স্বপ্ন জল (১ম পর্ব)
স্বপ্ন জল (১ম পর্ব)
বৃষ্টির ফোটাগুলো ছাদের কার্ণিশ থেকে পানির উপর পড়ছে। স্বচ্ছ পানি ছিটে পড়ছে চারিদিকে। এ এক বর্ণিল রঙ। হালকা মধুময় সুর। একদৃষ্টিতে তম্ময় হয়ে চেয়ে আছে সীমান্ত। এই বৃষ্টির ফোঁটা, নিচে জমে থাকা পানি, পানির নিচে পাথরের টুকরোগুলো এ সব সুরের আহ্বানে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে সীমান্ত। মনে নেই কতক্ষণ কলাভবনের বারান্দার কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে সে। এরই মাঝে বৃষ্টির হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় নিজেকে সিক্ত করেছে কতবার। হঠাৎ পায়ের শব্দে তার তন্দ্রা ফিরে আসে। দেখলো বারান্দায় একজন ছেলে ও একটা মেয়ে দৌঁড়ে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টিতে একটু ভিজে গেছে। ওড়না দিয়ে ছেলেটার মাথা মুছিয়ে দিলো মেয়েটি।
সীমান্ত অনতি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। সেদিন দুপুরে ক্যাম্পাস ফাঁকা। যে যার গন্তব্যে ফিরে গেছে অনেক আগেই। মুসুলধারে বৃষ্টি ধরছে। গাছে দুই একটা পাখি নিজেদের বৃষ্টি থেকে বাঁচনোর চেষ্টা করছে। একজোড়া কাক পানিতে তাদের গা ধোয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছে। এরই মাঝে দুই একজোড়া কপোত-কপোতি বিল্ডিংয়ের কোনায়, চিপায়-চাপায় বসে গল্পের পশরা সাঁজিয়েছে। মনে হয় তাদের গল্প কোনোদিনই শেষ হবে না।
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
পাশে দাঁড়ানো ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটা ভিন্ন ইমোশন কাজ করছে। মাঝে মাঝে মেয়েটা ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। ছেলেটা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। মেয়েটা যতই তাকে আদর করছে, সুন্দর সুন্দর কথা বলছে কিন্তু ছেলেটা নিজেকে অন্য চাওয়ায় ব্যস্ত। তারা হয়তো সীমান্তকে তেমন দেখতেই পায়নি। পেলেও এ ধরনের প্রেমিক-প্রেমিকার চোখ-কান সব সময় বন্ধই থাকে। অগত্যা ছেলেটা মেয়েকে হাতধরে হ্যাচকা টান দিয়ে একটু দূরে রুমের ফাঁকে নিয়ে গেল। মেয়েটার আপত্তি সত্ত্বেও ছেলেটা তার আপত্তিকর স্থানে হাত দেয়। মেয়েটা বারবার হাতটা ছাড়াতে ব্যস্ত। ক্যাম্পাসে এমন ঘটনা নতুন কিছু না, প্রায়ই এমন হয়। সীমান্ত তাই অতটা আমলে নেয় না। কিন্তু মেয়েটা যখন চিৎকার দেয় তখন সীমান্ত এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে ছেলেটা স্যালোয়ার ধরে টানাটানি করছে। গুটিসুটি বসে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে মেয়েটি।
সীমান্ত গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
__কি হচ্ছে ভাই?
ছেলেটা চোখ লাল করে ধমক দিয়ে বললো,
__কিছু না। এটা আমাদের দু’জনের ব্যাপার, আপনি যান।
দু’জনের ব্যাপার হলে ভালো কিন্তু মেয়েটা তো চিৎকার করছে। মেয়েটা দৌঁড়ে এসে সীমান্তের পিছনে দাঁড়ায়। দু’হাতে তার স্যালোয়ারটা ধরা, গায়ে ওড়নাও নেই, উস্ক-খুস্ক অবস্থা।
__তাতে আপনার কি?
__আমার কি মানে! এসব চলবে না। প্রেম করেন ভালো। বিয়ে করেন, তারপর যা ইচ্ছা করবেন।
__ক্যাম্পাসে তুমি নতুন নাকি? এসব ক্যাম্পাসে হয়-ই।
__না, হয় না। যা হয় দু’জনের সম্মতিতে।
ছেলেটা বললো,
__আমাকে তুমি চিনো? বলছি এখান থেকে চলে যাও।
__আপনি কে? আমি জানি না। তবে ঐ দিকে তাকান। আপনি আমাকে চিনবেন।
একটু দূরেই বিপ্রত হাসান সীমান্তের ছবি টাঙান। ছাত্র আন্দোলনের জন্য ছবিসহ সীমান্ত’র পোস্টার। ছেলেটা আর কথা বাড়ালো না, ওখান থেকে সরে পড়লো। মেয়েটা দৌঁড়ে পড়ে থাকা ওড়না টেনে নিয়ে দ্রুত অন্যদিকে চলে গেল। একটু পরে বিপ্রত হাসান সীমান্ত তার জহুরুল হক হলে চলে আসে। এ নিয়ে সে আর চিন্তাই করে না, কারণ এরকম দুই একটা ঘটনা এর আগেও সে ফেস করেছে। ক্যাম্পাসে থাকলে বহু অভিজ্ঞতার জন্ম হয়, রাজনীতি করলে তো কথাই নেই।
আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা
ঈদের ছুটি। বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট পাওয়া খুবই কষ্টকর। পাবনা এক্সপ্রেসকে বলে দুইটি টিকিটের ব্যবস্থা করেছে সীমান্ত। একটা টিকিট রোহানের জন্য আর একটা নিজের জন্য। ২৭ রোজার দিন সকালে ৮.৩০টায় পাবনা এক্সপ্রেস কাউন্টারে গিয়ে দেখে রোহান আসেনি। সীমান্ত টিকিট দু’টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোহান ফোনও রিসিভ করছে না। হয়তো টেরই পায়নি, সকাল হয়ে গেছে। সেহেরি খেয়ে শুয়েছে। আর খবর নেই। অনেক ফোন করেও তার খবর পাওয়া গেল না। কি আর করা, এদিকে বাসের সময়ও হয়ে গেছে। সীমান্ত কাউন্টারে গিয়ে বললো,
__ভাই, আমার একজন প্যাসেঞ্জার আসার কথা ছিল সে আসে নাই। আপনার কি কোনো প্যাসেঞ্জার আছে? এক্সটা টিকিট যে ফেরত নিতে হয়।
__দাঁড়ান দেখছি।
__এই রুবেল, ”দেখতো এই মাত্র একটা ম্যাডাম একটা টিকিট খোঁজ করলো, কোথায় গেল।”
রুবেল পিছন থেকে ডাক দিল,
__এই যে ম্যাডাম, এদিকে আসেন। টিকিট পেয়েছেন?
__না, এদিকে আসেন। কয়টা টিকিট লাগবে আপনার?
__একটা।
__আসেন।
রুবেল ম্যাডামকে কাউন্টারে এনে বললো,
__রহিম ভাই, এই যে এসেছে।
__ভাই, দেন আপনার টিকিটটা।
সীমান্ত পকেট থেকে টিকিট বেড় করে দিল।
__টিকিট একটা তো, না? ৫৪০/- টাকা দেন।
__নদী পারাপার নাই?
__না, নদী পারাপার হবে না। একটা টিকিট একজন যাত্রী গেল না তাই দিলাম। তাড়াতাড়ি দেন।
টিকিট বিক্রির পর কাউন্টার মাস্টার রহিম বললো,
__এই যে ভাই, আপনারা বাসে উঠেন, এখনই বাস ছেড়ে যাবে।
__এই রুবেল যাত্রীদের বাসে উঠা। তাড়াতাড়ি কর।
আরও পড়ুন দীপ্তিদের দেবতা
যাত্রীরা সবাই যার মত বাসে উঠলো তাড়াহুড়া করে। সীমান্তও তার ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠলো।
বাসের ওপরের বাঙ্কারে ব্যাগ রেখে সিটের জানালার কাছে গিয়ে বসে জানালার গ্লাস টানছে। এমন সময় ভদ্র মহিলা গিয়ে বললো,
__ভাই, আমি একটু জানালার কাছে বসি?
সীমান্ত তাকিয়ে দেখলো সেই মহিলা, যিনি একটু আগে তার কাছ থেকে টিকিট কিনলো।
সীমান্ত সরে এসে বললো,
__বসেন।
সীমান্ত’র কাছে মনে হলো মেয়েটা চেনা-চেনা লাগে। কোথায় যেন দেখেছে সে!
এক সময় মেয়েটা নিজেই বললো,
__পাবনা কোথায় যাবেন?’
__সুজানগর, সাতবাড়িয়াতে।
__আপনি?
__চিনাখড়া।
__আপনার বাড়ি চিনাখড়া কোথায়?
__ তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের ঘোড়াদহ গ্রামে ।
__আপনার বাবার নাম কি?
__নজরুল ইসলাম।
__ও, তিনি মেডিকেলে চাকরি করতেন, না?
__হ্যাঁ, আপনি চিনতেন?
__হ্যাঁ, চিনতাম।
__আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। যদি কিছু মনে না করেন।
__বলেন।
__আমি আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি? বলেন তো, কোথায় দেখেছি?
__ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দেখা হয়েছিল। আমি আপনাকে চিনি। আপনি তো ছাত্র নেতা। তাই আপনাকে চিনতে অসুবিধা নেই। কিন্তু আপনার বাড়ি যে পাবনা, সেটা আমি জানতাম না।
__ও, তাই হবে। কিন্তু আমি ভালো মনে করতে পারছি না, তবে…। এইবার চিনেছি, আপনার একটা অঘটন ঘটেছিল, না?
মাথা নিচু করে, হালকা মাথা নাড়ালো। এতক্ষণে মুখটা কালো হয়ে গেল।
__সরি, কিছু মনে করবেন না।
__না, ঠিক আছে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী নেপোলিয়ান বোনাপার্টের দেশে
বেশকিছু সময় নিরব থেকে, সীমান্ত জিজ্ঞাসা করলো,
__আপনার নাম কি জানতে পারি?
__শিলা। জেসমিন আক্তার শিলা।
__কোন সাবজেক্টে পড়েন?
__হিসাব বিজ্ঞানে।
__কোন বর্ষে?
__তৃতীয় সেমিষ্টার শেষ হবে এবার।
__আপনি?
__আমি সমাজকর্মে। চতুর্থ সেমিষ্টার শেষ হবে।
__কোন হলে থাকেন?
__জহুরুল হক হলে।
দু’জনে আলাপ করতে করতে কখন যেন বাস চিনাখড়া এসে গেছে। হেল্পার ডাকছে,
__এই চিনাখড়া এসে গেছি, ‘নামেন’। কারো কেবিনে মাল আছে নাকি?
কেউ কোনো কথা না বলে, দু’জনই নেমে পড়লেন। এই স্টপেজে আর কোনো যাত্রী না থাকায় বাস পাবনার দিকে রওনা হলো। শিলা একটা ভ্যানে উঠে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
সীমান্ত বিদায় নিয়ে সিএনজিতে চেপে বসলো। মনে মনে চিন্তা করলো এই মেয়ে ঐ ছেলের প্রেমে কি করে পড়লো? কানেকশনটা কি? তাছাড়া শেষ পরিণতিই বা কি হয়েছিল। এমন নানা কথা মাথার ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকলো।
আরও পড়ুন স্বপ্ন জল-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
স্বপ্ন জল (১ম পর্ব)