স্নেহশীল-কজন
আত্মজীবনী,  সাহিত্য,  স্মৃতিচারণ

স্নেহশীল কজন

স্নেহশীল কজন

তাহমিনা খাতুন

 

কয়েকজন স্নেহশীল মানুষের কথা মনের গভীরে আজও ছায়া ফেলে যায়। যাদের কথা মন হলে আজও মনের গহীনে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করি। যারা আমার রক্ত সম্পর্কীয় না হয়েও আমার শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে এমন একাকার হয়ে মিশে আছেন যে, তাঁদেরকে বাদ দিয়ে স্মৃতিচারণ করাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আমাদের শৈশবে দেখেছি, যাদেরকে আমাদের গৃহস্থালী কাজে বা কৃষি কাজে নিয়োজিত করা হত, তাদেরকে পরিবারের একজন সদস্য হিসাবেই গণনা করা হত। আমার মা, চাচি অথবা ফুফুকে বায়োজ্যষ্ঠ কাউকে কখনো নাম ধরে ডাকতে বা অসন্মান করে কথা বলতে শুনিনি। তাদের অমুকের মা অথবা বাপ এমন সম্বোধন করতে শুনেছি। আমরাও ওনাদেরকে বু, চাচি, খালা, চাচা, ভাই এভাবেই সম্বোধন করতাম। শহরাঞ্চলে  গৃহকর্মীদেরকে বুয়া বলে সম্বোধন করাটাকে আমি সমর্থন করি না। আমার মনে হয় এই ‘বুয়া’ শব্দটার দ্বারা তাদেরকে তাচ্ছিল্য করা হয়।

যাহোক, আমার শৈশবে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, এমন কয়েক জনের একজন ছিলেন আমাদের পাশের গ্রাম বিরাহিমপুরের রেনুর মা বু। শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র, নিরীহ, বিনয়ী একজন মানুষ। এক সময়ে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের গৃহবধু ছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আর্থিকভাবে যথেষ্ট স্বচ্ছল স্বামী মৃত্যুবরণ করলে পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ীর সিদ্ধান্তে মৃত স্বামীর ছোট ভাইয়ের সাথে পুনরায় তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তবে স্বামীর ছোট ভাইটি ছিল মানসিক রোগগ্রস্থ। মৃত স্বামীর জীবদ্দশায় দুটি সন্তানের মা হয়েছিলেন। দেবরকে বিয়ে করার পরে আরও চারটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল। দ্বিতীয় স্বামী এতটাই অকর্মণ্য ছিল যে নিজে কোন আয় রোজগারের চেষ্টা না করে যা জমি-জমা ছিল, বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাতে শুরু করে এবং এক সময়ে সব হারিয়ে পুরোপুরি উন্মাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। উন্মাদগ্রস্থ হওয়ার পর স্ত্রী, সন্তানদের শারীরিক ভাবে মারধর করা, রাতে ঘুমাতে না দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এমন কি স্ত্রীকে দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে জনসমক্ষে নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয়ে উঠেছিল ছিল, অসুস্থ লোকটির আত্মতৃপ্তি!

আরও পড়ুন ছোটবেলার ইদ ও আমি

আমার বড় বোনের কাছে শুনেছি, রেনুর মার বু পাগল লোকটির অত্যাচারে এবং অনাহার, অনিদ্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার দয়ার্দ্র হৃদয় মা ওনাকে আমাদের পাড়ায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। বড় ফুফুমার ঘরের বারান্দার এক কোণে ঘেরা দিয়ে ছোট ছোট চারটি ছেলেমেয়ে সহ আশ্রয় জুটল এই অসহায় নারীর। একটু সুস্থ হওয়ার পর আমাদের পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে ধান ভানা, অন্যান্য গৃহস্থালী কাজে সহযোগিতা করার মাধ্যমে চার সন্তানের খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা করতেন। আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। আমি তখন অনেক ছোট হলেও মনে আছে সারাদিনের কাজ শেষে ‘বু’ আমাদের ঘরে চলে আসতেন।

বই থেকে গল্প শোনা ছিল রেনুর মা বুর প্রিয় শখ। আমার বড় বোন প্রতিদিনই ওনাকে কোন না কোন গল্পের বই পড়ে শোনাতেন! অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়া শুনে ছেলেমেয়েদের কাছে ফিরে যেতেন। তাঁর জীবনে অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা ঘটে। ওনার একটি ছেলে পুলিশ বাহিনীতে জয়েন করার সুযোগ পায়।  ‘বু’ আশায় বুক বেঁধেছিল, হয়তো এতদিনে তাঁর দুখের রজনী প্রভাত হতে যাচ্ছে। কিন্তু  বিধাতার নিষ্ঠুর খেলা বোঝা দায়। চাকুরীতে জয়েন করার কিছুদিন পরেই-দুর্ঘটনা বশত বা অন্য কোন কারণে জানা যায়নি-ছেলেটি রাইফেলের গুলিতে মারা যায়! বেচারার জীবনে সুখ আসার আগেই সুখের প্রদীপটি ঝড়ো হাওয়ায় ফুৎকারে নিভে যায়। কষ্টের জীবন যেন কোনভাবেই পিছু ছাড়ছিল না। শেষ পর্যন্ত ছোট ছেলেটি লেখাপড়া শিখে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলে, জীবনের শেষ কটা দিন একটু স্বস্তির দেখা পেয়েছিলেন রেনুর মা বু!

আরও পড়ুন শৈশবের দুঃখজাগানিয়া স্মৃতি

আরও একজন মহিলা আমাদের বাড়িতে এবং আশেপাশের বাড়িতে ধান ভানা, ঘরে ফসল তোলাসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী কাজে সহযোগিতা করতেন। ওনাকে আমরা চাচি বলতাম। মায়ের কাছে শুনেছি, উনিও বেশ অবস্থা সম্পন্ন জোতদার পরিবারের গৃহবধু ছিলেন, যাদের বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ঘোড়ায় চড়ে পশু পাখি শিকার করতেন, খাঁচায় পোষা ময়না পাখি থাকতো, যে ময়না কথা বলতে পারতো! কোন কারণে ওনার পরিবারেও দুঃখের অমানিশা নেমে আসে এবং উনি অন্য পরিবারে কায়িক শ্রমের বিনিময়ে নিজ পরিবারের অন্ন ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। মানুষের জীবন কত অনিশ্চয়তায় ভরা!

আরেকজন মানুষ ছিল যাকে ‘রাজেকের মা’ বলে ডাকতো পাড়ার সবাই। ষাটের দশকের শেষের দিকের কথা। একদিন সন্ধার কিছু আগে আমার মা দেখতে পান, অল্প বয়স্ক এক অপরিচিত নারী দুটি শিশুসহ আমাদের বাড়ির বাইরের উঠানে অসহায় ভাবে বসে আছে। শিশু দুটি কান্নাকাটি করছে। মা জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সে কয়েক মাইল দূরের এক গ্রামের বাসিন্দা। বাড়ি ঘর নদী ভাঙনে হারিয়েছে। স্বামীর কাজকর্ম নাই। দুই শিশুকে নিয়ে অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আমার মমতাময়ী মা তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে খাবার খাইয়ে, আমাদের পাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করলেন। ছোট চাচিমাকে বলে ওনার একটা অব্যবহৃত ঘরে স্বামী সন্তানসহ রাজেকের মার থাকার ব্যবস্থা হল, আশেপাশের বাড়িতে কাজও জুটলো।

অসম্ভব পরিশ্রমী এবং শারীরিক শক্তির অধিকারী ছিল রাজেকের মা। এক মনী বস্তা টান দিয়ে তুলে কোমরে বহন করা কোন ব্যাপারই ছিল না রাজেকের মার কাছে। কিন্তু ‘রাজেকের মার’ স্বামীটি ছিল অসম্ভব অলস প্রকৃতির। সারাদিন শুয়ে, বসে, ঘুরে বেড়িয়ে দিন পার করতো! স্ত্রী সারাদিন পরিশ্রম করে যা রোজগার করতো, সেটা খেয়েই সময় পার করতো। বিপদের সময় আশ্রয় দেওয়া আমার মায়ের প্রতি এই নারীর ছিল অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধ। আমার মা পক্ষাঘাত গ্রস্থ হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। ঐ সময়ে মাকে গোসল করানো, বিছানাপত্র ধুয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো রাজেকের মা অত্যন্ত যত্নের সাথে করতো। এমন একজন হৃদয়বান মানুষ পরবর্তীতে মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়  এবং বেশ কয়েক বছর ভূগে মারা যায়!

আরও পড়ুন  তৎকালীন গ্রামের চিত্র

আমাদের কৃষি কাজে সহযোগিতা করার জন্য পালাক্রমে বহু বছর ব্যাপী দুজন মানুষকে বছর চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হত। এরা দুজন যখন আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন, এদেরকে পরিবারের সদস্য হিসাবেই গণ্য করা হতো। আমরা দুজনকেই ভাই বলে সম্বোধন করতাম। এদের মধ্যে একজন ছিলেন মোন্তাজ উদ্দীন। মাকে চাচি বলে ডাকতেন। আমি যখন খুব ছোট, তখন ওনার স্ত্রী কলেরায় মারা যায়। ওনার কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আর বিয়ে করেননি! মোন্তাজ ভাই অসুস্থ হলে মা নিজের সন্তানের মতই সেবা যত্ন করতেন পরম স্নেহে! অনেক বছর যাবত আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। পরবর্তীতে নিজের ভাইয়ের পরিবারে ফিরে যান এবং তাদের সান্নিধ্যেই জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন।

আর একজন স্নেহশীল মানুষ ছিলেন গিয়াস ভাই! বহু বছর যাবত আমাদের পরিবারের একজন হিসাবেই ছিলেন গিয়াস ভাই। আমার  মা ওনার বিয়ে দেন। স্ত্রীসহ বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। আমার মা উনাদেরকে এতটাই স্নেহ করতেন যে, যখন মা পিঠা তৈরি করতেন, গিয়াস ভাই খেজুরের গুড় পছন্দ করতেন না বলে ওনার জন্য আলাদা করে আখের গুড়ের পিঠা তৈরি করে দিতেন মা।

আরও পড়ুন আমার নানী

আরও একজন স্নেহশীল মানুষের কথা ভুলবো না কোন দিন। তিনি ফকির ভাই। এক সময়ের দরিদ্র কৃষি শ্রমিক  একজন ঘরামীর ( আমাদের এলাকায় শনের ঘরের ছাউনি তৈরি করে যারা ) সহযোগী হিসেবে কাজ করে পরবর্তীতে নিজেই ঘরামী হয়ে গেলেন। এরপর কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কাজ শিখে কাঠমিস্ত্রী হয়ে গেলেন। ফকির ভাইয়ের নিকট  আমাদের পরিবারের সদস্যগণ একটা কারণে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। একবার আমার বাবা খাবার খাওয়ার সময় অসাবধানতা বশত একটা মাংসের টুকরা শ্বাসনালীতে আটকে যাওয়ায়, ওনার মারা যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল! ফকির ভাই তখন আমাদের ঘরে কোন একটা কাজ করছিলেন। আব্বার সেই সংকট কালে বুদ্ধিমান ফকির ভাই তাঁর তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে, একটা কলা গাছের ডাল আব্বার গলায় প্রবেশ করিয়ে মাংসের টুকরাটাকে ঠেলে নামিয়ে দিয়ে  আব্বার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন!

এই মানুষগুলির সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল মাত্র মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক ছিল না, বরং তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। মোন্তাজ ভাই, গিয়াস ভাই আর ফকির ভাইয়ের আদরের ‘বুনু’ ডাকটা এখনও কানে বাজে!

আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-  
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আত্রাই নদী 
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো 
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও  প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু  
মধুর স্মৃতি
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

স্নেহশীল কজন

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!