ওরা তেরোজন (২য় পর্ব)
ওরা তেরোজন (২য় পর্ব)
কে এম আশরাফুল ইসলাম
নিশিপুরের করম আলী সর্বহারা ছেড়ে বাড়িতে বসে আছে। এটা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। একদিন পড়ন্ত বিকেলে গোধূলি বেলায় সশস্ত্র কিছু জোয়ান এসে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তাকে ধরে নিয়ে যায়। পদ্মার কোল পার হওয়া মাত্রই একজন তার বামবাহু এক কোপে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ডান কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়! কি পাশবিক রোমহর্ষক দৃশ্য! করম আলী নির্বিকার। ও জানে ওদের কাছে কাকুতি মিনতি করা আর পাথরের সাথে কথা বলা একই কথা। পিছনে স্বজনদের কান্নার আহাজারি। নির্দয় পাষাণেরা বীরদর্পে এগিয়ে চলে। কিছুক্ষণ অগ্রসর হয়ে করম আলীকে বলে,
── এই ব্যাটা, এইখানে গর্ত কর।
নিরুপায় হয়ে হুকুম তালিম করে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাসগুলো যেন আলোর গতিতে ক্রিয়াশীল! বালিময় স্থান। রক্ত ঝরতে ঝরতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অগত্য ডান হাত দিয়েই নিজের কবর নিজেই সমাপ্ত করে। তপ্ত আঁখিজল ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে। আচমকা করম আলীর ডান বাহুটাও ওরা কেটে ফেলে! এমন পাশবিক ঘটনা করম আলী অনেক দেখেছে। নারকীয় কায়দায় কসাইয়ের মতো ক্রমান্বয়ে দুই পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে!
হায়রে জীবন! মরণের পর যদি ন্যায় অন্যায়ের বিচারই না হয়, তাহলে এই জগতে জোড় যার মুল্লুক তার-এই কথাই সঠিক। করম আলী চিন্তার জগতে যোগ দেওয়ায় প্রাক জীবন ছবির মতো ভাসতে থাকে। কী সুবর্ণ জীবনটা সে অঙ্কুরেই বিনাশ করেছে! মনে-মনে ভাবে কেউ যেন করম আলীর মতো অভিশপ্ত জীবনে প্রবেশ না করে। অনাহারে মৃত্যুও এর চেয়ে ইজ্জতের এবং কল্যাণকর। অন্তিম চিন্তা তাকে করুণ পরিণতি যেন ভুলিয়ে দিয়েছে। হায়রে মহান স্রষ্টা কর্তৃক সৃজিত অতুল অনুপম জীবন। তোর খেয়ালি ভুলের ফাঁদে কেন পা দিয়ে এ অযাচিত অকল্পনীয় মৃত্যুর শিকার। ভাবনার গহীনে সে নিমজ্জিত । জগতের শেষ নিঃশ্বাস এসে হাজির। দেহ পিঞ্জর থেকে মায়াবি পাখি আজ উড়াল দিয়ে কোথাও যেন হারিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
হাত-পা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ওরা করম আলীকে স্বহস্তে নির্মিত গর্তে লাথি মেরে ফেলে দেয়। হায়েনার মত উল্লাসে মেতে ওঠে ওরা। ওর গলাটা চেপে ধরে শেষাবধি তাকে শিরচ্ছেদ করে মাটি চাপা দিয়ে বিজয়ী বীরের মতো শীর্ষ কমান্ডের আস্তানায় সফলতার বার্তা দেয়।
রিক্তদলের নীতি হচ্ছে, দল ত্যাগ করা যাবে না। দল ত্যাগের পরিণতি কল্পনাতীত মৃত্যুদণ্ড। কারণ দল থেকে বের হয়ে গেলে তাদের অপরাধ জগতের তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে-এই আশঙ্কা থাকে। ওরা কাউকে পৃথিবী থেকে আড়াল করার আগে তার নামে লাল কালিতে লেখা পত্র পাঠায়।
করম আলীর ছোট ভাই, সহোদর বড় ভাইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি। ওর বয়স অনূর্ধ্ব তেরো। প্রতিশোধের তীব্র অনলে জ্বলতে থাকে। একই এলাকার নিঃস্ব নারদের লেখাপড়া না জানা ছেলে রবুসও রিক্তদলে ছিল। দলে নেতৃত্ব না পাওয়ায় দলছুট হয়ে ভুঁইফোড় নকশাল গঠনপূর্বক কমান্ডারের ভূমিকায় বিলগাজনায় অপরাধ জগতের রাজত্ব কায়েম করে।
অব্যর্থ নিশানার সুদক্ষ দস্যু শিরোমণি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী মলাকা। এই মলাকা যেকোনো গাড়ি ড্রাইভিং করতেও অতিশয় পারদর্শী। মলাকা নিপুণ ড্রাইভার এবং শ্যুটার। কিছু বছর আগের ঘটনা মলাকা গভীর রাতে মালভর্তি ট্রাক ছিনতাই করে সাগরকান্দি বাই পাস হয়ে অজানা গন্তব্যে যাচ্ছে। বাম হাতে ড্রাইভিং করছে এবং ডান হাতে তাক করা অত্যাধুনিক রাইফেল। ডিউটিরত এএসআই সাগরকান্দি পয়েন্টে সিগন্যাল দেওয়ামাত্রই তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করে!
আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা
নকশালের কাছে মানুষ মারা আর পাখি মারা সমান কথা। দুই গ্রুপের আদর্শ প্রায় অভিন্ন; তবে রিক্তদল নারীর ইজ্জত হরণ করে না, এই যা পার্থক্য। উভয় গ্রুপই দুর্গম এলাকায় থেকে ওদের হাই কমান্ড মোবাইলে বিভিন্ন লোকের কাছে চাহিদা প্রকাশ করে। দলের অধীনস্থরা সশস্ত্র মহড়ায় তা নির্দেশ অনুযায়ী যথাযথভাবে কার্যকর করে। চাহিদা অনুযায়ী কাজ না হলে, তাকে বিনা নোটিশে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়। লাশ পড়ে থাকে উন্মুক্ত মাঠে, বিল-ঝিলে, খালে বা নদীতে। ভোর রাতের স্বপ্ন কি সত্যিই সত্য হয়? ভাত খেতে বসে বউকে প্রশ্ন করল তারেক মাস্টার,
── এতো সত্য মিথ্যা দিয়ে কি হবে? ভাত খেতে বসে কথা বলতে নেই, আগে খেয়ে নিন।
── না খেয়ে বসে তো আর নেই। বাজারে গেলে নানা মানুষ নানান কথা বলে।
__মানুষ কি বলে?
আরও পড়ুন ওরা তেরোজন গল্পের-
ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজে
ওরা তেরোজন (২য় পর্ব)