আমাদের আত্রাই নদী
আমাদের আত্রাই নদী
তাহমিনা খাতুন
দ্বাড়িয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আত্রাই নদী। আমাদের ছেলেবেলায় দেখতাম বর্ষাকালে নদীটি কানায় কানায় পানিতে ভরে যেত। অনেক সময় যখন বেশ বড় বন্যা হত, নদীর কূল ছাপিয়ে হাইওয়ের উপর দিয়েও স্রোত বয়ে যেত। প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও বেশ কিছু দিনের জন্য বর্ষাকালীন ছুটিতে যেতে বাধ্য হত। কারণ বিদ্যালয়ের ঘরটিতেও বন্যার পানি ঢুকে পড়ত। বর্ষাকালে আত্রাই যখন পানিতে ভরে যেত, তখন কিছু লোক এক ধরনের জাল দিয়ে (যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত ‘খরা’) ট্যাংরা, পুঁটি, খলশে, ছোট আকারের শোল, বোয়াল, নলা, মৃগেল, টাকিসহ আরও অনেক ধরনের সুস্বাদু মাছ ধরতেন।
আমাদের পাড়ার বাসিন্দারা সহ অনেকেই বর্ষার প্রথম আসা পানির সে সব মাছ কিনে এনে রসনার তৃপ্তি ঘটাতেন। কিন্তু বর্ষার কয়েক মাস পরেই কোন কারণে আমাদের গ্রামের অংশে মাইল খানেক জুড়ে আত্রাই নদীর পানি পুরোপুরি শুকিয়ে যেত এবং তখন পায়ে হেঁটেই নদীর ওপারের গ্রামেও যাওয়া যেত। কয়েক বছর আগে ‘স্লুইজ গেটের’ সাহায্যে যমুনা নদী থেকে পানি এনে আত্রাই নদীর পানি প্রবাহ আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আত্রাইয়ের পানি এখন সেচের কাজসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমাদের পাশের গ্রামটির নাম বিরাহিমপুর এবং এই গ্রামের বাসিন্দারা ছিলেন মূলত কৃষিজীবী। আমাদের নিজেদের জমি-জমাসহ আমাদের ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনদের বেশীর ভাগ চাষের জমি-জমা বিরাহিমপুরের অভ্যন্তরেই ছিল।
আরও পড়ুন কামাল লোহানীর বিপ্লবমন্ত্রের প্রথম পাঠশালা
গ্রামের দক্ষিণ অংশে ছিল একটি বিল। আমাদের গ্রামটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। বৃহত্তর অংশটির বাসিন্দারা দুই একটি পরিবার ছাড়া সবাই ছিলেন প্রধানত কৃষিজীবী। আবার এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভূমিহীন। তাঁরা মূলত অন্যের জমি বর্গা চাষ করতেন। আবার অনেকেই কৃষি শ্রমিক হিসাবে দৈনিক বা বাৎসরিক পারিশ্রমিকের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে কিছুটা বিত্তশালীদের কৃষি জমিতে চাষের কাজে সহায়তা করতেন। গ্রামের যে অংশে আমাদের পাড়াটির অবস্থান, সেটি ছিল খুবই ছোট একটি অংশ। এই অংশটিতে ছিল আমাদের খুব ঘনিষ্ট কয়েকটি পরিবারের বাস। তার মধ্যে ছিল ‘কাজী পরিবার’ আর আমরা ছিলাম ‘খোন্দকার পরিবার’। কাজী পরিবারের মধ্যে ছিলেন আমার বাবার আপন ফুফাত বোনের পরিবার। আমার আপন ফুফুর পরিবার এবং ফুফুর দেবরের পরিবার এবং আরও দুই একটি পরিবার।
আমাদের গ্রামটির মধ্যে আমাদের ক্ষুদ্র পাড়াটির অবস্থান ছিল এমন একটি জায়গায় যেখান থেকে সরাসরি হাইওয়ে অথবা মাঠের কৃষি জমি কিংবা গ্রামের দক্ষিণাংশে অবস্থিত লাঙলখালি বিল-কোনটিই দেখা যেত না। কেবলমাত্র বাড়ি থেকে বের হলে হাইওয়ে থেকে পাড়ায় প্রবেশের পায়ে হাঁটা পথ বা স্থানীয় ভাবে যাকে বলা হয় ‘হালট’ যেটা ছিল পাশের গ্রাম বিরাহিমপুরের সাথে সীমানা নির্ধারণকারী ।
দ্বাড়িয়াপুর, বিরাহিমপুর, অথবা আশ-পাশের সব ক’টি গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহে এই ছোট্ট বিলটির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। বিলটির দুই পাড়েই ছিল সব কৃষিজমির অবস্থান। ধান,পাট, বিভিন্ন ধরনের রবি শস্য, শাক-সবজি, বিভিন্ন ধরনের মশলা ইত্যাদির চাষাবাদ হত বিলটিকে ঘিরে। এছাড়া বিলটি ছিল প্রাকৃতিক মাছের আধার। রুই কাতলা থেকে শুরু করে শোল, বোয়াল কই,মাগুর, শিং, টাকি, টেংরা, পুঁটিসহ আরও অসংখ্য প্রজাতির মাছে ভরপুর থাকতো বিলটি। বর্ষাকালে রুই কাতলা, মৃগেল বা নলার প্রাচুর্য দেখা গেলেও শীতের আগমনীর শুরুর দিকে অঘ্রাহায়ণ, পৌষ মাসে শোল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কই এর প্রাচুর্য ছিল দেখার মতো!
আরও পড়ুন বিল গাজনার ইতিহাস
আমার বাবার এবং ভাইদেরও ছিল মাছ ধরার প্রচণ্ড নেশা। আব্বা বর্ষা শুরুর অনেক আগে থেকেই বাঁশ দিয়ে কিছু মাছ ধরার যন্ত্র তৈরি করতেন। এগুলোর নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন খোলসে, পুঁটি, টেংরা বা এই জাতীয় ছোট মাছ ধরার জন্য তৈরি করতেন, যেগুলোকে স্থানীয় ভাবে বলা হত ‘রাবানী’। আবার মাঝারি আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল অথবা বোয়াল ধরার জন্য তৈরি করতেন ‘খাদুম’। আমার তৃতীয় ভাই মরহুম খন্দকার আবুল খায়েরের (ডাক নাম খসরু, যাঁকে আমরা ‘ছোট ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম) ছিল বড়শী দিয়ে মাছ ধরার নেশা।
শীতের শেষের দিকে অর্থাৎ মাঘের শেষে বা ফাল্গুণের প্রথমে লাঙ্গলখালী বিলে শোল, বোয়ালের প্রাচু্র্য ছিল। এই সময় ছোট ভাই প্রতিদিন সন্ধায় বিলে বড়শী ফেলে আসতেন। পরদিন সকালে দেখা যেত আট দশটা বড়শীতে বিশাল সাইজের শোল। যা প্রায় লালচে রঙ ধারণ করেছে। বোয়াল যা বড়শীর ধারণ ক্ষমতার বাইরে থাকায়, বড়শী থাকতো ছোট ভাইয়ের কাঁধে আর মাছগুলো থাকতো মাটিতে। ছোট ভাই বিশাল আকৃতির শোল, বোয়ালের বড়শীগুলোকে কাঁধে ফেলে মাছগুলো টেনে টেনে বাড়িতে নিয়ে আসতেন।
আবার পানি যখন প্রায় বিলের তলানিতে চলে যেত, তখন ‘পলো’ দিয়ে চলতে মাছ ধরা। এছাড়া বিলের কিছু কিছু জায়গায় ছোট ছোট খাল কেটে কচুরীপানায় ঢেকে রাখা হত। বর্ষায় যখন বিলে পানি আসত, সাথে আসতো প্রচুর মাছ। আর এগুলো আশ্রয় নিতো ওই সব খালে। শীতের শেষ দিকে যখন বিলের পানি প্রায় শুকিয়ে যেত তখন যে সমস্ত পরিবারের লোকজন মিলে খালগুলো কাটত তারা খালের পানি ছেঁচে মাছ ধরে আনত এবং নিজেদের মধ্যে সেগুলো ভাগ করে নিত। একেকজনের ভাগের পরিমাণও হতো বেশ বড়।
আরও পড়ুন আত্মকথন
আবার বর্ষার শুরুতে যখন আত্রাই নদী পানিতে ভরে যেত, তখন জেলেরা এক ধরনের জাল ফেলে মাছ ধরত, যাকে স্থানীয় ভাবে বলা হতো ‘খরা’। আবার বর্ষার পানিতে যখন আমাদের আশে-পাশের পচা ডোবা নালা পানিতে ভরে যেত, তখন দূর-দুরান্তের বিভিন্ন জায়গার কিছু মানুষ বাঁশের তৈরি এক ধরনের মাছ ধরার ফাঁদ ওই সব ডোবায় ফেলে যেত এবং শীতের শুরুতে যখন খাল বা ডোবার পানি শুকিয়ে যেত তারা আবার মাছ ধরার ওই সব ফাঁদ সংগ্রহ করত। আমরা ছোটরা পরম ঔৎসুক্য নিয়ে দেখতাম ওই ফাঁদগুলো বড় বড় শিং-মাগুরে টইটুম্বুর হয়ে আছে।
মাছের প্রাচুর্যের প্রসঙ্গে একটা বিষয় উল্লেখ না করলে মনে হয় সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের বাড়ির গরু বাছুরের যত্ন নেওয়া, গাভীর দুধ দোহন করা বা আনুসঙ্গিক কৃষি কাজে সাহায্য করার জন্য বছর চুক্তিতে একজন কৃষি শ্রমিককে নিয়োগ দেওয়া হত। দুইজনই সাধারনত আমাদের বাড়িতে বছর চুক্তিতে নিয়োগ পেতেন। একজনের নাম ছিল মো. মন্তাজ উদ্দীন। আরেক জনের নাম ছিল মো. গিয়াসউদ্দীন। তাঁরা দুজনেই ছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যের মতই। আমরা তাঁদেরকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। কখনও হয়তো ঘরে মাছের যোগানের ব্যবস্থা নাই। আমার মাকে মাঝে মধ্যে ওনাদের বলতে শুনেছি, মাছের ব্যবস্থা করতে। ওনারা ফসল কাটার কাস্তে নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে পড়তেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় আকারের লালচে হওয়া ১৫/২০ টা বা তারও বেশী কই মাছ ধরে এনে মায়ের সামনে হাজির করতেন। এ সময়ের পুকুর বা নদীর চাষের মাছের সাথে সেই কই মাছের ‘স্বাদ’ কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে না!
আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামগুলো মাছ, শাক-সবজির জন্য ছিল মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। অবস্থা সম্পন্ন বা অভাবী পরিবারের লোকজনেরও বছরের বেশ অনেকটা সময় বাজারের কেনা শাক-সবজির উপর নির্ভর করতে হত না।
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আমাদের আত্রাই নদী