স্বপ্ন জল (২য় পর্ব)
স্বপ্ন জল (২য় পর্ব)
শিলার চেহারা খুবই সুন্দর! গ্রামের মেয়ে হলেও আলাদা একটা মাধুর্য্য ও লাবণ্য রয়েছে তার। যে কোনো ছেলে দেখলেই তার প্রেমে পড়তে চাইবে। কিন্তু শিলা কেন প্রেম করবে? গ্রামের মেয়ে চিন্তা ভাবনা করে কাজ করবে না? কি এমন হয়েছিল, যে তার সাথে তার প্রেম করতে হবে। এমন সব অগোছালো এলোমেলো কথা ও নানা প্রশ্ন নিয়ে কখন যেন কাদোয়া পৌঁছেছে সীমান্ত, টেরই পায়নি। সীমান্ত একটা ভ্যান ডেকে তাতে উঠে বসলো। রাস্তায় অনেক মানুষের সাথে দেখা, সবার সাথে হাই-হ্যালো করতে করতে তার নিজ বাড়ি গুপিনপুর পৌঁছে গেল।
ঈদের ছুটি শেষে সীমান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলো। একদিন টিএসসি’র দিকে যেতে শিলার সাথে দেখা।
__এই যে সীমান্ত ভাই না?
__হ্যাঁ, কেমন আছো শিলা?
__ভালো আছি।
__আপনি?
__আমি ভালো। তুমি কবে এসেছো?
__আমি গত সপ্তাহে এসেছি।
__ঠিক আছে। তোমার কোনো প্রয়োজন হলে, আমাকে বলিও।
__কিছু মনে না করলে, আপনার ফোন নম্বরটা …
__ও, নাও। ০১৫৫২….৯৭। ভালো থেকো, আসি।
আরও পড়ুন গল্প লালু
একদিন শিলা ফোন করে সীমান্তের সাথে দেখা করতে চায়। সীমান্ত বলে ডিপার্টমেন্টে আসতে। শিলা ডিপাটমেন্টে দেখা করে। বলে,
__ভাই একটা কথা ছিল। একটু যদি এদিকে আসতেন।
সীমান্ত তার বন্ধুদের বিদায় দিয়ে মধু’র ক্যান্টিনে এলো।
__বসো।
__না ভাই, আজ আর বসবো না, একটু কথা বলে চলে যাব।
__আরে বসো। তুমি আমার এলাকার মেয়ে। এতদিন তো আর জানতাম না। এখন তো জেনেছি। বসো।
__তোমার কথাই তো শুনবো।
শিলা একটা চেয়ারে বসলো। সীমান্ত বললো,
__কি খাবে, বলো?
__না, কিছু না।
__এই রুবেল (ওয়েটার) একটা মিষ্টি দে। সাথে একটা করে নিমকি দিস। চা কড়া করে দিবি। আমার কথা গিয়ে বল যা…।
__ভাই, আমি হঠাৎ একটা বিপদে পড়েছি।
__বলো, কি বিপদ?
আমার টিউশনিটা চলে গেছে। হাতে টাকা নেই, বাড়িতে বলেছি। টাকা আসতে একটু সময় নেবে। তাই যদি…
__কত লাগবে?
__এই পাঁচশত। আমি কাল-পরশু দিয়ে দিব।
__নাও, খাও।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
খাওয়া শেষ হলে, সীমান্ত মানিব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে শিলাকে দিলো।
শিলা সালাম দিয়ে বিদায় নিল।
এক সপ্তাহ পর শিলা সীমান্তকে টাকা দিতে যায়।
__সরি, দেরি হয়ে গেল।
__না, ঠিক আছে। তোমার প্রয়োজন হলে আবার নিও, কেমন। কোন লজ্জা করবে না।
__আসলে টাকাটা দরকার হতো না। আমার টিউশনিটা এ মাসে চলে গেছে। অন্য একটা খুঁজতে দেরি হবে। তাই টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়লো। কিছু মনে করবেন না, ভাই।
কথাগুলো সীমান্ত’র মনে ধরলো। কি ব্যাপার, ও টিউশনির উপর নির্ভরশীল!
__কেন, তোমার বাড়ি থেকে টাকা দিতে পারে না?
__আসলে বাবা মারা যাবার পর, মা পেনশন যা পায়, তা দিয়ে আমাদের সংসার চলতে চায় না। তাই টিউশনি করতে হয়।
সীমান্ত মনে মনে চিন্তা করলো, কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে কিনা? জানারও দরকার, সেদিনের পরে কি হয়েছিল।
__আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
__বলেন।
__তোমার সাথে যে ছেলেটা দেখলাম, ওর খবর কি?
শিলা মাথা নিচু করে থাকলো। তারপর বললো,
__না, ওর সাথে সেদিনের পর থেকে আমার আর সম্পর্ক নেই। আমাকে ভয় ভীতি দেখিয়েছে। আমি আপনার কথা বলেছি, ‘আমার কাজিন।’ সেই থেকে আর কিছু বলে না।
__কি হয়েছিল? তার সাথে তোমার সম্পর্ক কিভাবে? কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে?
__সে অনেক কথা।
__চলো বসি।
আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
শিলাও চিন্তা করলো, জানিয়ে রাখা ভালো। যদি আবার ডিস্টার্ব করে।
__বলো।
__আমি ওদের বাড়িতে, ওর ছোট বোনকে পড়াতাম। সেখান থেকে দুই একদিন কথা বলতে বলতে ওর সাথে আমার সম্পর্ক হয়। ক্যাম্পাসে বহুদিন বসেছি। তার সাথে আমার অন্য কোনো সম্পর্ক হয়নি। আমি ওকে ভালোই বেসে ফেলেছিলাম। ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওর বাবা এজিবিতে চাকরি করে। আমার বাবার মৃত্যুর আগেই এই টিউশনিটা করতাম। আমার বাবা মারা যাবার পর ও যেন কেমন হয়ে গেল। এরপর থেকে সে আমার খারাপ প্রস্তাব দিত। আমি বলতাম,
__দেখ আমার সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি পড়াশুনা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিব। চাকরি পাব, তারপর বিয়ে করবো। এসব করার সময় এখন নয়। কিন্তু সে বুঝতেই চাইত না…। আমাকে কোন ভাবে বাগে না পেয়ে, ‘সেদিনের সে ঘটনা।’ এখন আমি তার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখি না।
কথাগুলো শুনার পর সীমান্তের মনে একটা দাগ কাটলো।
__তুমি এখন চলছো কিভাবে?
__অন্য জায়গায় টিউশনি করি। তাতে চলে যায়।
আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা
সেদিন প্রথম দেখাতেই সীমান্তের ভালো লেগেছিল শিলাকে। কিন্তু পিছনে যে এত মর্মান্তিক ঘটনা, তা তার জানা ছিল না। সীমান্ত শিলার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে।
__তোমার টিউশনি না করলে চলে না?
__ভাই, আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। কেউ ইচ্ছা করে টিউশনি করেও না। টিউশনি যারা করায় একমাত্র তারাই জানে বাংলাদেশে কয় ধরনের বিস্কুট আছে। তাছাড়া আমি বিসিএস এর প্রস্তুতি নিচ্ছি। এজন্য নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী পড়ালে একটু চর্চা থাকে।
__তুমি এত কষ্ট কর!
__ভাই, ‘সুখ এমন একটি এ্যাপস্ (Apps) যা সবার জীবনে ইনস্টল (Install) হয় না।’ একটু কষ্ট তো করতেই হবে। আমার ভাগ্যটা ভালো না। কোনো খানেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি না। সবাই আমার সাথে কেমন যেন একটা ব্যবহার করে। নিজেকে অনেক গুছিয়ে চলার চেষ্টা করি। আমি চিন্তা করি কি, আর হয় কি? অনেকদিন স্বপ্ন দেখেছি, লটারী জিতেছি। সেজন্য দশ টাকা দামের প্রাইজবন্ড কিনেছি কত! আমার বান্ধবীদের অনেকেরই লাগে। আমার লাগে না। তাই ভাবি জীবনে কোনদিন লটারী পাইলাম না। আর তরকারিতে একটা এলাচি দিলে ঐটা আমিই পাই।
__তুমি তো সুন্দর করে কথা বলতে পারো।
__ভাই, এগুলো হয়ে যায়। ‘স্তব্ধ রাতগুলো এক সময় হাসিতে পূর্ণ থাকতো। আজ নীরবতায় পূর্ণ থাকে। বাবা আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু জানি না সে স্বপ্ন কতটুকু আমি পূরণ করতে পারবো। নিজেকে আর আগের মত চিন্তা করতে পারি না। এখন টিউশনি, ক্লাস, পড়ালেখা। যে করেই হউক আমাকে বিসিএস পাশ করতেই হবে। আমি খুব ভেঙে পড়েছি, ভাই। পৃথিবীতে সবচেয়ে নরম জিনিস কি জানেন, মানুষের মন। যাকে কোন কঠিন বস্তু দিয়ে আঘাত করতে হয় না। দুঃখের পরশ পেলে এমনিই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
সীমান্ত কথাগুলো শুনছিল আর মনের মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করছিল।
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
আচ্ছা শিলা,
__আমি যদি তোমাকে টাকা দেই। তুমি টিউশনি ছেড়ে দিবে?
__কি হলো ভাই? কেন, আপনি আমাকে টাকা দিবেন? আপনি এমনিতেই তো অনেক করেছেন। ভালো থাকেন আজ উঠি।
__না, ভাবলাম তুমি টিউশনি না করলে আরও ভালো ভাবে পড়াশুনা করতে পারবে। তাছাড়া তোমার বিসিএস পরীক্ষা পাশ করা দরকার।
__না ভাই, আমি আপনার টাকা নিতে পারি না। তাছাড়া কেনই বা আপনার টাকা নিবো? এটা হয় না। ‘সহজে জেতার আনন্দ কোথায়, বাধা যত বিশাল বিজয়ের আনন্দও ততোই বাঁধভাঙ্গা।’ আমার নিজের চেষ্টা করতে দেন। ভালই তো আছি। সময়ে দেখা যাবে।
কথা শেষ করে দুজনে যার যার গন্তব্যে চলে গেল।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
স্বপ্ন জল (২য় পর্ব)