-
বই চোর // শেষ পর্ব // ছোটোগল্প // সাইফুর রহমান
বই চোর // শেষ পর্ব সাইফুর রহমান ইন্দ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, — একটা সিগারেট দে। অনেকক্ষণ হলো সিগারেট ফুঁকা হয়নি। নিকোটিনের প্রচণ্ড অভাব বোধ করছে শরীর। সিগারেটের কৌটাটি এগিয়ে দিতে দিতে ইন্দ্রনাথ সুনীলকে উদ্দেশ করে বলল, — বেশ জম্পেস ধরনের একটি বই সংগ্রহশালার সন্ধান পেয়েছি জানিস। সুনীল সিগারেট জ্বালানো বন্ধ রেখে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, — বলিস কী, কোথায়? — মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে। পরিত্যক্ত বনেদি জমিদারের এক প্রাসাদে। বাড়িটি নিয়ে অবশ্য ওয়ারিশদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু সেই বাড়ির পাহারাদারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। দারোয়ানটির নাম লজপত সিং। জাতিতে রাজপুত। ওর পূর্বপুরুষ অনেককাল আগে চলে এসেছে বাংলায়। আমি কয়েক…
-
বই চোর // ১ম পর্ব // ছোটোগল্প // সাইফুর রহমান
বই চোর // ১ম পর্ব সাইফুর রহমান সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ যেখানে শেষ হয়েছে, তার থেকে ঈষৎ আগে শ্যাওড়া গাছসদৃশ একটি পাকুড় বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। বনসাই আকৃতির এই গাছটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সম্ভবত বেশ কিছুকাল ধরে। পাকুড়গাছের ছায়ার নিচে সস্তা টিন দিয়ে ছাওয়া ঘুপচির মতো যে চায়ের দোকানটি আছে, সেখানেই দুপুর ১২টা নাগাদ অপেক্ষা করার কথা ছিল সুনীলের। দুপুরের দিকে চায়ের দোকানটি অপেক্ষাকৃত নির্জন থাকে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়লে পাকুড়গাছটির সুশীতল ছায়া পড়ে চায়ের চালাঘরে। তখন সেখানে মানুষের জমায়েত হয়। কোলাহল বাড়ে। চায়ের এই দোকানটি অবশ্য এ অঞ্চলটিতে মোহনমিয়ার চায়ের দোকান নামে পরিচিত। সুনীল ১২টার আগেই সেখানে এসে…
-
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (শেষ পর্ব)
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান হেনরিয়েট কবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, — আরেকটা কবিতা হয়ে যাক। কবির আবৃত্তি করতে শুরু করল, “তোমাকে চোখের মধ্যে রেখে কাঁদি, আমার দু’চোখে তুমি বিগলিত ঠান্ডা হিম, তুমি কাঁদছ, দু’চোখের একান্ত ভেতরে গলে যাচ্ছে কালো আঁখিতারা, গলে গলে একটি গাছের মতো সবুজ, তোমার মতোন করুণ হয়ে যাচ্ছে অশ্রুমালা তুমি নিথর নিরীহ দাঁড়িয়ে আছ আঁখিতারার ভেতরে, তুমি, একাকিনী সবুজ পল্লব, কাঁপছ বাতাসে সাদা হিমে…।” অস্ফুট কণ্ঠে হেনরিয়েট বলে উঠল, — অপূর্ব! অপূর্ব! এটা কার কবিতা কবির? কবির সলজ্জ গলায় বলল, — আমার। — তোমার! সম্পূর্ণ আবেগ ধরে রাখতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হেনরিয়েট। —…
-
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব)
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান বেশ কয়েক প্রকার ব্যঞ্জন প্লেটে সাজিয়ে সেগুলো টেবিলের উপর এনে রাখল শেরদিল। মুরগি ভাজা, রুটি ও চিজ পনিরের সঙ্গে রেড ওয়াইন। শেরদিল যখন রেড ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল; কবিরের মনে হচ্ছিল ওয়াইন নয়, শেরদিল আসলে পান করছে বাংলাদেশের মানুষের রক্ত। কামড় দিয়ে যখন মাংস ছাড়িয়ে নিচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল পাকিস্তানি হায়েনা কামড় বসিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার পবিত্র শরীরে। হেনরিয়েট কাটা চামচ দিয়ে সন্তর্পণে খাবার মুখে তুলে নিচ্ছে। ও পরে আছে গাঢ় নীল রঙের লংস্কার্ট। ধবধবে সাদা শার্টের উপর অরুণ বর্ণের ছোটো ছোটো ফুল আঁকা। দারুণ লাগছে দেখতে। শেরদিলের পোশাক-পরিচ্ছেদও মন্দ নয়। আকাশি রঙের শার্টের উপর অ্যাশ…
-
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (১ম পর্ব)
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান কাবার্ড থেকে কর্নফ্লেক্সের বাক্সটা বের করতে গিয়ে কবিরের মনে হলো এত বেলায় প্রাতঃরাশ না করে একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলেই বোধ করি ভালো হতো। টানা সাত দিন একনাগাড়ে লাইব্রেরিতে কাটিয়ে কিছু একটা যে দাঁড় করানো গেছে; এটাই স্বস্তির বিষয়। প্রস্তাবনাটা প্রফেসর টার্নারকে সন্তুষ্ট করবে বলে আশা করা যায়। মণিবন্ধের ঘড়িটায় সময় দেখাচ্ছে প্রায় ১২টা। ফ্রিজ খুলে দেখা গেল কিছুই নেই ওতে। থাকবেই বা কী করে। দু’দিন হাঁড়ি চড়েনি। এটা-ওটা খেয়ে চলছে এ কদিন। পিএইচডির জন্য অভিসন্দর্ভটা লিখতে গিয়ে কালঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে। যাকে বলে একেবারে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ছুটির দিনগুলোতে প্রতিনিয়তই ঘুম থেকে উঠতে দেরি…
-
কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব)
কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান পরদিন রাতেই বিয়ে হয়ে গেল লতুর। নিতান্তই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। বরপক্ষের লোকজন এসেছিল জনা বিশ-পঁচিশের মতো। পাত্রপক্ষের ইচ্ছা এখন শুধু কাবিন করে রাখা। অগ্রহায়ণের শেষে নতুন ফসল ওঠার পর ধুমধাম করে মেয়েকে তুলে নেবে। বাড়িতে ব্যান্ডপার্টি ও সানাই না বাজলেও আহার-বিহারের কোনো কমতি করেনি তালেব মিয়া। পোলাও রোস্ট থেকে শুরু করে মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথা। মাছ, রেজালা, দই সবকিছুরই এন্তেজাম করেছিল। বরপক্ষের লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে দেশলাইয়ের কাঠি ভেঙে দাঁত খিলাল করতে করতে বলছিলেন, “তালেব মিয়ার আতিথেয়তার তারিফ না করে পারা যায় না। প্রতিটি ব্যঞ্জনই সুস্বাদু। আহা! অমন…
-
কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব)
কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব) সাইফুর রহমান সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফেরে তালেব। জোবেদা খাতুন লতুর মাথায় তেল দিচ্ছিলেন। লতুর মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে তালেব মিয়াকে উদ্দেশ করে জোবেদা বললেন, “খাবারের গামলা ও থালাবাসনগুলো ঘরের দাওয়ায় রাইখে আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। লতুর চুল আছড়ানি শ্যাষ হলি আমি আপনাক গুড়-মুড়ি দিচ্ছি।” মেয়ের পাশে বসলেই এক অজানা কারণে জোবেদা খাতুনের মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। যদিও লতুর গায়ের রংটা খোসা ছাড়ানো তেঁতুলের মতো কিন্তু মেয়ে তার দেখতে বেশ আকর্ষণীয়া। দীর্ঘাঙ্গী। সব সময় পরিচ্ছন্ন পরিপাটি চলাফেরা। লতুর শরীর থেকে সবসময় জবাকুসুম তেল আর শিউলিফুলের সুবাস মেশানো সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়। জোবেদার ইচ্ছা…
-
কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব)
কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব) সাইফুর রহমান তালেব মিয়াকে দেখলে যে কোনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরই চমকে ওঠার কথা। এত মানুষ নয়, যেন জীবন্ত এক কঙ্কাল। পার্থক্য বোধকরি এতটুকুই, যেখানে মানুষ সাদা কঙ্কাল দেখে অভ্যস্ত, সেখানে হয়তো তারা দেখে জাজ্বল্যমান কালো এক কঙ্কাল। মুখ বুজে কাজ করছে কামারশালায়। লিকলিকে, দির্ঘাঙ্গী ও কুচকুচে কালো হাত-পাগুলো এতটাই শীর্ণ যে, শরীরের হাড়গুলো যেন চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসার জন্য সদা উন্মুখ। হাড়চর্মসার মানুষটি যখন উবু হয়ে বসে হাপরটা টানতে থাকে, তখন খানিকটা দূর থেকে সত্যি বোঝা যায় না কোনটা হাপর আর কোনটা তার পেট। জীর্ণ ও কৃষ্ণাভ লুঙ্গিটা হাঁটু ডিঙ্গিয়ে চলে যায় একেবারে উরু…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (শেষ পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (শেষ পর্ব) সাইফুর রহমান চিনেখরা ব্রিজ থেকে আনুমানিক বিশ-বাইশ গজ দূরে কিছুটা ঝোপঝাড় ও জঙ্গল গোছের একটি জায়গা বেছে নিয়ে, সেখানে লম্বা আড়াআড়িভাবে বড় একটি বাঙ্কার খনন করা হলো। এন্তার ও ফেকের দুজনেই পেশায় কামিন। মাটি কাটা তাদের নিত্যদিনের অভ্যেস বলে খুব দ্রুতই বাঙ্কারটি খোঁড়া হয়ে গেল। তবে রেজেকসহ অন্যরাও হাত লাগাল সমানতালে। বাঙ্কারটি খনন করা হলো গলাসমান করে, যাতে মাথাটি ঈষৎ উঁচু করে যুদ্ধ করা যায়। ১৫ তারিখের আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেল। ঢাকা থেকে ডিনামাইট ও প্রয়োজনীয় রসদগুলো সময়মতো চলে এসেছে ক্যাম্পে। এখন শুধু এখানকার কিছু প্রস্তুতি। ১৪ তারিখ ভোর রাতে লোহার ব্রিজটার…
-
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৪র্থ পর্ব)
একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (৪র্থ পর্ব) সাইফুর রহমান এবারের অপারেশন হবে বনকোলা নামক গ্রামে। সেখানে জনা পঞ্চাশেক মিলিটারির একটি ক্যাম্প গঠিত হয়েছে। যেকোনো মূল্যে সে ক্যাম্পটিকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। বনকোলা গ্রামটি একেবারে গাজনার বিলের তীর ঘেঁষে। সেই হিসেবে জলপথেই আক্রমণ সবচেয়ে সুবিধা ও নিরাপদ। তিনটি নৌকায় তোলা হলো মোট বিশ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুটি ভাউলিয়া নৌকা ও একটি জেলে ডিঙি। ভাউলিয়া নৌকাটির পেছন থেকে অর্ধেক পর্যন্ত বাঁশের শক্ত চাতালের মতো ছই। সামনেরটুকু একেবারেই ফাঁকা। এতে করে বেশ সুবিধাই হয়। পাকসেনাদের নিয়োজিত অনুচরদের আর সন্দেহ থাকে না যে সেগুলোতে আসলে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে। ভাউলিয়া নৌকাটি ক্ষুদ্রাকার, অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যবর্জিত ও হালকা। অপেক্ষাকৃত কম…