সম্রাট-জাহাঙ্গীরের-স্বর্ণমুদ্রা-৩য়-পর্ব
গল্প,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৩য় পর্ব)

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৩য় পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

আশ্বিনে গা করে শিন শিন। এই কথাটি সুজানগর তথা চরগোবিন্দপুর গ্রামে কে প্রথম রটিয়েছিল সেটি গোলাপের জানা নেই। তবে এটা যে সর্বৈব মিথ্যা একটি প্রবাদ সেটি সে আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। আশ্বিনের দ্বিতীয় সপ্তাহেও দিনের প্রথম প্রহরে সূর্যের প্রখর উত্তাপে জীবন বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে গোলাপের। নিতাইয়ের গরুগুলো ঢাকার গাবতলির হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি ট্রাক ভাড়া করেছে সে। একেকটি ট্রাকে তোলা হয়েছে দশটি করে গরু। চারদিন বাদেই ঈদ-উল-আজহা। সে জন্য কোরবানির হাটও বসবে আগামীকাল থেকেই। গোলাপ বিচার বিবেচনা করে গরুগুলো নিয়ে একটু আগেই চলে এসেছে। যাতে বিক্রি বাটা সেরে আগেভাগেই গ্রামে ফিরে যেতে পারে সে।

বিড়ালের ভাগ্যে যে শিকে ছিড়বে না। সেটা সকালের শুরুটা দেখেই বোঝা গেল। তাদের ট্রাক দুটি সাভার অঞ্চলে এসেই থেমে গেল। কিছুতেই আর সামনে এগোনো যাচ্ছে না। ফিরতি গাড়িগুলোর লোকমুখে গোলাপ জানতে পারল যানবাহনের এই জ্যাম গাবতলির হাট পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু সাভার থেকে গাবতলির হাট পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগল পাঁচ ঘণ্টা! সুজানগর থেকে যমুনা সেতু হয়ে গাবতলি পর্যন্ত পৌঁছাতে সাধারণত সর্বসাকুল্যে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা, সেখানে এবার সর্বমোট সময় লাগল বার-তের ঘণ্টা।

আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা

যদিও হাট বসতে এখনো একদিন বাকি। কিন্তু গরুর হাটে পৌঁছতেই গোলাপ দেখল লঙ্ক সহস্র গরুর মচ্ছব বসে গেছে চারদিকে। নানা প্রজাতির গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ গবাদিপশুগুলোতে হাট ভর্তি। একপাশে দু’চারটি উটও দেখা গেল।সেগুলো নাকি এসেছে ভারতের রাজস্থান থেকে। গবাদিপশুগুলোর পেচ্ছাবে পেচ্ছাবে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। পশুগুলোর গোবর, মলমূত্র ও আবর্জনায় চারধার যেন সয়লাব। পেচ্ছাব ও আবর্জনার উটকো গন্ধে গোলাপের নাড়ি-ভুঁড়ি উল্টে আসছিল ভেতর থেকে। এমন সময় গোবড়ে পোকা আকৃতির একঝাঁক মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়ে গেল তার মুখমণ্ডল ভেদ করে। দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচতে গোলাপ তার তেল চিটচিটে গামছাখানি জোরে চেপে ধরল নাকে মুখে। নাহ্, এভাবে মুখ চেপে কোনো ফায়দা হবে না। এই নরক ও ভাগাড়ে যেহেতু তাকে কাটাতেই হবে দু’চার দিন সেহেতু আগেভাগেই কাজে নেমে পড়া ভালো। গোলাপ তৎপর হয়ে গরুগুলো ট্রাক থেকে খালাস করে হাটে তুলে আনে এক এক করে।

হালকা ফিনফিনে ধবধবে সাদা আদ্দি কাপড়ের একটি চমৎকার পাঞ্জাবি শরীরে গলিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল জাকির তালুকদার পল্টু। ড্রেসিং টেবিলের দেরাজ থেকে হালকা বেগুনি রংয়ের চিরুনিটি বের করে কপালের উপরিভাগ থেকে ক্ষয়িষ্ণু চুলগুলো দু’তিনবার করে আঁচড়ালো সে। তাকে আজ যেতে হবে গাবতলির গরুর হাটে। নিদেনপক্ষে বিশটির মতো গরু কিনতে হবে তাকে। আয়নার সামনে নিজেকে ভালো করে চেনার চেষ্টা করল সে। পল্টু কার কাছ থেকে যেন কথাটি শুনেছিল- নামটি যদিও আজ আর মনে পড়ছে না, আয়নাই নাকি হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে চরম সত্য। এটি যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আয়না কী আদৌ একজন মানুষের সবকিছু ধরতে পারে? বাহ্যিক দিকটা না হয় আয়না হুবহু দেখাতে সক্ষম হয় কিন্তু মানুষের ভিতরের কুৎসিত-কদর্য বিষয়গুলো একটি আয়না কিভাবে দেখাবে, সেটির সে ক্ষমতাই বা কোথায়? আর এ জন্যই বুঝি পল্টুদের মতো মানুষজন শঠতা কিংবা কপটতাকে অবলম্বন করে উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে বেছে নেয় ওগুলো।

আরও পড়ুন গল্প হলেও সত্য

পল্টু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। আসলে নেতা শব্দটি তার জন্য প্রযোজ্য নয়। নেতা না বলে বরং তাকে একজন পাতি নেতা বলাই শ্রেয়। সে অতি ধুরন্ধর ও সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদ। সারাজীবন নানা ফন্দি ফিকির করে ঢাকা মহানগরীর মাঝারি গোছের একজন নেতা হয়েছে সে। সুযোগ সুবিধা বুঝে এ দল থেকে আরেক দলে ডিগবাজি দিয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছে সে। সে জন্যই তার নিন্দুকেরা তাকে পল্টিবাজ অভিধায় অভিহিত করে সবসময়। পল্টিবাজ শব্দটির অপভ্রংশ সে হয়ে কালক্রমে তার নামের শেষ অংশে এসে যুক্ত হয়েছে। আজ গাবতলির হাট থেকে তাকে কমপক্ষে বিশ-বাইশটি গরু কিনতে হবে এজন্য যে, এই কোরবানি ঈদে, তার দলের নীতি-নির্ধারকদের প্রতিজনকে একটি করে গরু উপহার দিতে চায় সে। উপহার প্রথাটি যে এবারই প্রথম তা কিন্তু নয়, বিগত তিন চার বছর ধরে এই রীতিটি পালন করে আসছে সে খুবই সুনিপুণভাবে। আর এ জন্যই বিন্দু পরিমাণ লেখাপড়া না জেনেও আজ সে একজন মাঝারি সাইজের দাপুটে নেতা।

বেশ কয়েকজন চেলা-চামুণ্ডা সমেত পল্টু হাজির হলো গাবতলির গরুর হাটে। হাটের চারধার ধুলায় ধুলাময়, সে এক হতশ্রী অবস্থা। তার উপর আবার ক্যাৎক্যাতে ভিড়। কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে বেশ খানিক সময় ঘোরাঘুরি হলো হাটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিভিন্ন আকৃতির নানা রং-বেরঙের গরু হাটজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কোনো কোনোটির এক-দেড় হাত লম্বা শিং। ওগুলো নাকি হরিয়ানা ষাঁড়। কোনোটির পাগুলো বেশ খাটো। উচ্চতার দিক দিয়ে বামন সাইজের গরু। বামন হলে কি হবে গায়ে-গতরে কিন্তু আবার বেশ হৃষ্টপুষ্ট। এদের বলা হয় ভুটানি ও নেপালি ষাঁঢ়। নেতার সঙ্গে আগত চেলাচামুণ্ডাগুলো বেশ সকৌতুকে লক্ষ্য করল যে, তাদের নেতার গরু কেনার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ নেই। বরং গরুর ব্যাপারিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে গল্প করায় মন।

আরও পড়ুন গল্প পরাজিত নাবিক

এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে খানিকক্ষণ পদচারণার পর জাকির তালুকদার পল্টু এসে দাঁড়ালো গোলাপের গরুগুলোর সামনে। প্রায় সবগুলো গরুই দেখলো মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর বেশ সময় ধরে কথাবার্তা চলল গোলাপের সঙ্গে। গোলাপ বিশটি গরুর সর্বমোট দাম হাঁকল পঁচিশ লক্ষ টাকা। শুনে ঈষৎ বিদ্রূপের হাসি হেসে জাকির তালুকদার বলল, ‘ওহে ব্যাপারি মিয়া মাথামুণ্ডু কী ঠিক আছে কিছু? পঁচিশ লক্ষ টাকা তো আর মামার বাড়ির আবদার নয়। ঠিক করে বল তোমাকে কত দিতে হবে। আমি সর্বোচ্চ বিশ লাখ দিতে প্রস্তুত আছি।’ গরুর মূল্য নিয়ে এভাবে দরকষাকষি চলল বেশ খানিকক্ষণ । তারপর বাইশ লাখ টাকায় এসে গরুর মূল্য স্থির হলো, সঙ্গে দরাদরিরও ঘটল অবসান। কিন্তু বিপত্তি হলো অন্য জায়গায়।

জাকির তালুকদার বিপন্নের মতো হাত কচলে ও আড়ষ্ঠ গলায় গোলাপকে উদ্দেশ করে বলল- শোন ব্যাপারি এতগুলো টাকা তো আর সঙ্গে করে হাটে নিয়ে আসা নিরাপদ নয়। সে জন্যই আমি অর্থকড়ি কিছুই সাথে করে নিয়ে আসিনি। তোমাকে কিন্তু ভাই একটু কষ্ট করে হলেও আমার বাড়ি যেতে হবে। আমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সব ঠিকঠাক করে রেখেছি। তুমি শুধু আমার বাড়িতে দুটি ডালভাত খেয়ে টাকা বুঝে নিয়ে চলে যাবে গ্রামে। কি এক ইতস্ততার মধ্যে পড়ে গেল গোলাপ। ভেবে পাচ্ছে না কী করবে সে। এই মুহূর্তে তার কিইবা করা উচিত। এতগুলো গরু একসঙ্গে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এমন একটি সুবর্ণ সুযোগ তার কি হাতছাড়া করা উচিত হবে? তার ওপর নীট মুনাফা দুই লক্ষ টাকা। এতগুলো টাকা একসঙ্গে কবে দেখেছে সেটি অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না সে। খাবার-দাবারের প্রয়োজন নেই, চলুন টাকাগুলো বুঝে নিয়ে গ্রামের পথে পা বাড়াই, কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে জাকির তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বলল গোলাপ।

আরও পড়ুল গল্প বিপরীত

একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বিশটি গরুই জাকির তালুকদার তার চেলাদের হাতে তুলে দিয়ে মিনমিনে গলায় নির্দেশ দিয়ে দিলো কোন গরুটি কাকে দিতে হবে। জাকির তালুকদারের শিষ্যগুলো জি হুজুর ধরনের কিছু উত্তর দিয়ে গরুগুলো নিয়ে গাবতলির হাট হতে সটকে পড়ল দ্রুত।

আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!