সমকালীন-ভাবনা
প্রবন্ধ,  সাহিত্য

সমকালীন ভাবনা

সমকালীন ভাবনা

শফিক নহোর

 

সমাজের ভেতরে সমাজপতিরা একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করার পর; সমাজে নারীর প্রতি অবহেলা, যৌন নির্যাতন, হত্যা ও শারীরিক নির্যাতন বেড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী?

এ কথা কোনো ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই, সারা দেশে ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, হত্যা ও শারীরিক নির্যাতনের যেন জোয়ার বইছে। করোনাকালীন শেষ না হতেই দেশে যেন চলছে নীরব ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অতিক্রম করতে হচ্ছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মনের ভেতর সবকিছুর একটা ভয় ঢুকে গেছে। কিছুতেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। একটা সময় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রকোপ ছিল খুব, সন্ত্রাসবাদ হয়ে উঠেছিল শঙ্কিত জীবনের আরেক নাম। এখন সে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ধর্ষণ, যৌন সন্ত্রাস, নারীর প্রতি অবমাননা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানব জীবনকে করে তুলেছে বিষময়। পত্র-পত্রিকা খুললে চোখের সামনে যে নিউজ প্রতিদিন দেখতে পাই, তাতে কোনভাবেই স্বস্তি খুঁজে পাই না । হতাশা ভর করে বসে নিজের উপর। আজ সকালে দৈনিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় চোখ রাখতেই চোখে পড়ে গেল সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের একটি নারী ঘটিত নিউজ!

প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ জন নারী কিংবা কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এ দেশে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুসারে, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ১ হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুই বছর আগের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণ। ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন নারী, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে এ সংখ্যা ছিল ১৬১৩ জন। সরকারি এক হিসেবে বলা হয়েছে, অনলাইনে ৭০ শতাংশের বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এমনকি নারীরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতেও পারেন না। ঘর থেকে পথে সব জায়গায় নারীর নিরাপদ ও বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ ভাষা নিয়ে ভাবনা

গ্রামীণ জীবনে এখন চলছে নীল রঙিন এক দুনিয়া। বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের হাতে বই না দিয়ে তুলে দিচ্ছেন দামি মোবাইল ফোন। কিছুদিন আগে নবজাগরণ পাঠক মেলা (নপম) কর্তৃক সুজানগর উপজেলার সাগরকান্দিতে পাবনার দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আমি সুজানগর উপজেলার প্রায় স্কুল-কলেজের শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এক দুজন শিক্ষক বইমেলায় এসেছিলেন। আসেনি তেমন ছাত্র-ছাত্রী। অভিভাবকদেরও তেমন একটা চোখে পড়েনি। এটা আমাদের জন্য চরম লজ্জার। জাতি হিসেবে আমরা এখন অনেক পেছনে পরে আছি।

স্কুলে পাঠ্য বইয়ের বাহিরে অন্য কোন বই পড়তে দেন না শিক্ষক। এমন অভিযোগ অনেক আছে। শিক্ষকরা নিজেরা বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অথচ একজন ভাল শিক্ষক হতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের কি শিক্ষা দেবেন?  বই থেকে বিমুখ হলেই সমাজ তখন নষ্ট হতে থাকে। আমরা সে পথে হাঁটছি, এর জন্য কাকে দায়ী করতে হবে?

বড় পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার তৈরি করছি আমরা। শুধুমাত্র নিজেদের সুখি পরিবার হিসেবে মানুষের সামনে দেখানোর জন্য। সত্যিকার অর্থে তখন থেকেই সমাজ পচে যেতে শুরু করেছে। সমাজে বেড়ে চলছে, অন্যায়,অনিয়ম। তরুণ সমাজকে নিয়ে আমার যেখানে স্বপ্ন দেখার কথা, সেখানে হতাশ হয়ে যাচ্ছি তাদের বিভিন্ন কর্মেকাণ্ডে। বিশেষ করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের যে নিজস্ব অঙ্গভঙ্গি, রুচিহীন গান, নাচ তৈরি করে তা প্রচার করছে। মোবাইল ফোনের প্রতি যে আসক্তি শুরু হয়েছে এ থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের ফিরিয়ে না আনতে পারলে এবং তাদের বইমুখী না করাতে পারলে আমাদের আগামী প্রজন্ম হবে মেধাহীন। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বাবা-মাকে বই মুখী হতে হবে।

আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা

বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক জনাব, জাকির তালুকদার তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন,

‘‘মা-বাবা নিজেরা বই না পড়লে সন্তান বই পড়া শিখবে কীভাবে? নিজেরা না পড়লে সন্তানকে ভালো বই চিনিয়ে দেবে কীভাবে? আমাদের ছোটবেলায় পরিবারগুলো ছিল বড় বড়। বেশিরভাগ পরিবারে সন্তান সংখ্যা ৫, ৭, ১০ জন পর্যন্ত। মায়েদের পরিবারের কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো উদয়াস্ত। চাকুরি হয়তো করতেন না তাঁরা। কিন্তু স্বামী-সন্তান-শ্বশুর-শাশুরিকে দেখাশোনা, খাওয়ানো, গোসল করানো, রোগে সেবা করা, পথ্য তৈরি করে দেওয়া, আত্মীয়-অতিথি আপ্যায়ন করা…..সবই করতে হতো তাঁদের। সাথে ছিল নামাজ-রোজা, কোরআন পাঠ। তারপরেও মা-খালা-চাচি-দাদিদের দেখতাম, দুপুরে সবাইকে খাইয়্‌ নিজে স্নানাহার শেষ করে বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়েই চোখের সামনে বই মেলে ধরতে। মনে পড়ে লেখকদের তালিকায় দেখেছি শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আকবর হোসেন, আশুতোষ, বিভূতিভূষণ, তারাশংকরের উপন্যাস। এমনকি ডি. এল. রায়ের নাটকও।

আব্বা নাটক করতেন। কোনো কোনো দুপুরে দেখতাম খাওয়ার পরে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে মাকে পড়ে শোনাচ্ছেন বিভিন্ন নাটকের বই অথবা কোনো ম্যাগাজিন থেকে গল্প, দাদি আমাদের শোনাতেন হাদিসের গল্প, বিভিন্ন সাহাবীর গল্প, রূপকথা, রামায়ণ এবং মহাভারতের গল্প। এখনকার উচ্চ ডিগ্রিধারী মা-বাবারা নিজেরা অফিসের ম্যানুয়াল ছাড়া, পেশা সংক্রান্ত লেখা ছাড়া আর কিছু কি পড়েন? আমার আত্মীয়-বন্ধুদের এবং তাদের স্বামী-স্ত্রীদের কাউকে বই পড়তে দেখিনি। ইনফ্যাক্ট, বেশিরভাগ বাড়িতে কোনো বই বা একটি পত্রিকাও দেখিনি।”

আরও পড়ুন  আত্মকথন

মনের ভেতরে এক ধরনের ভয় ঢুকে গেছে আমাদের নতুন প্রজন্ম নিয়ে। এর ভেতর শুরু হয়েছে স্কুল ও কলেজ ছাত্ররাজনীতি ও দলীয়করণ। যা তরুণ ছাত্রসমাজকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। অভিবাবক হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব পালন করার কথা আমরা তা করছি না । এখানে পিতা-মাতার ও শিক্ষকের যে দায়িত্ব পালন করার কথা সেখান থেকে সরে এসেছি আমরা। অবশেষে মনে হচ্ছে বিভীষিকাময় অন্ধকার পথের যাত্রী কি আমাদের তরুণ সমাজ?

‘‘বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।

কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতার যে শিক্ষা, আমরা এ প্রজন্ম সত্যিই ভুলে গেছি আধুনিক হতে এসে। সব জায়গায় সমাজপতিরা তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। এরপর সাধারণ মানুষকে নিয়ে ভাবেন। সাধারণ মানুষ তাদের সেই ভাবনায় রাঘব বোয়ালদের চিন্তা কখনো মাথায় আনেন না।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!