সুজানগরের ইতিহাস বই রিভিউ
সুজানগরের ইতিহাস বই রিভিউ
আশরাফ খান
কিছুদিন আগেই হাতে পেয়েছি ড. আশরাফ পিন্টু ও মিজান খন্দকার রচিত ২০২১ সালের বই মেলায় পাললিক সৌরভ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘‘সুজানগরের ইতিহাস’’ বইটি। পড়ি পড়ি করে পড়া হয় না। পর্যাপ্ত সময় হয়ে উঠে না। একটু একটু করে পড়ি। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে। ভালো লাগা বিষয়গুলো আন্ডার লাইন করি। কোনটি নোট নিই। অনেকটা সৌখিন পাঠক আমি। লেখার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। পড়াটা জরুরী। জানার জন্য। না জানলেও ক্ষতি নেই। শিক্ষার প্রধানত দুটি প্রক্রিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক। আমরা অপ্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নে বেশি ব্যস্ত। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দায়বদ্ধতায় বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটা সুবিধা হলো নির্দিষ্ট সিলেবাস আছে। সিলেবাস শেষ করতে পারলেই মোটামুটি রক্ষা। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষ নেই। কিন্তু উপযোগিতা আছে। আবার না করলেও ক্ষতি নেই। আর লেখালেখি অথবা জ্ঞানচর্চা তলাবিহীন সমুদ্র।
স্যার আইজ্যাক নিউটনের একটি কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি জীবনের শেষবেলায় বলেছিলেন- ‘আমি জানি না বিশ্ব আমায় কীভাবে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু আমার চোখে আমি কেবলই এক ছোট বালক যে সমুদ্র উপকূলে মনের আনন্দে খেলে বেড়িয়েছে আর কখনো কখনো একটু বেশি মসৃণ নুড়ি-পাথর কিংবা সুন্দুর ঝিনুক খুঁজে পেয়েছে। এদিকে সত্যের মহাসমুদ্র আমার সামনে অনাবিষ্কৃতই থেকে গেল।’ জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।
আশরাফ পিন্টু ও মিজান খন্দকার কবি নয়, লেখক। যারা কবিতা লেখে সহজ অর্থে তাদেরকে কবি বলা হয়। কিন্তু প্রত্যেক লেখকই একজন কবি। কেননা প্রতিটি লেখকের অভিষেক ঘটে কবিতার মাধ্যমে। এমন লেখক খুঁজে পাওয়া সত্যিই কষ্টসাধ্য। যিনি জীবনে এক লাইন কবিতা লেখেন নাই। প্রতিটি লেখকই প্রত্যেক্ষ অথবা পরোক্ষাভাবে কবি। আবার সাধারণ মানুষ কবি-লেখক-কথাসাহিত্যিক সবাইকে একিভূত করেন কবিদের কাতারে। সুতরাং কবিদের নিয়ে সকল উদ্ধৃতি লেখকদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। আশরাফ পিন্টু লেখার পিছনে ছুটে চলছেন নিরন্তর । এই চলার পথে তার কোনো ক্লান্তি নেই। অণুগল্প/ছোটগল্প, প্রবন্ধ, আঞ্চলিক ইতিহাস তার সাহিত্য চর্চার প্রধান উপজীব্য বিষয়। অণুগল্পে তিনি সিদ্ধহস্ত। তার অণুগল্প বাংলা সাহিত্যের এক নতুন মাত্রার সংযোজন।
আরও পড়ুন আনন্দ বাগচি-এর চকখড়ি উপন্যাস রিভিউ
মফস্বল থেকে সাহিত্যচর্চায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব এমনটি নয় । তবে বেশ কষ্টসাধ্য। এই কঠিন কাজটি আশরাফ পিন্টু খুব দক্ষতার সাথেই সম্পাদন করছেন। তার ভিতর এক ধরণের নেশা আছে। যা আফিমের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। যে নেশার নাম ইতিহাস চর্চা। কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের চেয়ে ইতিহাস রচনা অনেকটা জটিল। সকল লেখনির জন্য মানুষের কাছে পৌঁছিতে হয়। তবে কবিতা, গল্প, উপন্যাস আমাদের যাপিত জীবনের গন্ধ রস ও অভিজ্ঞতা থেকে ঘরে বসেই লেখা সম্ভব। কিন্তু ড্রয়িং রুমে বসে ইতিহাস লেখা যায় না। ইতিহাস লেখতে হলে ক্ষেত্র অনুসন্ধান জরুরী। আর এজন্য দৌঁড়াতে হয়। প্রয়োজন হয় পূর্বোক্ত অনেক বইয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়।
ড. আশরাফ পিন্টু ও মিজান খন্দকার রচিত ‘‘সুজানগরের ইতিহাস’’ একটি সমৃদ্ধ আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ। মোট ৪০০ পৃষ্ঠার নান্দনিক প্রচ্ছদ, নিখুঁত বাইন্ডিং, আশি মিলিগ্রাম অফহোয়াইট কাগজে মুদ্রিত বইটি প্রথম দেখাতেই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অতঃপর ভিতরে প্রবেশ করেই পাঠক সম্মোহিত হবেন ইতিহাসের নেশার ঘোরে। গ্রন্থটিতে এক ধরনের জাদুর ছোঁয়া আছে। যা বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করে। মেগা সিরিয়ালে যেমন এক পর্ব দেখলে অন্য পর্ব দেখার আসক্তি জাগে। ঠিক তেমনি আসক্তি আছে সুজানগরের ইতিহাস গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ে।
বইটি প্রথমাংশে সুজানগরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রঙিন আলোকচিত্রে গ্রন্থের বৈচিত্র্যতা ফুটে উঠেছে। আলোকচিত্রগুলোর মধ্যে শাহ সুজা (যার নামে এই উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে), খয়রান গ্রামের তালুকদার বাড়ির প্রাচীন জামে মসজিদ, দুলাই আজিম চৌধুরীর জমিদার বাড়ীর প্রাচীন জামে মসজিদ এবং মসজিদের দেয়ালে ফারসি ভাষায় লেখা দেয়াল লিপি,আজিম চৌধুরীর কবর, তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়ীর ভগ্ন মঠ, তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়ী, পদ্মানদীর তীরে নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ, শাহ মাহাতাব উদ্দিন (রহ.)-এর মাজার, সাতবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের নবনির্মিত শহিদ মিনার, সুজানগর পাইলট বিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম মোস্তফা কামাল দুলালসহ পাবনা অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ছবি, চার শহিদের কবর এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল হাই মিয়ার স্ত্রীকে সমবেদনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের প্রেরিত চিঠির আলোকচিত্র বইটিকে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে।
আরও পড়ুন পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বই রিভিউ
প্রথম অধ্যায় পাঠের মাধ্যমে জানা যায়- সুজানগর উত্তরবঙ্গের জেলা পাবনার একটি উপজেলা। যা জেলা সদর হতে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সুজানগরের পূর্ব নাম ছিলো গোবিন্দগঞ্জ। মুগল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষাংশে তাঁর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন দখল নিয়ে বিরোধ হয়। তখন তার এক পুত্র যুবরাজ শাহ সুজা আরাকানে পালিয়ে যান। তিনি আরাকান গমনের সময় গোবিন্দগঞ্জে তিন রাত অবস্থান করেছিলেন। যুবরাজ শাহ সুজার এই অবস্থানকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় লোকজন এ জনপদের নামকরণ করেন সুজানগর।
আত্রাই সুজানগর উপজেলার প্রধান নদী। উপজেলার সাতবাড়িয়া, মানিকহাট, নাজিরগঞ্জ ও সাগরকান্দি ইউনিয়ন ঘেষে বয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা। সুজানগরের প্রধান কৃষি পণ্য পিঁয়াজ। সুজানগরের উৎপাদিত পিঁয়াজ দেশ বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় এটি এখানকার প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে খ্যাত। এ অধ্যায়ে আরো আছে পত্র-পত্রিকা, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম। ‘এক নজরে সুজানগরে উপজেলা’ থেকে খুব সহজেই এ উপজেলার বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানা যায়। এ উপজেলায় রয়েছে ১০টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা। ইউনিয়নগুলো হলো ভায়না, সাতবাড়িয়া, মানিকহাট, নাজিরগঞ্জ, হাটখালী, সাগরকান্দি, রাণীনগর, আহম্মদপুর, দুলাই ও তাঁতিবন্দ। পৌরসভা ও ইউনিয়নসমুহের পরিচিতি, ইউনিয়নের গ্রাম ভিত্তিক জনসংখ্যা, বিভিন্ন ইউনিয়নের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে। দুলাই আজিম চৌধুরীর জমিদার বাড়ী, তাঁতিবন্ধ বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীর জমিদার বাড়ী, নাজিরগঞ্জ নীলকুঠি ও ফেরিঘাট, পুকুরনিয়া শাহ মাহাতাব উদ্দিন আউলিয়ার মাজার শরীফ, বিল গাজনা এখানকার দর্শনীয় স্থান এবং ঐতিহ্যের অংশ।
সুজানগরে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমাজ-সংস্কৃতির বিবরণ আছে বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে। খ্রিস্টপূর্ব থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের ধারাবাহিক ইতিহাস নিখুঁতভাবে রচিত হয়েছে এই অধ্যায়ে। উঠে এসেছে পুন্ড্রনগর, পাল বংশ, সেন রাজত্বকাল, দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকরে শাসনকাল, ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির শাসনকাল, শের শাহ শুরি, ইসলাম শাহ, সামছুদ্দিন মোহাম্মাদ শাহ, গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ, দাউজ কররানি, মোঘল সম্রাট রাজা মানসিংহ, ইসলাম খাঁ, শাহজাদা মুহম্মদ সুজা, মির জুমলা, নবাব শায়েস্তা খাঁ, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ, আলিবর্দি খা’র শাসন ব্যবস্থা। এই অধ্যায়ে আরো রয়েছে প্রজা বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সুজানগরের ঐতিহাসিক পটভূমি।
আরও পড়ুন শফিক নহোর-এর গল্পগ্রন্থ মায়াকুসুম রিভিউ
ঐতিহাসিক নির্দশন সম্পর্কে লেখকদ্বয় যথার্থই বলেছেন ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে জমিদার বাড়ী। যা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর সাথে এক-একটা জমিদার বাড়ির আছে এক এক রকমের ইতিহাস।’ লেখক আরো উল্লেখ করেছেন ‘সুজানগর উপজেলার দুইজন বড় জমিদারের দেখা মেলে তারমধ্যে একজন তাঁতিবন্দের চৌধুরী জমিদার এবং অপরজন দুলাইয়ের জমিদার আজিম চৌধুরী। এরা শুধু সুজানগর উপজেলার মধ্যে নয়, পাবনা জেলা তথা আশেপাশের অঞ্চলের মধ্যেও বিখ্যাত ছিলেন’। এই অধ্যায়ে অন্যান্য অনুচ্ছেদগুলো হলো লৌকিক জীবন, ধর্মীয়জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন। এই অধ্যায়ে শেষাংশে ‘প্রান্তিক পেশাজীবীদের জনজীবন’ অনুচ্ছেদটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুচ্ছেদ রচনার মাধ্যমে ইতিহাস চর্চায় লেখকদ্বয়ের দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছে।
সুজানগর উপজেলার প্রান্তিক পেশাজীবীদের মধ্যে মুচি, মেথর, কুমার, চুনিয়া, ছুতার, জেলে, নাপিত, কর্মকার, গাছি, মালি, বারই, কাপালিক এবং বেদের বৈচিত্রময় জীবন ফুটে উঠেছে এই অনুচ্ছেদে।
লোক সংস্কৃতি বাঙলার নিজস্ব সম্পদ। প্রতিটি জনপদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। যার নাম লোক সংস্কৃতি। লোক সংস্কৃতি মাধ্যমে একটি জনপদের ইতিহাস ঐতিহ্য অনুমান করা যায়। সুজানগরে লোকসংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে লোকছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ, মন্ত্র, লোকসঙ্গীত, মেয়েলি গীত, লোককবিরদের গান, লোককথা, লোকভাষা, লোক খেলা ও লোক উৎসব প্রভৃতি। সুজানগের লোকছড়ার মধ্যে দু’টি ছড়া উল্লেখ করা হলো। অলদি কোটন কোটন/ জামাই মোটন মোটন/ আর অলদি কোটপনা/ টেটনকে বিয়া দেব না/ টেটন অইলো দুদির ছাও/ দুদ খায়্যা যায় পাড়ার ম্যাও। অপর ছড়াটি হলো- তাঁতিবন্দের ঐক্য/মহেশ চৌধুরীর বাক্য/ধরলা বিলের ব্যাঙ/ পূর্ণ মৌলিকের ঠ্যাঙ/ বিজয় বাবুর ঘড়ি/রাধানাথ কবিরাজের বড়ি/ঈশ্বর অধিকারীর জপের মালা/ বিশ্বাস করে কোন শালা। এই ছড়া দুটির মাধ্যমে সুজানগরের সামাজিক প্রথা, ঐতিহ্য ও লোকবিশ্বাস সম্পর্কে কিঞ্চিত ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
লোক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ধাঁধাঁ। সুজানগরে মানুষকে নিয়ে একটি ধাঁধাঁ প্রচলিত আছে। ধাঁধাঁটি হলো- ব্যায়না চার পাও/ দুইপরে দুই পাও/ বিহালে তিন পাও। অনুরুপ আখ নিয়ে একটি বহুল প্রচারিত ধাঁধাঁ হলো- মদ্যি বিলে লগি গাড়া/ তার ভিতরে মধু ভরা। এই ধাঁধাঁ গুলোর মাধ্যমে স্থানীয় জনপদের বুদ্ধিমত্তা, রসিকতা এবং একইসাথে আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ুন সরদার জয়েনউদদীন-এর গল্পগ্রন্থ নয়ান ঢুলী রিভিউ
এ অঞ্চলের লোক প্রবাদগুলো বেশ শক্তিশালী এবং যুগোপযোগী। যেমন ‘ কর্তার পাদে গন্ধ নাই’। আবার ‘খুটার জোড়ে ভ্যাড়া লাফায়’ লোক প্রবাদ থেকে খুব সহজের সমাজের প্রভাবশালী ও তাঁদের অনুচরদের আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়। সুজানগরের লোকসঙ্গিতের মধ্যে জারিগান, সারি গান, ধুয়াগান, মেয়েলীগীত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থে বেশ কয়েকটি লোক সংগীত উপস্থাপিত হয়েছে। তারমধ্যে মাছ সংক্রান্ত একটি ধুয়াগান বেশ প্রণিধানযোগ্য ‘ভেদা মাছ খায় বসে কাদা/ গোলশা মাছ পান চিবায়/ ট্যাপা মাছে ট্যাপ ফুলায়ে রয়/ কাতল মাচের মধ্যে মোটা/ পাঙাস মাছের তি কাটা/ টাকি মাছের বাঁধল ল্যাটা। গ্রন্থে বর্ণিত একটি মেয়েলি গীত- পাবনা শহরের ফাইন শাড়ি তোমায় কিনি দিবি কে ? পাবনা শহরের জুতা শাড়ি তোমায় কিনি দিবি কে ? ঘরে আছে নুতন জামাই আমায় আইনা দিবি সে’। এসব লোকগানের মাধ্যমে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। বাদ পড়েনি লোক খেলা।
সুজানগরের লোক খেলাসমুহের মধ্যে রয়েছে হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, মালাম, লাঠিবারি, বৌচি, এক্কাদোক্কা, হৈল টুক টুক প্রভৃতি এবং লোকউৎসব মধ্যে হালখাতা, কলাগাছের গেট ও চড়কমেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুজানগরের লোক সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে হয়েছে বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে।
পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে গ্রাম-মহল্লার নামকরণের ইতিহাস। আহম্মদ আলি নামানুসারে আহম্মদপুর, তাঁতিদের সংখ্যাধিক্য থেকে তাঁতিবন্দ, হযরত দুল্লাহ কামেলের নামনুসারে দুলাই, তরিকুল্লা নাজিরের নামনুসারে নাজিরগঞ্জ, জমি ক্রয়ের ‘বায়না’ থেকে ভায়না, মানিকচাঁদের স্থাপিত হাট থেকে ‘মানিকহাট’, রানি ভবানীর নামনুসারে রানিনগর নামকরণ হয়েছে। গ্রামের সাধারণ লোকের চোখে প্রমত্তা পদ্মা যেন একটা সাগর। পদ্মার তীরে অবস্থিত বলে এই জনপদের নামকরণ হয়েছে ‘সাগরকান্দি’। সাতটি পাড়া নিয়ে গঠিত হওয়ায় সাতবাড়িয়া এবং হাট না থাকায় নামকরণ হয়েছে হাটখালী । এই অধ্যায়ে পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়নে অন্তর্গত গ্রামসমুহের নামকরণের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা পাঠের মাধ্যমে পাঠক এক অন্যরকম স্বাদ উপভোগ করবে।
আরও পড়ুন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন-এর হারামণি রিভিউ
‘সুজানগরে মুক্তিযুদ্ধ’ অধ্যায়টি গ্রন্থটিতে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছে। মুক্তিযুুদ্ধের ইতিহাস ব্যতিত কোন ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হতে পারে না। দক্ষ লেখকগণ বিষয়টি যথার্থ অনুধাবন করেছেন। এই অধ্যায় উপস্থাপিত হয়েছে রণাঙ্গনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। উঠে এসেছে নৃশংস গণহত্যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের পৈচাশিক নির্যাতনে সাগরকান্দি গণহত্যায় প্রায় ২৫০ জন, সাতবাড়িয়া গণহত্যা ৭০০/৮০০ জন, নন্দিতা সিনেমা হলের উত্তরে ১৮/১৫ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল মজিদ সরকারের সাক্ষাৎকার বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ অধ্যায়ে আরো আছে স্বাধীনতা বিরোধীদের দমন প্রক্রিয়া, পাকসেনা ছদ্মবেশে শক্রুর উপর আক্রমণ, নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাট যুদ্ধ, সুজানগর থানা দখল ও মুক্ত, স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযুুদ্ধের বিজয় স্তম্ভ, চার শহিদের কবর, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণের নামের তালিকা। যা অদূর ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কাজে সহায়ক হবে।
সুজানগরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস রয়েছে গ্রন্থের সপ্তম অধ্যায়ে। এই অধ্যায়ে আছে সুজানগরের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এবতেদায়ী মাদ্রাসার তালিকা। রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান, নামকরণের ইতিহাস, স্থাপনের সময়কাল, প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠান প্রধানের নাম, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, জমির পরিমাণ, ভবনের বিবরণ, শিক্ষার ব্যপ্তি, জনপ্রিয়তা, বর্তমান ও পূর্বোক্ত ম্যানিজিং কমিটির সভাপতির নাম পরিচয়।
বর্তমান ও সাবেক মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, উপজেলা চেয়ারম্যানগণ, পৌর চেয়ারম্যান/মেয়রদের বর্ণাঢ্য জীবন কথা দিয়ে সাজানো হয়েছে গ্রন্থটির অষ্টম অধ্যায়। এই অধ্যায়ে আরো রয়েছে এ উপজেলার শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংক্ষিপ্ত জীবনী। গ্রন্থটির শেষাংশে পরিশিষ্ট -১ এ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা এবং পরিশিষ্ট-২ এ ঐতিহাসিক রাধারমন সাহার ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থের পঞ্চম খন্ডের প্রথম অধ্যায়ের অষ্টম পরিচ্ছেদ ‘সুজানগর’ খন্ডাংশ সংযোজন বইটির গুণগত মান অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে।
আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার-এর তারা পরিচিতি রিভিউ
বইটির দুইপাশের ফ্লাপে দুইজন লেখকের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে। যা চিরাচরিত নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। আবার বইটির শুরুতেই লেখকদ্বয়ের আরো একটি একটি ছবি সংযোজন করা হয়েছে। যার উপযোগীতা তুলনামূলক কম। গ্রন্থের শুরুতে আলোকচিত্র সংযোজন যেমন নতুনত্ব আনয়ন করেছে, তেমনি প্রচলিত ধারার কিছুটা ব্যতয়ও ঘটেছে। এই ধরনের চিত্র সাধারণত বইয়ের শেষাংশে সংযোজন করা হয়। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নের বর্ণনায় ওই ইউনিয়নের দর্শনীয় স্থান, পুরাকীর্তি এবং ঐতিহ্যের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সমগ্র উপজেলার প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক নিদর্শন, দর্শনীয় স্থান, পুরাকীর্তি পৃথক একটি অধ্যায়ে বর্ণনা করলে আরো ভালো হতো। প্রান্তিক পেশাজীবীদের জনজীবন অনুচ্ছেদে লোক পেশা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে এই অংশটুকু ‘ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমাজ সংস্কৃতি’ অধ্যায়ের পরিবর্তে লোকসংস্কৃতির অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করলে আরো যুক্তিযুক্ত হতো।
পুঁজিবাদ সমাজ ব্যবস্থায় অর্থ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে পুঞ্জিভূত। অল্প কিছু অর্থ খোলা বাজারে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা ভুখা-নাখা মানুষগুলো সেই অর্থ সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। আমাদের চাওয়া খুব বেশি না। তবে মৌলিক চাহিদা পুরণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, অতোটুকুই প্রতিযোগীতামূলক শ্রম বাজার থেকে ঘরে নিয়ে আসতেই আমরা হিমশিম খাই। দিনের কর্মক্ষম অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় উপার্জনের পেছনে। আর রাত্রি হলেই ক্লান্ত চোখে নেমে আসে ঘুম। ঘুম থেকেই উঠে শুরু হয় পুনরায় যান্ত্রিক জীবন। এই আক্ষেপে একজন কবি বলেছিলেন ‘ঘুম থেকে উঠেই অফিস, অফিস থেকে সোজা বাড়ি, ধরা ছোঁয়ার বাইরে, নদী ও নারী। এটাই এখানকার মধ্যবৃত্ত ও নিম্নবৃত্ত মানুষের জীবনচিত্র।
এই যান্ত্রিক জীবন পাশ কাটিয়ে আশরাফ পিন্টুরা কীভাবে প্রতি বছরে দুইটি, তিনটি, চারটি বড় বড় ঢাউস বই রচনা করেন তা দেখে সত্যিই অভিভূত হই। বয়স তার পঞ্চাশ পাড় হয়েছে মাত্র। মিজান খন্দকারের পয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই। জীবনের আরো অনেকটা সময় হয়তো পাবেন তাঁরা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সাফল্যের চরম শিখরে পৌছবেন আশা করা যায়। আর তাদের লেখা পড়ে আমরা ঋদ্ধ হচ্ছি। হবো। আজ ও আগামীতে।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে