অধ্যাপক-মুহম্মদ-মনসুরউদ্দীন-৪র্থ-পর্ব
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  গবেষক,  মাধ্যমিক বিদ্যালয়,  মুরারীপুর,  লেখক পরিচিতি,  শিক্ষাবিদ,  সাগরকান্দি,  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব,  সাহিত্য

অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (৪র্থ পর্ব)

অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (৪র্থ পর্ব)

 

ব্যক্তিত্ব: লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন সারাজীবন সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেমন থেকেছেন নিজের জীবন যাপনেও ছিলেন সাধারণ। সরল নিরহঙ্কারী, নির্লোভ এই সাধক মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার কোনো একটা সরকারি দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষ না।’ তিনি ক্ষমতা চাননি কোনো দিন। আজীবন সাধনা করেছেন। জীবদ্দশায় একটা ফোকলোর ইনস্টিটিউট করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ঘুরেছেন দেশে বিদেশে। জুতা পরতে এবং ইংরেজি পড়তে বলতেন তিনি। যদিও আপাদমস্তক ছিলেন একজন গৃহী বাউল।

“বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’-গুরুসদয় দত্ত।
হাতের কাছে হয় না খবর, কী দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর।”

লালন সাঁই এসবের উল্টো ভাসান কি ছিলেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন। যাঁর মেধা ও মননের প্রজ্ঞা ছিল সমকালের ‘সহজ মানুষ’-এর মাঝে অন্যতম। ভেতর ও বাহিরকে, দূর ও নিকটকে, দেশ ও বিদেশকে দেখার শাণিত দৃষ্টি ছিল তাঁর, যা তাঁকে করেছিল স্বাতন্ত্র্যবোধে উজ্জীবিত ভিন্ন এক মহীরুহ। সাহিত্য সাধনায় ও শিক্ষকতায় যার অফুরান নজির বিদ্যমান।

আরও পড়ুন  কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক বিমল কুণ্ডু

বিদায়ী শতাব্দীর কয়েক দশক তিনি কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকাতেই। তারপরও ক্ষণিকের জন্যও বিচ্যুত হননি হুঁকোবিলাস আর লোকসংগীত সংগ্রহের প্রিয় অনুধ্যান থেকে। তাঁর মুখে জুতা ও ইংরেজি প্রীতির কথায় বিস্ময় থাকলেও অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা হারামণির নায়ক রবীন্দ্রনাথ পড়াতে গিয়ে অবলীলায় হাজির করতেন সাদি, রুমি হাফিজ কিংবা শেক্সপিয়ার, শেলি, কিটসকে।   তাঁকে নিয়ে আসাদ চৌধুরী লিখেছেন-

“যে-গভীর সত্যবাণী নিরক্ষর গীতিকার কবিদের
ঠোঁটে ঠোঁটে কেঁদে উঠেছিলো
তাকে তুমি ছড়ালে নিখিলে। ”

বাউল-ফকিরদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অনন্য ক্ষমতা ছিল মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের। গ্রামবাংলার আমজনতার সঙ্গে একাত্ম হতে, ছোট-বড় সবার মন হরণ করতে তাঁর তুলনা মেলা ভার। শুধু কি গ্রামীণ মানুষ? শহুরে মানুষ কিংবা বিদ্বজ্জন—সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারার ঈর্ষণীয় প্রতিভা ছিল তাঁর। এ কারণে সমকালে অনেকের সঙ্গেই চেনাজানা যেমন ছিল, তেমনই ছিল গভীরতর সখ্য। এ প্রসঙ্গে আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম স্মরণ করতেই হয়, যাঁর আশীর্বাণী ও সহযোগিতায় ধন্য হয়েছিলেন তিনি। বাংলার বিশাল পথ-প্রান্তরের নামহীন, গোত্রহীন বাউল-ফকিরদের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় যোগাযোগ ও আন্তরিক সম্পর্ক, যার দৌলতেই আমরা পেয়েছি ত্রয়োদশ খণ্ডে হারামণির মতো লোকসংগীতের অমূল্য রত্নরাজি।

জহিরুজ্জামান বলেন, “এক বিকেলে শান্তিনগর গিয়েছি মনসুরউদ্দীনের বাসায়। ওনার সঙ্গে দেখা হলো, গেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি, লম্বা চুলের মানুষটি দেখলেই মনে হবে একজন সুফি সাধক মানুষ। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি করেন?’ একটা পানির মগ হাতেই উত্তর দিলেন, ‘আমরা তো সব সময় নিজেদের খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি তাই ওদের একটু খাওয়া দাওয়া দেই।’ এরপর তিনি গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছিলেন। একজন মানুষের ভাবনা এতো গভীরে অথচ তার প্রকাশ এতো সরল, তিনিই মনসুরউদ্দীন।  

আরও পড়ুন  কবি ও গল্পকার খলিফা আশরাফ

তিনি ঘুরেছেন দেশে বিদেশে। বুঝেছিলেন আমাদের প্রকৃত সম্পদ কি? কোনো নাম বা খ্যাতির জন্য তিনি এই কাজ করেননি। আপন তাগিদেই ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। নিজ শিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যা শিখতে পারিনি সাধু ফকিরদের কাছ থেকেই আমি তা শিখেছি। আমাদের সমস্ত সম্পত্তি শিক্ষিত দুর্বৃত্তরা সব বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।’ লন্ডন জাদঘর ঘুরে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বিক্রমপুর অঞ্চলের সব রত্নগুলো সেখানে ইংরেজরা লুট করে নিয়ে গেছে। ওগুলো কিন্তু নষ্ট করেনি। আদর করে সাজিয়ে রেখেছে। এখনও আমাদের যা আছে তা যোগার করে সংরক্ষণ করতে হবে। মানুষকে দেখাতে হবে। মানুষের কাছাকাছি আনতে হবে।’

প্রতিতী ঘটক, বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের বড়ো বোন। বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। তার কাছে একবার মনসুরউদ্দীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আমি একবার খুব অসুস্থ ছিলাম। প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। নানা চিকিৎসা, ওষুধ চলছিল। তারপর মাসখানেক পর বাসায় ফিরলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি তখনো। অসুস্থতার খবর জেনে এক বিকেলে মনসুরউদ্দীন স্যার আমাকে দেখতে এলেন। স্যারের হাতে ছিল দুধ ভর্তি একটা জগ। সেই দুধ খেয়ে কাটল আমার অসুস্থ শরীরের দুর্বলতা। স্যারের মতো মানুষকে কী ভোলা যায়।”

মৃত্যু:মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন  ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

মূল্যায়ন: জীবদ্দশায় তিনি গৌরবতিলক ও উষ্ণীষে অভিনন্দিত হলেও মৃত্যু-পরবর্তী তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে যে লজ্জা আমাদের আহত করে, তাঁর একটি করুণ দৃষ্টান্ত হলো মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন—যিনি আজ বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। অথচ তাঁর অবদানে আমরা কতভাবেই না প্রতিনিয়ত স্নাত হচ্ছি।

আরও পড়ুন মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (৪র্থ পর্ব)

Facebook Comments Box

আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। তিনি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!