হাইয়া-আলাল-ফালাহ্-২য়-পর্
গল্প,  বিমল কুণ্ডু (গল্প),  সাহিত্য

হাইয়া আলাল ফালাহ্ (২য় পর্ব)

হাইয়া আলাল ফালাহ্ (২য় পর্ব)
বিমল কুণ্ডু

রাতের ঝড়ে পুরো বসতির খড়ের ছাউনি উড়ে গেছে। না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর ক্ষুদ্র সঞ্চয় চারিদিকে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে। তারই শোকে কান্নার মাতম তুলেছে হাড় জিরজিরে মেয়ে মানুষের দল। পুরুষেরা শলা-পরামর্শ করছে আবার কি করে ঘরগুলি মেরামত করা যায়। নতুন করে আবার সংসার সাজাতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু ওরা পারবে। হর বছরই ওদের এগুলি পারতে হয়।

পরামর্শ শেষে গ্রামের মাতুব্বর আজিজ সরদার হুকুম দিল, সবাই বাহার চরে যাইয়া কাশবন কাইটা আনো। ডহরে শালুক পাইলে খাওনের লিগে তাও আনবা।

ঠিক এমন সময় কদম আলী আর লস্কর মাঝি কাঁধ থেকে আধামরা একটি মানুষের দেহ সেই জটলার মধ্যে নামালো। সবারই উৎসুখ দৃষ্টি পড়লো সেদিকে। অল্প বয়সের লোকটা যে রাতের ঝড়ে ভেসে এসেছে এবং সে একজন হুজুর অল্প কথায় কদম আলী তা সবাইকে শোনালো। আর এও বললো যে, পেটে কিছু খাবার পড়লেই তাড়াতাড়ি তাজা হয়ে যাবে।

গ্রামের জড়ো হওয়া মানুষগুলি পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করলো। কারো ঘরে কিছু নেই। একমাত্র আল্লাহর রহমত ছাড়া হুজুরকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

রহিম সেখের যুবতী মেয়ে হুরমতি কিন্তু বসে থাকলো না। কি মনে হতেই দৌড়ে গেল কেওড়া ঝোঁপের আড়ালে। সেখানে কাহিল হয়ে পড়ে ছিল তার আদরের গাই আর ছোট বাছুরটি। সেটাকে ধাক্কা মেরে তুলে হাতপানানি করে একটি মাটির সরায় খানিক দুধ দুইয়ে এনে হাজির করলো সবার সামনে। রহিম সেখকে উদ্দেশ্য করে বললো, বাপজান, দুধ টুকুন হুজুররে খাওইয়া দাও। কি করে একজন অজ্ঞান মানুষকে দুধ খাওয়াতে হয় তা কারো জানা ছিল না। নানা লোকের নানা মন্তব্যে সময় কাটতে লাগলো। আবার এগিয়ে এল সেই হুরমতিই। চরে কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুক এনে নিজেই আস্তে আস্তে হুজুরের মুখে দুধ দিতে লাগলো।

আরও পড়ুন গল্প উপলব্ধি

সবাই অপেক্ষা করে আছে অবস্থা কি হয় দেখার জন্য। কিন্তু আজিজ সরদার তাড়া দিয়ে উঠলো। খাওন-দাওনের ব্যবস্থা করতে হইবো। যার যার কাজে চইলা যাও। হুজুরের খেদমত মতিই করুক।

আজিজ সরদারের একটু পরিচয় দেয়া যাক। তার কিছু বেশি জমি জিরেৎ আছে। অন্যদের থেকে সম্পন্ন কৃষক। বিপদে আপদে- সবার পাশে এসে দাঁড়ায়। এজন্য সবাই তাকে মানে। এভাবেই সে গ্রামের মাতুব্বর।

আজও তারই তাগিদে সর্বহারা মানুষগুলির সারাদিনের পরিশ্রমে সন্ধ্যার আগেই সারি সারি কুঁড়েঘর আবার মাথা তুলে দাঁড়ালো। উনুন জ্বললো। শালুর জাও রান্না চলছে ঘরগুলির সামনে মাটির হাঁড়িতে। ক্ষুধার্ত ছোট ছোট শিশুরা অবিরত কাঁদছে। মায়েরা তাদের সামলানোর চেষ্টা করছে শুকনো বুক মুখে দিয়ে। বড়রা কাশফুলের ডাটা চিবোচ্ছে আর উচ্চস্বরে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু সবারই মন পড়ে আছে শাপলা শালুকের হাঁড়ির ভিতর।

কিছুদূরে কাশবনে লুকিয়ে থাকা শেয়ালগুলো হুক্কা হুয়া শব্দে একযোগে ডেকে উঠলো। এটি পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামার বারতা। রহিম সেখ তার ঘর থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ ‘আল্লাহু আকবর’ শুনতে পেয়ে ডাকলো, মতি মা’রে আয়তো এহানডায়। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মতি এসে দাঁড়ালো, কও বাপজান। রহিম বললো, কি যেন আল্লার নাম শুনলাম।

মতি জবাব দিল, হ বাপজান। হুজুর উইডা বইছে। নামায পড়তাছে।

মুহূর্তে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। জনাবিশেক লোক জড়ো হয়ে জটলা পাকালো রহিম শেখের ঘরের সামনে। হুজুর নামায পড়ছে খবর পেয়ে আজিজ সরদারও ছুটে এল। জটলা দেখে ধমকের স্বরে বললো, যে যার ঘরে চইলা যাও। মানুষডারে আগে খাড়া হইতে দাও। তারপর রহিম সেখকে একপাশে ডেকে নিয়ে নিচুস্বরে বললো, রহিম ভাই, এত লোকের খাওন দেওয়ার মুরোদ আল্লাহ তো আমাদের দেয় নাই। ঘরে ভাত রাঁধন হইছে। তার থেকে দুটো পাঠায়ে দিবাম। হুজুররে দিও। আরো কিছু কথা বলে মাতুব্বর চলে গেল।

আরও পড়ুন গল্প হাইব্রিড

যথাসময়ে ভাত এসে পৌছুলে, মতির মা মেয়েকে বললো, যা খাওন দিয়ে আয়। মতি উত্তর দিল, খাওনডা তুমি দিয়া আইস, হুজুর অহন তাজা অইছে। সামনে যাইতে শরম লাগে। মা বললো, দেহস্না আমার কাপড়ডা ফাতাফাতা। এতা লইয়া তেনার সামনে যাওন যায়? যা মা আমার, মাথায় কাপড় তুইলা ভাতডা দিয়া আয়।

অগত্যা মতি মাথায় ঘোমটা তুলে, একহাতে পানির গ্লাস ও অন্যহাতে ভাতের থালা নিয়ে নিঃশব্দে হুজুরের সামনে রাখলো। তারপর মৃদুস্বরে বললো, আপনার সামনে দেওয়ার মতন আমাগো কিছু নাই। মাতুব্বর চাচা ভাত পাঠাইছে আপনার লিগে, খাইয়া লন।

হুজুর থালা থেকে একটুখানি তুলে মুখে দিয়ে পানি পান করে উচ্চারণ করলো শোকর আলহামদুলিল্লাহ্। তারপর মৃদুস্বরে বললো, আপনে যে আমারে দুধ পান করাইছেন তাই এই দুর্বল শরীরের জন্য যথেষ্ট। রাতে আর কিছু খাব না। এটা নিয়ে যান। আপনারা খাওয়া দাওয়া করেন। আমি বরং বিশ্রাম নেই।

রহিম সেখ শোবার ঘরের পিছনে ঐদিনই ছোট একটা চালা লাগিয়েছিল রান্নার জন্য। সেখানে মা আর মেয়ের শোবার নির্দেশ দিয়ে জানালো, সে হোগলা বিছিয়ে হুজুরের পাশেই শোবে। আল্লায় না করুক কোন অসুবিধা হলে সে দেখবে।

সানন্দবাড়ীর ওপর দিয়ে যে দুর্যোগ গতরাতে বয়ে গেছে তার চিহ্নমাত্র এখন নাই। সারা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে অকাতরে। কান পাতলে শুধু শোনা যায় যমুনার একটানা কলকল ধ্বনি। সে এক অনন্ত রাগিনী। যে রাগিনীর সাথে জীবনের মিল আছে। নিরন্তর এক জীবনধারা।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

একসময় ক্ষুধার্ত শিয়ালগুলো গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে। খাদ্য খুঁজে বেড়ায় চরময়। চেটেপুটে খায় ফেলে দেওয়া শালুকের জাও খাওয়া শাপলা পাতা। তাদের নাকের নিঃশ্বাস শুকশুক করে ঘুরে বেড়ায় একপাশ থেকে অন্য পাশে ।

নিশাচর এই প্রাণীগুলোর অস্ফুট পদচারণা একজন ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না। সে হুরমতি। হুরমতি ঘুমায়নি। সে জেগে আছে। নিশ্চয়ই তার বাপজান ঘুমিয়ে পড়েছে। হুজুরের যদি কোন অসুবিধা হয়, কেউ জানতে পারবে না। সেও এই রাতে ও ঘরে যেতে পারবে না। তবুও জেগে আছে। বার বার তার মনে একটা কথা ঘুরে ফিরে আসছে, আপনে আমারে দুধ খাওয়াইছেন….। হুরমতি পাশ ফিরে শোয়। ঘরের ঝাঁপ খোলার শব্দে কান খাড়া করে। সুমধুর স্বরে ঘরের সামনে থেকে ভেসে আসে,

“হাইয়া আলাস সালাহ্, হাইয়া আলাল ফালাহ্”

গ্রামের লোক সজাগ হয়। কান পেতে কল্যাণের আহ্বান শোনে। কিন্তু কি করতে হবে কেউ জানে না। এ গ্রামে কোন মসজিদ নেই। নিরন্তর ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করা মানুষগুলো জীবনযুদ্ধে অবিরত রক্ত ঝরায় হৃদয় থেকে।

নিয়তির পরিহাস ভেবে মনে মনে ডাকে আল্লাহ্-ভগবানকে। বার বার যাদের ঘর ভাঙে, তারা আল্লাহর ঘর গড়বে কোথায়? কিন্তু গড়ে ওঠে। মাথার ওপরে দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত আকাশে যারা পরম করুণাময়ের ছায়া দেখে যুগ যুগ ধরে, একদিন না একদিন, সে ছায়া মূর্ত হয়ে ধরা দেয়।

আরও পড়ুন গল্পটির-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

হাইয়া আলাল ফালাহ্ (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!