-
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
তৎকালীন গ্রামের চিত্র ও শৈশবের পালা-পার্বন তাহমিনা খাতুন তৎকালীন গ্রামের চিত্র আমাদের ছেলেবেলার দ্বারিয়াপুরের সাথে বর্তমানের দ্বারিয়াপুরের এখন আর কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর বা তার আগের দ্বারিয়াপুর ছিল ঘন বন-জঙ্গল, বিশাল বিশাল তেঁতুল গাছ, বিশাল আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, জামরুল ইত্যাদি গাছ-গাছালিতে ভরপুর। ছিল তাল, খেজুর, নারকেল, সুপারি। এক শান্ত গ্রাম। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠত চারিদিক। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই শোনা যেত শেয়ালের হুক্কাহুয়া রব। বনবিড়াল, মেছো বাঘ (স্থানীয়ভাবে বলা হত বাঘ ডাঁশ) ঘরের আশেপাশে উঁকি-ঝুঁকি দিত। বাড়ির আশেপাশে ঝোপ জঙ্গলে সজারু, বেজী, বুনো খরগোশের (যাকে স্থানীয় ভাষায়…
-
ইতিহাস-ঐতিহ্যে দ্বারিয়াপুর
ইতিহাস-ঐতিহ্যে দ্বারিয়াপুর ~ আজিজুল কায়সার দ্বারিয়াপুর গ্রাম পরিচিতি : পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহাম্মদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত দ্বারিয়াপুর গ্রাম। পুরো গ্রামটি রয়েছে ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের দক্ষিণে গা ঘেঁষে। হযরত শাহ সুলতানের স্মৃতি বিজড়িত পূণ্যভূমি এই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র হলো বাস স্ট্যান্ড, চৌরাস্তা মোড়। পাবনা থেকে দ্বারিয়াপুরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানকারী গ্রামীণ এবং রবি কম্পানির সুউচ্চ দুইটি টাওয়ার। একশত গজ সামনে ঈদগাহ ময়দান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দ্বারিয়াপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও বিশাল খেলার মাঠ, ডান পাশে রয়েছে একটি মসজিদ। গ্রামের ইতিহাস ও নামকরণ : উত্তরে আত্রাই নদী, দক্ষিণে গাজনার বিল সহ এই অঞ্চল ছিল এক সময় যমুনা নদীর সাথে…
-
আত্মজীবনী, আহম্মদপুর, দ্বারিয়াপুর, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে সুজানগর, লেখক পরিচিতি, সাহিত্য, সৈয়দপুর (আহম্মদপুর)
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলি
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলি তাহমিনা খাতুন ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। সে নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি ৮১টি আসনে জয়লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল। সবার আশা এতদিনে বাঙ্গালীর হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাঙ্গালীর স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেরি হলো না। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গণ রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ…
-
আমার শিক্ষাজীবন
আমার শিক্ষাজীবন তাহমিনা খাতুন আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করলাম। পূর্বসূরী বড় বোনদের চেয়ে আলাদা নয় আমার গল্প! উচ্চশিক্ষার সুযোগের অভাব। প্রায় বছর খানেক কেটে গেল ঘরে বসেই। আমার তৃতীয় ভাই মরহুম খন্দকার আবুল খায়ের (বড় তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ হওয়ায় আমরা ছোট ভাই-বোনেরা তাঁকে ‘ছোট ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম) যাঁর অবদান আমার জীবনে সবচেয়ে বেশী। শুধু আমার জীবনে নয়, আমার ছোট আরও তিন ভাই, বোনের জীবনেও ছোট ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য! ছোট ভাই নিজে তখন ঢাকায় সামান্য বেতনে একটি চাকুরীর পাশাপাশি নৈশ কলেজে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছিলেন। ছোট ভাই ছুটিতে বাড়ি এলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন কি করে সময়…
-
ভাই-বোনদের কথা
ভাই-বোনদের কথা তাহমিনা খাতুন আমারা মোট এগারো ভাই-বোন। আমাদের সবার বড় ভাই মরহুম খন্দকার আবু তাহের। আমাদের বড় ভাইকে আমরা ‘মিয়াভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। মিয়া ভাই বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রাম থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, মিয়া ভাই আমাদের গ্রাম থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে ধোবাখোলা করোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন, আমার জন্মেরও আগে! মাত্র ৫ম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া এক বালক নিজ পরিবার ছেড়ে দূর গ্রামের অপরিচিত এক পরিবারে ‘লজিং’ বা ‘জায়গীর’ থেকে লেখা-পড়া চালিয়ে গেলেন। লজিং বা ‘জায়গীর থাকার’ ধারণাটা হয়তো এখন অনেকেরই অপরিচিত। বৃটিশ ভারতের শেষের…
-
আমার বাবা
আমার বাবা তাহমিনা খাতুন আমার বাবা মরহুম খন্দকার আবুল কাসেম। আমার বাবার শিশুকালটি শুরু হয়েছিল নিতান্তই দুঃখের মধ্য দিয়ে! অত্যন্ত অল্প বয়সে আমার আব্বা তাঁর ছোট দুই ভাই বোনসহ পিতৃ-মাতৃহীন হন। এতিম তিন শিশু তাঁদের নানী এবং খালাদের স্নেহ-মমতায় লালিত পালিত হন। আমার বাবার কাছে শুনেছি ওনার নানী খালারা আরবী এবং ফারসী শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। আব্বা তাঁর নানী খালাদের নিকট আরবী এবং ফারসী ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন, তবে আব্বার বাংলা ভাষাতেও চমৎকার দখল ছিল। তাঁর বাংলা হাতের লেখা এবং ভাষাশৈলী ছিল অত্যন্ত গোছালো এবং পরিপক্ক। আব্বার সুনিপুণ হস্তাক্ষর এবং ভাষাশৈলী ছিল যে কোন উচ্চ শিক্ষিত মানুষকে চমৎকৃত করার মতো। আব্বার…
-
আমাদের আত্রাই নদী
আমাদের আত্রাই নদী তাহমিনা খাতুন দ্বাড়িয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আত্রাই নদী। আমাদের ছেলেবেলায় দেখতাম বর্ষাকালে নদীটি কানায় কানায় পানিতে ভরে যেত। অনেক সময় যখন বেশ বড় বন্যা হত, নদীর কূল ছাপিয়ে হাইওয়ের উপর দিয়েও স্রোত বয়ে যেত। প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও বেশ কিছু দিনের জন্য বর্ষাকালীন ছুটিতে যেতে বাধ্য হত। কারণ বিদ্যালয়ের ঘরটিতেও বন্যার পানি ঢুকে পড়ত। বর্ষাকালে আত্রাই যখন পানিতে ভরে যেত, তখন কিছু লোক এক ধরনের জাল দিয়ে (যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত ‘খরা’) ট্যাংরা, পুঁটি, খলশে, ছোট আকারের শোল, বোয়াল, নলা, মৃগেল, টাকিসহ আরও অনেক ধরনের সুস্বাদু মাছ ধরতেন। আমাদের পাড়ার বাসিন্দারা সহ অনেকেই বর্ষার…
-
আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম তাহমিনা খাতুন পাবনা জেলার তৎকালীন সুজানগর থানার দ্বারিয়াপুর গ্রামে আমার জন্ম। পাবনা তখন দুই মহকুমা বিশিষ্ট বৃহত্তর জেলা। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের সতেরটি জেলার মধ্যে দুই মহকুমা বিশিষ্ট একটি জেলা পাবনা। পাবনা সদর ও সিরাজগঞ্জ। মূল পাবনা জেলার সদর অংশে আমার জন্ম। আমাদের গ্রামটির অবস্থান পাবনা শহর থেকে পাবনা-রাজশাহী হাইওয়ের ছাব্বিশ মাইলের মাইল ফলকের সাথেই। শহরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার অভাবকে যদি প্রত্যন্ত গ্রাম বা অজপাড়া গাঁ হিসাবে মূল্যায়ন করতে চাই, তবে দ্বারিয়াপুরকে ‘প্রত্যন্ত গ্রাম’ বা ‘অজপাড়া গাঁ’ বলা যাবে না। আবার শিক্ষা ব্যবস্থা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার দিক থেকে বিবেচনা করলে দ্বারিয়াপুরকে গণ্ডগ্রামও বলা যাবে…