স্বপ্ন-জল-শেষ-পর্ব
গল্প,  মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান,  সাহিত্য

স্বপ্ন জল (শেষ পর্ব)

স্বপ্ন জল (শেষ পর্ব)

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান

 

মাঝে মধ্যে দু’জনের ক্যাম্পাসে দেখা হয়, হাই-হ্যালো হয়। তারপর চলে যায় যে যার গন্তব্যে। একদিন শিলা সীমান্তের কাছে এলো। বললো,

__ভাই, আমি একটু সাহায্য চাই আপনার। তবে সাহায্য তো প্রায়ই করেন। এবার একটু ভিন্ন বিষয়।
__বলো।
__দুই একদিন বিকেলে ক্যাম্পাসে আপনি আমাকে সময় দিবেন। কারণ আমি বিপদের মধ্যে আছি। আমাকে অনেকেই বিরক্ত করে। আর সে-তো আছেই। সে আমার কাছে অনেক ক্ষমা চায়, মাফ চায়। আমি আর কোনো প্রেম-ভালোবাসায় জড়াবো না। আমি আমার সবকিছু গুছিয়ে রাখছি ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের জন্য। আমি বিসিএস পাস করলে আমার সব স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব। তাই আপনি যদি সময় দেন তবে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। কারণ তারা জানে না, ‘পথ খুঁজে যায় পথের সীমানায়, আমার ঝাপসা চোখের বারান্দাতে দীর্ঘ শ্বাসের জল’। আমি আর পারছি না ভাই, প্লিজ। আপনি না করবেন না। সীমান্ত দেখলো এমন সুযোগই তো সে চায়। কারণ তার মধ্যে শিলার প্রতি যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে বিষয়টি তাকে বলা যাবে।
প্রায়ই তাদের কথা হয়। ক্যাম্পাসে চা-কফি ও টিএসসির সিঙাড়ার স্বাদ মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু একবারও সীমান্ত বলতে পারে নাই নিজের কথা। যখনই বলতে চায় শিলা ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। বলে,
__সবাইকে দিয়ে সব কিছু হয় না, করাও যায় না। ধরেন ব্লেড খুব ধারালো কিন্তু গাছ কাটা যায় না। কুড়াল খুব শক্তিশালী কিন্তু চুল কাটা যায় না। তেমনি প্রত্যেক বস্তুই তার নিজ কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি মানুষেরও রয়েছে অতুলনীয় প্রতিভা। তাই অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা উচিত।
শিলা বলছিল,
__আমার ছোট্ট ছোট্ট সময় ও টিউশনিতে মেধা ‘সেল করছি’ স্বপ্ন কিনবো বলে।

আরও পড়ুন গল্প রোদেল দুপুর কাঁদে

বহুদিন গড়িয়েছে। কিন্তু সীমান্ত তার কথা বলতে পারে না। যদি ফিরিয়ে দেয়। তাছাড়া ওর কাছে ছোট হওয়াও সম্ভব নয়। যদি মনে করে সীমান্ত ওর দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। বিধায় বলা হয়ে ওঠে না। যদি ওর স্বপ্ন পূরণ হয়, তবে একদিন হয়তো নিজের থেকেই বলতে পারে। না হলে তখন বলা যাবে। এমন ভাবনা থেকে সীমান্ত শিলাকে তার ভালোবাসার কথাগুলো হৃদয়ে জমা রেখেছে। হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয় না, তাও না। কিন্তু নিজের কৃতজ্ঞতা বোধের কাছে সে পরাজিত। সেদিন সীমান্ত বলছিল,
__তুমি তো বিসিএস পাশ করলে আমাকে ভুলেই যাবে।
শিলা বললো,
__’কেউ চায় না কাউকে ভুলতে কিন্তু সময় ভুলিয়ে দেয়, কেউ চায় না কাউকে হারাতে কিন্তু ভাগ্য ছিনিয়ে নেয়। এই হলো বাস্তব, পৃথিবীতে যা চাই তা পেতে না পেতেই হারাই’। __দেখা যাক, সময়ই বলে দিবে কে কাকে ভুলে। নাও তো ভুলতে পারি।
__হয়তো উল্টোও হতে পারে। সীমান্ত বলতেই মুখের কাছে হাত এনে শিলা বললো,
__আপনার চাইতে Google অনেক ভালো, কারণ সে অর্ধেকটা লিখলে বাকিটা বুঝতে পারে।
বেশ কয়েক বার সীমান্ত শিলাদের বাড়িতে গিয়েছে। শিলা তার মায়ের সাথে সীমান্তকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বলেছে,
__মা সীমান্ত ভাই আমার গার্ডিয়ান। সে আমাকে দেখভাল করে। তার সহযোগিতা না পেলে পড়ালেখা হতো না।
সীমান্ত যদিও প্রতি উত্তর দিয়েছে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয় নাই। শিলা মাকে খুব ভালোবাসে। বলে,
__এখন মা-ই তার সব।
জানেন সীমান্ত ভাই,
__মায়ের কোল যে কত বড় জিনিস তা একজন যোগ্য সন্তান ছাড়া আর কেউ জানে না। শত চিন্তা আপনার মাথায়, একবার মায়ের কোলে মাথা রাখেন, দেখবেন সব চিন্তা দূর হয়ে যাবে। দুনিয়ার যেখানেই যান না কেন মায়ের কোলে যে শান্তি তা কোথাও খুজে পাবেন না।

আরও পড়ুন গল্প পথভোলা এক পথিক

দিন গড়িয়েছে অনেক। বহুদিন টিএসসি চত্বরে নিজেদের সাথে কথা হয়েছে। এরই মধ্যে শিলার বিসিএস এর ফাইনাল ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন রেজাল্টের অপেক্ষায়। কোন ক্যাডার পাবে এই নিয়ে কথোপকথন হয়েছে কতবার। শিলার পছন্দ প্রশাসন ক্যাডার। এজন্যই প্রথম চয়েজ দিয়েছে প্রশাসন। প্রশাসনে চাকরি তার ভালো লাগে। শিলা বলে,
__হয় হবো পুলিশ, না হয় প্রশাসক।
পরীক্ষা তার অনেক ভালো হয়েছে। পরীক্ষা শেষে এখন সে আজিমপুর একটা মেসে থাকে। প্রায়ই ক্যাম্পাসে কথা হয়। এখন যে টিউশনি করে, সে ছাত্রীর বাবা ইতালীতে থাকে। শিলা দীর্ঘদিন তাদের পড়ায়। তার ছাত্রীর বাবা এবার এসে তার পরিবারকে ইতালিতে নিয়ে যাবে। তাই চিন্তা, নতুন টিউশনি খুঁজতে হবে তার।
__জানেন সীমান্ত ভাই, প্রতিটি ঈদ এলেই আমার কান্না পায়। এই চোখে কত জল! মনে হয় সমুদ্রেও এত জল নেই। এই সামান্য বয়সে কতই না চোখের জল আমাকে ফেলতে হয়েছে। সামনে আবার রোজা, তারপর ঈদ। প্রতিবারই ঈদে বাড়ি যাই। মা পথের দিকে চেয়ে থাকে, না গেলে কষ্ট পায়। সেজন্যই যেতে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই তার একমাত্র অবলম্বন। সে বার টিকিট না পেয়ে একটা টিকিট খুঁজতে গিয়েই, আল্লাহ আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এখন আপনিই আমার অবলম্বন। কখন কে কার কাজে লাগবে কেউ বলতে পারে না।
সীমান্ত বললো,
__তুমি তো আমার পাত্তাই দাও না।
__কি বলেন? আমার এমন কোনো কথা নেই যে, আপনাকে শেয়ার করি না।
__তা কর। কিন্তু…..
__কিন্তু আবার কী? সময়ে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। ‘যখন কেউ কারো জন্য কাঁদে, সেটা হল আবেগ। যখন কেউ কাউকে কাঁদায়, সেটা হলো প্রতারণা। আর যখন কেউ কাউকে কাঁদিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলে সেটাই হলো প্রকৃত ভালোবাসা। কাউকে ভালোবাসি বোঝার সবচেয়ে বড় অনুভূতি হল, তাকে ভেবে কান্না করা।’ আমি সব কিছুর স্বাদই পেয়েছি। সুতরাং ভালোবাসাবাসি বলে কিছু নেই। এগুলো হৃদয় দিয়ে বুঝে নিতে হয়।

আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা

চীনের উহান প্রদেশ থেকে নতুন ভাইরাস ছড়িয়েছে, নাম করোনা (কেভিড-১৯)। যার কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয় নাই। বিশ্বজুড়ে নতুন আতঙ্ক। এরই মাঝে দেশে দেশে লকডাউন করা হয়েছে। বাংলাদেশও চিন্তিতো। বাংলাদেশের বহু মানুষ বিদেশে অবস্থান করে। ইতালিতে মরণ ব্যাধি করোনার প্রভাব বেশি। ছাত্রীর পড়ানো শেষে তার মা শিলাকে মাসের টিউশন ফি দিয়ে বললো,
__এখন আর পড়াতে হবে না। খবর দিলে আসবেন।

বাংলাদেশ সরকার দুপুরে ঘোষণা দিলো। আজ থেকে সকল সরকারি অফিস বন্ধ করা হলো। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত কল-কারখানা সব বন্ধ হয়ে গেল। বাজার দোকান পাট, শপিং মল বন্ধ। যান চলাচল বন্ধ। দুইদিন পর সবকিছু লকডাউন। সারা পৃথিবী লকডাউন। বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের দেশে ঢুকলে কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হচ্ছে। বিদেশিদের যাতায়াত সীমিত করা হয়েছে। বাইরের কারও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গ্রামেও বিদেশ অথবা শহর থেকে কোনো লোক আসলে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হচ্ছে। এমন অবস্থায় শিলা আর বাড়িতেও যেতে পারে না। তাছাড়া বিসিএস পরীক্ষার রিজাল্টও হওয়ার কথা।

আরও পড়ুন গল্প কাঠগোলাপ ও প্রেম

কয়েকদিন পর শিলার ঠান্ডা-জ্বর হলো। স্থানীয় ঔষধের দোকান থেকে প্যারাসিটামল কিনে খেলো। এর মধ্যে মেসে সে অনেকটা একা। এমন অবস্থায় সবাই বাড়িও চলে গেছে। শিলা ভেবেছে একটু স্বাভাবিক হলেই সেও চলে যাবে। এখানে ভীষণ কষ্ট। দোকান-পাট বন্ধ। বাড়িওলাও তাড়া দিচ্ছে চলে যেতে। এমন অবস্থায় শিলার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সীমান্ত তার বোনের বাড়িতে উঠেছিল। সেও বাড়ি যেতে পারে নাই। শিলা সীমান্তকে ফোন দিয়ে বললো,
__ভাই, আমি খুব অসুস্থ। আপনি যদি একটু আসতেন, ভালো হতো।
সীমান্ত এসে দেখলো, শীলার করোনা রোগের লক্ষণ। তারাতাড়ি আইইডিসিআর-এ খবর দিলো। তারা শিলার টেস্টের ব্যবস্থা করলো। জানা গেল, ‘তার করোনা হয়েছে।’ এলাকা লকডাউন করা হলো। তাকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলো। যাবার সময় শিলা বললো,
__ভাই, আমার মাকে বলার দরকার নেই, মা শুনলে বাঁচবে না।
সীমান্ত শিলার সাথে গেল। সম্ভাব্য সব ধরণের সহযোগিতা করলো। বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। প্রতিদিনই সীমান্ত হাসপাতালে যায়, খোঁজ খবর নেয়। সকাল ১০ টার দিকে শিলার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ডাক্তার-নার্স চেষ্টা করছে। ১১ টার দিকে খবর এলো, শিলা মারা গেছে। সীমান্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় ‘থমকে গেল সারা পৃথিবী।’ সীমান্ত এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। শিলা তাকে ভালোবাসা না দিতে পারলেও ‘চোখে সমুদ্রের জল’ উপহার দিয়ে গেল। এমন সময় মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।
__হ্যালো…
__বাবা সীমান্ত, আমি শিলাকে ফোনে পাচ্ছি না। সে তো ফোন ধরে না। শিলার ফোন মনে হয় হারিয়ে গেছে। তুমি কোথায়? শিলাকে বলবে, ‘শিলার বিসিএস হয়েছে।’ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বাবা…

আরও পড়ুন স্বপ্ন জল-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

স্বপ্ন জল (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক হিসেবে সমধিক পরিচিত। প্রকাশিত উপন্যাস: চেয়ারম্যান হবো, ভোরের কুহেলিকা; কাব্যগ্রন্থ: নষ্ট ভালোবাসা, গল্পগ্রন্থ: সিডরের সেই রাত এবং তারপর..; ভ্রমণকাহিনী: নোবেলের দেশে শান্তির দেশে; গবেষণা গ্রন্থ: বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গবন্ধু। তিনি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের গুপিনপুর গ্রামের সন্তান। সম্ভান্ত মুসলিম প্রামাণিক পরিবারে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারিতে তাঁর জন্ম।

error: Content is protected !!