সুতা-ছেঁড়া-ঘুড়ি-১১তম-পর্ব
উপন্যাস,  তাহমিনা খাতুন,  সাহিত্য

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব) 

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব) 
তাহমিনা খাতুন

বাইশ.
নূরপুরের মধ্যপাড়ার জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়ির বড়ো উঠানের এক কোণে অনেকগুলো বাঁশের চাটাই আর খেজুর পাতার পাটি বিছানো। সন্ধার কিছুক্ষণ পরে পূবপাড়া আর দক্ষিণপাড়ার বেশ বিশ-পঁচিশজন বিভিন্ন বয়সের মানুষ উঠানে বিছানো চাটাইয়ের উপর এসে বসল। কিছুক্ষণ পরে জান্নাতুল ফেরদৌসের এক মাত্র ছেলে ফেরদৌস তার বিছানার পাশের জানালা খুলে সবাইকে সালাম দিল। ফেরদৌসের বয়স এখন চব্বিশ বছর। চাটাইয়ে অপেক্ষমান লোকজনের মধ্য থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের আক্কেল আলি উঠে এল ফেরদৌসের জানালার পাশে। ফেরদৌস আক্কেল আলিকে সালাম দিয়ে বলল,
“আক্কেল ভাই, আপনারা সবাই যে উদ্দেশ্যে আমার বাড়িতে এসেছেন, তা আমি জানি। নূরপুরের সমাজ প্রধান হতে। কিন্তু আমার অবস্থা আপনারা সবাই জানেন। আমিতো এখন পুরোপুরি ঘর বন্দি। কারও সাহায্য ছাড়া বিছানায় উঠে বসতেও পারি না। আমার এই শারীরিক অবস্থায় আমার পক্ষে কি এত বড়ো দায়িত্ব পালন করা কি সম্ভব?”
“কেন সম্ভব না, ফেরদৌস ভাই? আপনাকে তো আর শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে হবে না। আগে আপনার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান সমাজ প্রধান ছিলেন, ওনার মারা যাওয়ার পর আপনার চাচাজান সমাজ প্রধান হলেন। ওনার মারা যাওয়ার পরে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে তো সমাজ প্রধান বানানোর মতো যোগ্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“ঠিক আছে, আপনারা এত জন মুরুব্বি এসেছেন, আপনাদের তো ফিরাতে পারব না। তবে আমার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো ভুল হলে আপনারা আমার ভুল শুধরে দিবেন আশা করি।”

জোছনা রাত। ফেরদৌসের বাড়ির উঠানে লাঠি খেলা চলছে। দক্ষিণ ও পুবপাড়ার চার-পাঁচ জন লাঠি খেলায় পারদর্শী যুবক নানান কসরত করে লাঠি খেলা দেখাচ্ছে। পাড়ার লোকজন ছাড়াও মধ্য ও দক্ষিণপাড়া থেকে বেশ কয়েকজন যুবক ও অল্প বয়সি ছেলে মেয়ে লাঠি খেলা দেখতে এসেছে। ফেরদৌস নিজের বিছানায় বসে জানালা দিয়ে নিজেও অন্যদের সাথে লাঠি খেলা উপভোগ করছে। লাঠি খেলায় বিজয়ীর জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে খেলা উপভোগ করে সবাই যার যার মতো নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেল।

বছর ঘুরে ঈদ এসেছে নূরপুরে। ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পরেই নিয়ম অনুযায়ী মধ্যপাড়ার পেয়াদা বেলাল ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার খবর সমাজ প্রধানকে জানাতে এসেছে। ঈদের চাঁদ ওঠার খবর জানার পর ফেরদৌস বেলালকে বলল,
“বেলাল ভাই, আপনি পূবপাড়া, দক্ষিণপাড়াসহ আমাদের পাড়ার সবাইকে জানিয়ে দেন; ঈদের দিন সন্ধ্যার পড়ে সবাই যেন আমার বাড়ির উঠানে ঈদের খাবার খেতে আসেন। আর আমাদের পাড়ার সবাইকে বলে দেন ওনারা যেন আব্বা এবং চাচাজানের সময়ের মতো বাড়িতে রান্না করা ঈদের খাবার থেকে দাওয়াতি মেহমানদের জন্য খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মেহমানদের খাবার খাওয়ার জন্য কলাপাতা কেটে রাখেন। সঙ্গে আগের বছরের মতোই আরও কয়েকজনকে জোগাড় করেন।

পূবপাড়ার মৃত হারুন মোল্লার দুই ছেলে ফজলু এবং রওশন। হারুন মোল্লা মারা যাওয়ার পর কয়েক বছর দুই ভাই পৈতৃক বাড়িতেই একান্নে বসবাস করছিল। কিছু দিন যাবত হারুন মোল্লার ছোটো ছেলে রওশন বড়ো ভাই ফজলুকে জানিয়ে দিয়েছে, সে আর একান্নে থাকতে চায় না। কাজেই ফজলু যেন পৈতৃক সম্পত্তির তার অংশ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে দেয়। ফজলু তাতে কোনো আপত্তি করেনি। কিন্তু রওশন একই বাড়িতে বসবাস করতে চায় না। তাকে তার পছন্দের জায়গায় ঘর তৈরি করে থাকতে দিতে হবে। ফজলু তাতেও রাজি, কিন্তু রওশনের চাহিদার কোনো শেষ নাই। এখন রওশন যেহেতু পৈতৃক ভিটায় থাকতে পারছে না, সেহেতু তাকে ফসলের জমি বা বাড়ির কাছাকাছি অন্য জমি দিলে পৈতৃক ভিটার তিন গুণ বেশি জমি দিতে হবে। ফজলু তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু রওশনের একটাই কথা!
“পৈতৃক ভিটা তো আগে থেকেই তৈরি করা আছে, আর আমাকে তো সম্পূর্ণ বাড়িটি নতুন করে তৈরি করে নিতে হবে।”
আর এ বিষয়ে একটা সমাধান চেয়ে ফজলু সমাজ প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
ফজলুর এই আবেদনের কারণেই আজ ফেরদৌসের বাড়ির উঠানে সালিশির আয়োজন করা হয়েছে। নূরপুরের মধ্যপাড়া এবং পূবপাড়ার আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিও রয়েছেন। শেষ পর্যন্ত রওশনের দাবিকৃত তিন গুণ জমি নয়, দুই গুণ বেশি জমি দিয়ে দুই ভাই আপোষ মীমাংসায় রাজি হয়েছে।
এভাবেই জান্নাতুল ফেরদৌসের ফেরদৌসের একমাত্র ছেলে চলৎশক্তিহীন ফেরদৌস সমাজ প্রধান হিসাবে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

তেইশ.
পৌষ মাস। নূরপুরের বিভিন্ন বাড়ির আশেপাশে খেজুর গাছে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন রঙের মাটির হাঁড়ি ঝুলছে। হাবিবুর রহমানের বাড়ির রান্না ঘরের পিছনে বেশ কয়েকটা খেজুর গাছ। পাশের গ্রামের লতিফ খেজুর গাছ কেটে রস বের করায় বেশ পারদর্শী। গতকাল বিকেলে লতিফ খেজুর গাছগুলো কেটে রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে রেখেছিল। আজ ভোর হওয়ার পরেই পাঁচ ছয়টা রসের হাঁড়ি নামিয়ে মোমিনার রান্না ঘরে রেখে গেছে। সকালেই মোমিনার ছোটো ছেলে মনিরকে পাঠিয়েছে।
পাড়ার আরও কয়েকজন নারী পুরুষ অল্প বয়সী ছেলে মেয়েকে খেজুরের রস খাওয়ার জন্য ডেকে আনতে। মোমিনা কয়েকটি গ্লাসে খেজুরের রস ঢেলে ঢেলে সবাইকে দিচ্ছে। সবাই মিলে গল্প করতে করতে কাঁচা খেজুরের রস খাচ্ছে। সবাইকে কাঁচা রস খাওয়ানোর পর বাকি রস দিয়ে আতপ চালের পায়েস রান্না হলে অনেকেই কাঁচা রসের পায়েস খেতে বসে গেল। অনেক সময় হাবিবুর রস জ্বাল দিয়ে পাঠালি গুড় তৈরি করে। আর সে গুড় দিয়ে প্রায় সারা বছরই মোমিনা বিভিন্ন ধরনের পিঠা পুলির আয়োজন করে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে খাওয়াতে মোমিনার কোনো ক্লান্তি নাই যেন।
পৌষ মাসের শেষের দিকে প্রতি বছরই হাবিবুরের ফুফাতো বোনের ছেলে মেয়েরা ঢাকা থেকে কয়েক দিনের জন্য নূরপুরে বেড়াতে আসে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সাথে নতুন আনন্দের খোরাক হিসেবে যোগ হয়েছে ভাগ্নি শামিমার আনা গ্রামোফোন। সারাদিন এবং অনেক রাত পর্যন্ত গ্রামোফোনে বাজছে বিভিন্ন ধরনের গান, নাটক-যাত্রাপালা ইত্যাদি। কয়েক দিন ধরেই উৎসবের আমেজে ভরে থাকল হাবিবুরের বাড়ি। যাবার সময় ঘনিয়ে এল।
শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠেই মোমিনা ভাগ্নি শামিমা আর তার ছেলে মেয়েদের রাস্তায় খাবার জন্য রান্না বসিয়ে দিয়েছে। মাকে সাহায্য করছে মোমিনার বড়ো মেয়ে কনা। শেষ রাতেই গোরুর গাড়ি এসেছে শামিমা আর ওর ছেলে মেয়েদের স্টিমারঘাটে পৌঁছে দিতে। পর দিন সকালে ওরা ঢাকা পৌঁছাবে। লম্বা যাত্রা পথে খাবার সঙ্গে দিয়ে না দিয়ে দিলে ওদেরকে স্টিমারের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
“মামি, তুমি এত কষ্ট করছ আামাদের জন্য। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে রান্না করেছ! আমরা তো স্টিমারঘাটেই খেয়ে নিতে পারতাম।”
“শোন মেয়ের কথা! আমি তোমাদেরকে স্টীমারে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে দিয়ে অসুস্থ হতে দেব বুঝি। তোমরা তো আর রোজ আসো না। এক দিন না হয় একটু কষ্ট করলাম।
“আচ্ছা মামি, নানি কেমন আছেন? তোমরা নানিকে তোমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারো না? সারাজীবন তো বেচারার একাই কাটল। এখন তো ওনার বয়স হয়েছে। কখন কোনো বিপদ হয়-তার কি কোনো ঠিক আছে?”
“মায়ের কথা আর বলো না! কত চেষ্টা করেছি আমার কাছে নিয়ে আসতে। তোমার মামাও কম চেষ্টা করেনি। মায়ের ওই এক কথা। তোমাদের বাড়িতে যখন তখন হালের কিষাণরা আসে। আমার পর্দা করতে সমস্যা হয়। এছাড়া যতদিন বেঁচে আছি, তোমার বাপের ভিটা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাই না।”
শামিমা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
“সত্যি মামি, তোমার মায়ের মতো এমন মানুষ খুব কমই দেখা যায়। শুনেছি, তোমার বয়স যখন মাত্র এক বছর, তখন তোমার বাবা মারা গেছেন। আর নানির বয়স তখন মাত্র ষোল। নানা মারা যাওয়ার পরে এত অল্প বয়সী একটা মেয়ের উপর দিয়ে কত ঝড় ঝাপটা গিয়েছে-সারাটি জীবন স্বামীর ভিটায় একা কাটিয়ে দিলেন। আমার বাবা আর দুই চাচাও অল্প বয়সে মারা গেছেন। আমার মা আর দুই চাচির পরনেও কত অল্প বয়সে সাদা থান উঠেছে। তাঁরাও জীবনের কোনো সাধ আহ্লাদ উপভোগ করতে পারেননি। তবু আমরা তো কয়েকটা ভাই-বোন ছিলাম, পাশাপাশি আমার দুই চাচিও ছিলেন, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষ ছিল। কিন্তু তোমার মায়ের কষ্টটা সত্যিই অন্য রকম। সচরাচর এমনটা দেখা যায় না।”
“শামিমার কথাগুলো শুনে মোমিনা আর কোনো কথা বলল না। শুধু আঁচলে চোখ মুছলো।”

আরও পড়ুন সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি-   
১ম পর্ব
২য় পর্ব 
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০তম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

সুতা ছেঁড়া ঘুড়ি (১১তম পর্ব) 

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!