সুরেন বাবু (১ম পর্ব)
সুরেন বাবু (১ম পর্ব)
ব্রিটিশ শাসন আমল। পাবনা জেলা ছিল সিরাজগঞ্জ মহকুমার অধীন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। প্রশাসনিক সুবিধার্থে রাজনৈতিক মানচিত্রও পাল্টে যায়। এই পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাগরকান্দি ইউনিয়ন। ইউনিয়নটি নানা কারণে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। এখানে যেমন জন্ম নিয়েছে অত্যাচারি জমিদার; বিপরীতে জন্ম নিয়েছেন অনেক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ।
সাগরকান্দি বাজারের উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে রাজবাড়ির আদলে ছিল বাবুজি সুরেন্দ্রনাথ ওরফে সুরেন বাবুর আবাসিক ভবন। প্রাসাদের পিছনে ছিল পুকুর। প্রাসাদ প্রাচীরের বাইরে প্রধান ফটক সংলগ্ন সাগরকান্দি বাজার। কথিত আছে, তখন পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে ছিল এই বাজার। পদ্মা নদীর বিশাল পরিসর দেখে আদিকালের মানুষেরা পদ্মা নদীকে সাগর আখ্যা দিত। সেই কারণে বাজারটির নামকরণ হয় সাগরকান্দি বাজার। পুরাকালে এলাকাটির বেশিরভাগ অধিবাসীই ছিল হিন্দু। ইউনিয়নের সিংহভাগ জমিই ছিল তাঁর দখলে।
সুরেন বাবু ছিলেন একজন হিন্দু জমিদার। ন্যায়ের দণ্ড ছিল কদাচিৎ। প্রতাপের সাথে তিনি রাজার হালে চলতেন। শুষ্ক মৌসুমে টমটমে চলতেন। বর্ষা মৌসুমে চারিদিকে পানি থইথই অবস্থায় পানসি নৌকায় চলাচল করতেন। মুসলমানদের নামের পূর্বে শ্রী বলা ও লেখা ছিল বাধ্যতামূলক। যার প্রমাণ শতবর্ষ পুরান দলিল থেকে উজ্জ্বল দিবালোকের মত পরিদৃশ্যমান হয়। নাম আব্দুল্লাহ শেখ; অথচ লিখতে ও বলতে হতো শ্রী আব্দুল্লাহ শেখ! রহিমা খাতুন কিন্তু লিখতে ও বলতে হতো শ্রীমতি রহিমা খাতুন! তাঁর দরবারে মুসলমানদের বসার যায়গাও দেওয়া হতো না। কয়েদির মতো সবাইকে কুর্নিশ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। যেন আজন্মই পাপ!
আরও পড়ুন গল্প তৃতীয় স্বাক্ষী
কিছু মুসলমান তাঁর জমি চাষ করত। বেশি সুযোগ সুবিধার প্রত্যাশায় তারা জমিদারের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত। এমনকি নিজ জাতী ভাই মুসলমানের বিরুদ্ধেও সত্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করতে দ্বিধা করতো না! এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুসলমানদেরকে শায়েস্তা করা হত। এমনকি কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে শাস্তি প্রদানের পর হাত পা বেঁধে বস্তাবন্দি অবস্থায় রাতের আঁধারে পদ্মাগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হতো। এভাবে কত যে জীবনের প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে, তার কোনো হদিস নেই। মসজিদে আযান দিয়ে সালাত আদায় করাও দুষ্কর ছিল।
হিন্দুদের মধ্যে যারা নিম্নবর্ণের ছিল, তাদের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। জমিদার যে রাস্তা দিয়ে চলতেন, তারা সে রাস্তা দিয়ে চলতে পারতো না। একান্ত যদি চলতেই হতো, বাধ্যতামূলক এক হাতে ঝাঁটা নিয়ে পিছন ফিরে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে বাম হাতে পেন্নাম করতে করতে যেতে হতো। ওরা নাকি অস্পৃশ্য! ওদের ছায়াও যদি ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত বা জমিদারের শরীরে লাগতো রাম রাম বলে সরে যেত। যেন ঠুনকো আভিজাত্যের গতরে অমোচনীয় কলঙ্ক কালিমা লেপ্টে গেছে। গঙ্গার জলেও বুঝি শুচিতা আসবে না। চলত তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন।
মুসলমানের সন্তানেরা পাঠশালায় যেতে পারত না। বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডার থেকে দূরে রাখাই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। জমিদারকে সবাই বাবুজি বলে সম্বোধন করত। বাবুজি উম্মি মুসলিম পিতাকে ডেকে বলতেন,“পোলারে মাঠে ঘাটে কাজ করা। টাকা পাবি। তোর আর্থিক লাভ হবে। পাঠশালায় পাঠালে লাভ কী? পড়া-লেখা শিখেতো আর জজ ব্যারিস্টার হবে না। চাকিরও হবে না।” সরলমনা পিতা বাবুজির কথার যৌক্তিকতা বুঝতে পেরে পোলাকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর স্বপ্ন আর দেখে না। সত্যিইতো। পড়া-লেখা শিখে কী হবে? চাকরি যখন হবে না, মুখখো থাকাই ভালো।
আরও পড়ুন গল্প বিপরীত
মুসলমানেরা বাঁশ, নারিকেল, সুপারি গাছ লাগাতে পারতো না। তাদেরকে বলা হতো, “বাঁশ, নারিকেল, সুপারি গাছ মুসলমানদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এসব লাগালে বংশ নির্বংশ হয়ে যায়।” শনি-মঙ্গলবার নাকি বাঁশের জন্ম দিন। এসব দিনে বাঁশ কাটলে নাকি অমঙ্গল হয়। এখনো এ কুসংস্কার কোনো কোনো সমাজে বা পরিবারে মানা হয়। এভাবে অজস্র কুসংস্কারে মুসলিম সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করা হতো। অজানা আশঙ্কায় অজ্ঞতার কারণে মুসলিম সম্প্রদায় এসব কৃষ্টি মেনে চলতো।
সুরেন বাবু ‘র জমি বর্গায় চাষ করতো এক মুসলিম। বাবুজির নেক দৃষ্টি লাভের আশায় তিনি নিজ বাড়িতে উৎপাদিত লাউয়ের কচি ডগা, আর পাতা নিয়ে তার দরবারে হাজির।
-ওসব আনছ ক্যান?
-আপনার জন্য। একেবারে কচি লাউয়ের ডগা, আর পাতা। এখনো লাউ ধরেনি।
বিষয়টি বাবুজির অপছন্দ। তাই তাঁর অনুগত একজনকে ওগুলো গরুকে দিতে দিতে নির্দেশ করেন। লোকটি অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। তার ভালোবাসার এই মূল্য! এত বড় অপমান! মনে মনে ভাবে তার দ্বারা উৎপাদিত ফসল গ্রহণ করতে জাত যায় না। জাত যায় মুসলিম বাড়িতে উৎপাদিত কিছু খেলে। তবে লোকটি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, বাবুজি যাকে দেবতা মনে করেন, সেই গো-দেবতা তার লাউ গাছ কি তৃপ্তিসহই না খাচ্ছে, তা দেখে। ধন্যবাদ হে দেবতা, তোমার মনে হয় জাতধর্ম নেই। জাত যায় শুধু মানুষের। লাউয়ের সবজি খেয়ে তোমার শিরা উপশিরায় পুষ্টিগুণ প্রবাহিত হলেও তোমার সমস্যা হয় না। সমস্যা হলো পূজারির। তোমার যদি সক্ষমতা থাকে, তোমার ধর্ম যেন পূজারির আচরণেও কাজ করে। মরমে জ্বালা এবং সান্ত্বনা নিয়ে লোকটি বাড়িতে ফেরে, আর ভাবে; আচ্ছা ওরা কীভাবে নিঃশ্বাস নেয়? ঐ নিঃশ্বাসে কি অন্য ধর্মের লোকের ছাড়া বাতাস নেই? কোথায় পায় এত নির্ভেজাল আলো, বাতাস, পানি, নিত্য প্রয়োজনীয় সব? লোকটি নিজকে বুঝাতে পারে না।
আরও পড়ুন দুলাইয়ের জমিদার আজিম চৌধুরী
বাদাই নদী যমুনা থেকে উৎপত্তি লাভ করে ত্রিমোহনি হয়ে পাবনা জেলার শস্যভাণ্ডার বলে খ্যাত বিল গাজনায় প্রবেশ করেছে। এই নদীতে যারা মাছ ধরে তাদের কপালেও শনির দশা। জেলেদের জালে যে বৃহৎ বৃহৎ মাছগুলো ধরা পড়ে, সেগুলো যদি বাবুজির দরবারে না আসে তাহলে তাদের ওপর শুরু হয় বেত্রাঘাত। রক্তাক্ত হয় তাদের শরীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। পা জাপটে ধরে চরণে মাথা ঠেকিয়ে নয়ন জলে কাকুতি মিনতি করেও পাষাণের অন্তরে মায়ার উদ্রেক হয় না।
হায় ভগবান! তুমি কোথায়? তুমি কি শুধু জমিদার আর ধনিক শ্রেণির জন্য? রাত-দিন রোদ, বৃষ্টি, শীতে অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে যা পাই, তাও উজার করে দিয়ে জমিদার বা ধনি নামক দেবতাদের মন গলে না। প্রতিদিন ভোরে আর সন্ধ্যায় প্রথম সারির সেরা সেরা মাছগুলো দিয়েও মন রক্ষা হয় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকফাটা আর্তনাদে ভুক্তভোগীরা নয়নের জল ফেলে ফেলে কাঁদে। হে ভগবান, তোমাকে ডাকার ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা মুখখো মানুষ। তাই বুঝি আমাদের এই দুর্গতি। কবে পাবো এই বঞ্চনা আর অত্যাচার থেকে রেহাই? বলে দাও হে ভগবান। এভাবেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা কেউ বাড়িতে ফেরে, কেউবা নদীতে যায়।
সুরেন বাবু ‘জিরা ঘটা করে পূজা পার্বণ উদযাপন করে। সমস্যা শুধু মুসলমানদের। পাঞ্জেগানা সালাত আদায় করে, ততটা সমস্যা হয় না। সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা দেয় ঈদ-উল-আযহার গরু কুরবানি নিয়ে। তাঁর এলাকায় গরু কুরবানি করা যাবে না। এটা তাঁর কঠোর হুঁশিয়ারি। কেউ গরু কুরবানি করলে তাকেও কুরবানি করা হবে, এমন দুঃসাহসিক ঘোষণা ঢোল বাজিয়ে হাট, বাজার এবং গ্রামে গ্রামে ঘোষণা দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন সুরেন বাবু-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সুরেন বাবু (১ম পর্ব)