল্পের বই জীবন (১৯৪৮), রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৮), ল্যাংড়ী (১৯৮৪)-তে সংগ্রামশীল মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ফুটে ওঠে।

আরও পড়ুন সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর: বাংলাদেশের কথাসাহিত্য-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

সৈকত আরেফিন একজন গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: পাতা ও পতত্রি, মৃদু ব্যথা হতে পারে; প্রবন্ধগ্রন্থ: সমাপ্তি-শাস্তি-অতিথি, সাহিত্য পাঠ ও পর্যেষণ। তিনি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহাম্মদপুর ইউনিয়নের আহম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!