সুতা-ছেঁড়া-ঘুড়ি-২য়-পর্ব
উপন্যাস,  তাহমিনা খাতুন,  সাহিত্য

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (২য় পর্ব)

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (২য় পর্ব)

তাহমিনা খাতুন

দুই.
নূরপুরের মধ্যপাড়া আর পাশের গ্রাম শিবপুরের সীমা নির্ধারণকারী হালটে দুপুরের পর দই ওয়ালার ডাক শোনা গেল। দই…দই…ভালো দই। দই ওয়ালার ডাক শুনে মধ্যপাড়ার সরফরাজ খন্দকারের বাড়ির ভিতর থেকে ছয়/সাত বছর বয়সের এক খোকা বেরিয়ে এল। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা।
“এই দইওয়ালা, তোমার দইয়ের দাম কত?”
“কেন খোকা, তুমি দই কিনবে?”
“আমি দই কিনব? পয়সা পাব কোথায়? তোমার তো অনেকগুলো দইয়ের হাঁড়ি। আমাকে একটা হাঁড়ি দিয়ে দাও। আমি যখন বড়ো হব, তখন তোমার দইয়ের দাম শোধ করে দেব।”
খোকার বুদ্ধিদীপ্ত কথায় দারুণ মজা পেল দইওয়ালা। বলল,
“ঠিক আছে। তুমি যদি এক হাঁড়ি দই পুরোটা খেতে পারো, আমি তোমার কাছে থেকে কোনো পয়সা নেব না।”
“আমি তোমার শর্তে রাজি। তবে আমারও একটা শর্ত তোমাকে মানতে হবে। তোমার হাঁড়ির অর্ধেক দই শেষ করে আমি একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বাকি অর্ধেক দই শেষ করব।”
দইওয়ালা হাসতে হাসতে বলল,
“ঠিক আছে। একবার কেন, তুমি তিনবার বাড়ি থেকে ঘুরে এলেও আমার কোনো আপত্তি নেই। তোমাকে পুরো হাঁড়ির দই শেষ করতে হবে। তা তোমার নাম কি খোকা?”
“এই তো, সবাই আমাকে খোকা বলেই ডাকে। দাও, দই দাও।”
দইওয়ালা হাসতে হাসতে একটা দইয়ের হাঁড়ির ঢাকা খুলে খোকার সামনে এগিয়ে দিল।
দই খেতে শুরু করল খোকা। অর্ধেক হাঁড়ি দই শেষ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বাকি অর্ধেক দই খেয়ে শেষ করল। আশ্চার্য হলো দইওয়ালা।
দইওয়ালাকে শর্ত দিয়ে দই খাওয়া খোকার নাম মাহবুব আলী। সরফরাজ খন্দকারের জমজ দুই ছেলে-আফতাব আলী আর মাহবুব আলী। জমজ দুই ভাইকে বাবা মা ছাড়া আলাদা করে চিনতে পারে না অন্যরা। অসম্ভব বুদ্ধিমান দুই ভাই। তাদের বিভিন্ন বুদ্ধিমত্তায় অবাক হয় পাড়ার বাসিন্দারা। আফতাব আলী দইয়ের হাঁড়ি অর্ধেক শেষ করে বাড়ির ভিতর গিয়ে জমজ ভাইকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাকি অর্ধেক দই শেষ করার জন্য। বুদ্ধিতে দইওয়ালাকে হারিয়ে দিয়ে দই খেয়েছে দুই ভাই।

আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

কয়েকদিন পর আবার দইওয়ালার ডাক শোনা গেল। এবারে দইওয়ালাকে ডাকলে মাহবুব। আফতাবের মতো শর্তের কথা বলতে দইওয়ালা বলল,
“তোমার বাড়ির বড়ো কাউকে ডেকে আনো। তারপর দই দেব।”
দইওয়ালার ডাক শুনে সরফরাজ খন্দকারের স্ত্রী করিমন বিবি বড়ো ছেলে আব্দুর রহিমকে পাঠালেন দই কেনার জন্য। দই বিক্রি করতে করতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করল দইওয়ালা। এক সময়ে বলল,
“জানেন, কয়েক দিন আগে আপনাদের বাড়ির খোকার সাথে একটা শর্তে তাকে দই খাইয়ে গেলাম। খোকা অর্ধেক দই খেয়ে শেষ করে বাড়ির ভিতর থেকে ঘুরে এসে বাকি অর্ধেক দই খেয়ে শেষ করল।”
দইওয়ালার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“খোকা বাড়ির ভিতর থেকে ঘুরে এসে দই শেষ করেছে?”
“ঠিক তাই।”
আব্দুর রহিম দইওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভিতর গিয়ে জমজ দুই ভাইকে ডেকে নিয়ে এল। জমজ দুই ভাইয়ের চালাকি বুঝে ফেলেছে আব্দুর রহিম। জমজ দুই ভাইকে দেখে খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল দইওয়ালা। তারপর বলল,
“যা-ই বলেন না ভাই, আপনার দুই ভাইয়ের বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। কীভাবে তার মাথায় এল অর্ধেক দই নিজে খেয়ে বাকি অর্ধেক জমজকে দিয়ে শেষ করাবে!”
আব্দুর রহিম দইওয়ালার দুই হাঁড়ি দইয়ের দাম শোধ করে ক্ষমা চেয়ে নিল; দুই ভাইয়ের অপকর্মের জন্য।

আরও পড়ুন জারজ

তিন.
শাহাবুদ্দিন মধুপুরের পাঠশালার হেড পন্ডিত। বৃটিশ ভারতে পাঠশালার শিক্ষকদেরকে পন্ডিত বলে সন্মান জানানো হতো। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত থাকলেও শাহাবুদ্দীন মানুষটা বেশি সুবিধার নয়। বেশ লোভী আর কুচক্রী ধরনের মানুষ। তবু ছোটো বোন হালিমার ডাকে সাড়া দিল।
দীর্ঘদিনের রোগাক্রান্ত জয়নাল এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, হেঁটে নদীর তীর পর্যন্ত পৌঁছানোর শক্তি নাই। বহু কষ্টে দুইজন কিষাণ তাকে ধরে ধরে নদীর তীর পর্যন্ত নিয়ে নৌকায় উঠাল। শিশুকন্যাকে নিয়ে অসুস্থ স্বামীর সঙ্গে নৌকায় চড়ে বসল হালিমা।

মধুপুরের পাশের গ্রাম যদুপুর। যমুনার শাখা নদী আত্রাই তীরের আশেপাশের গ্রামগুলো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর! নদীর তীর ধরে সবুজ ফসলের জমি। বড়ো বড়ো আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, শাল, কড়ই, তাল, খেজুরের ঘন জঙ্গলে ছাওয়া। পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত। ছইওয়ালা বড়ো বড়ো নৌকা গুণ টেনে নিয়ে যায় মাঝিরা। রঙবেরঙের পাল তোলা নৌকায় চড়ে বউ-ঝিরা বাপের বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ি যাতায়াত করে। দূরের কোনো নৌকা থেকে ভেসে আসে ভাটিয়ালি সুর।
সন্ধার কিছুক্ষণ আগে অসুস্থ জয়নালকে নিয়ে যদুপুরে পৌঁছাল হালিমা। শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী গোলাপ জান শান্তভাবে গ্রহণ করল জয়নাল আর হালিমাকে।
মধুপুরের ডাক্তার অবনীন্দ্রনাথের হাত যশ খুব ভালো। দূর-দূরান্ত থেকে জটিল এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীদের কেও চিকিৎসার জন্য অবনী ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসা হয়।
পরের দিনই জয়নালকে নিয়ে যাওয়া হলো অবনী ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন ‘কালা জ্বর’ (Black fever) হয়েছে জয়নালের। ব্যবস্থাপত্র দিলেন। সেই সঙ্গে রোগীকে প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য সকালে বিকালে খোলা বাতাসে ভ্রমণের পরামর্শ দিলেন।
শাহাবুদ্দিনের নৌকার মাঝি প্রতিদিন জয়নালকে নিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য; নদীর বিশুদ্ধ হাওয়ায় ঘোরানোর জন্য।
ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ এবং পরামর্শ এবং হালিমার সেবায় একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছে জয়নাল।

আরও পড়ুন একজন অনন্যা 

বর্ষা শেষ হয়ে আশ্বিনের মাঝামাঝি। বাতাস শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। শরতের মেঘমুক্ত গভীর নীলাকাশ। মাঝে মাঝে ধবল মেঘের লুকোচুরি। নদীর তীর সাদা কাশফুলে ছেয়ে গেছে। নদীর পানিও বেশ নিচে নেমে গেছে। পানির কিনারে কয়েকটা সাদা বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে শিকার ধরার জন্য সুযোগের অপেক্ষা করছে। কয়েকটা কাদা খোঁচা মাছের খোঁজে বারবার পানির কিনারে ছুটে যাচ্ছে। একঝাঁক পাতিহাঁস নদীতে নেমে শামুক খুঁজতে ব্যস্ত। মাথার উপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে বুনোহাঁস। নদীর কোণে গোঁজা একটা বাঁশের কঞ্চির মাথায় একটা রঙিন ঘাসফড়িং একবার বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে। কয়েকটা রাজহাঁস কাউকে দেখলেই লম্বা গলা উঁচিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা খোলা জায়গায় কয়েকজন কিশোর ডাঙ্গুলি খেলছে। নৌকার পিছনের দিকে বসে মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো দেখছে আর নিজের বাড়িতে কবে ফিরে যেতে পারবে; তাই ভাবছে জয়নাল।

সন্ধ্যার আগে জয়নালকে নিয়ে বাড়ি ফিরল হাবিব। হাবিবের হাত ধরে নৌকা থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরল।
জয়নালকে একা হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখে মনে মনে আশান্বিত হয়ে ওঠে হালিমা। ভাবে, যাক অবনী ডাক্তারের ওষুধে বেশ কাজ দিচ্ছে।

সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই বেশ সুস্থ হয়ে উঠল জয়নাল। ঘরের মধ্যে কিংবা উঠানে একাই হাঁটাহাঁটি করে। মেয়েকে কাছে বসিয়ে আদর করে। এসব দেখে হালিমার মনে আশা জাগে। দ্রুতই হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে জয়নাল। স্বামী আর সন্তানকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু বিধি বাম। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বিকেলে নদী ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরল জয়নাল। তাকে রাতের খাবার খাইয়ে, মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের খাবার খেতে রান্না ঘরে গেছে। খাবার খেতে খেতে ভাবছে, পরদিন মিয়া ভাইকে বলবে জয়নালকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফেরার কথা। মাত্রই খাওয়া শেষ করেছে; এরমধ্যে জয়নালের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল হালিমা। কি হয়েছে জানতে এগিয়ে গেল জয়নালের দিকে। দেখল গায়ের চাদরটা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে আছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখল বেশ গরম। দুশ্চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে গেল হালিমার। আবার জ্বর এসেছে জয়নালের।

আরও পড়ুন পরাভূত

মাথায় জলপট্টি দিল কিছুক্ষণ। কিন্তু জ্বর কমলো না। পরদিন জ্বর আরও বাড়ল। কি করা উচিত ভেবে পেল না হালিমা। পরদিন শাহাবুদ্দিনকে জানাতে সে বলল,
“এত চিন্তা করছিস কেন? গঞ্জে আরও একজন ভালো ডাক্তার আছে। আগামীকাল জয়নালকে পরেশ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
পরেরদিন সারাদিন গেল। জ্বর কমলো না জয়নালের। শাহাবুদ্দিন জয়নালকে পরেশ ডাক্তারের কাছে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নিল না। এরপরের দিন জ্বর আরও বাড়ল। ঠিক মতো খাবারও খেতে পারছে না। হালিমা জোর করে দুই চামচ সাবু দানা সিদ্ধ খাইয়েছে।
হালিমা ভাইকে বলল,
“মিয়া ভাই, পরেশ ডাক্তারকে বাড়িতে নিয়ে আসলে হতো না। নদীর বাতাসে যদি জ্বর আরও বাড়ে?”
“পরেশ ডাক্তারকে বাড়িতে আনলে তো অনেক টাকা ফিস দিতে হবে। এছাড়া পরেশ ডাক্তার কারও বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করে না। এত চিন্তা করছিস কেন? ভালো করে গরম কাপড় পরিয়ে নিলে নদীর বাতাস গায়ে লাগবে না।”
হালিমা বড়ো ভাইয়ের কথার বিরুদ্ধে আর কিছু বলল না। চুপ করে রইল।

আরও পড়ুন সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি-  
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১তম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!