সুকৃতি এবং বৈরীকাল (১ম পর্ব)
সুকৃতি এবং বৈরীকাল (১ম পর্ব)
সুকৃতির লাশটা পৌছুতেই এক অভূতপূর্ব বিষাদ আর অন্তহীন কান্না গ্রাস করল পুরো বাড়িটাকে। বেদনার একটা গাঢ় নিকশ কালো চাদর ঢেকে দিলো সবুজ হৃদয়ের সুবর্ণ প্রত্যাশা, হিরণময় সম্ভাবনার মোহন শরীর। তেইশ বছরের টগবগে সুদর্শন সুকৃতি যখন বাড়ি থেকে ‘এই আসছি’ বলে বেরিয়েছিল, তখন কেউ ভাবতেই পারেনি সবাইকে কাঁদিয়ে সে ফিরবে নিঃসার লাশ হয়ে। বহুমুখী প্রতিভাময় সুকৃতিকে ঘিরে বাবা-মায়ের স্বপ্নের এক সুরম্য ভূবন তৈরি হয়েছিল। খুব ছোটবেলায় ওকে দেখেই এক জ্যোতিষী বলেছিল, এ ছেলে অনেক বড় হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। ক্রমাগত ওর বহুমাত্রিক প্রতিভার স্বতঃস্ফুরন আর জ্যোতিষীর কথায় প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিল বাবা-মা’র মনও। তাই ওকে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার ব্যাপারে প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না তাঁদের। সুকৃতির বাবা সরকারি কর্মকর্তা। বদলির চাকরি। ২/৩ বছর পরপরই বদলি হতে হয়।
এই টানা-হেঁচড়ায় সুকৃতির পড়াশুনায় ক্ষতি হবে ভেবেই সে সময়ের বেশ নাম করা ঢাকা রেসিডেন্সিয়েল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবা। রেসিডেন্সিয়েলে সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন। ভর্তি পরীক্ষায় ভীষণ প্রতিযোগিতা। হাজার হাজার ছাত্র পরীক্ষা দেয়। এক আসনের জন্যে ১০/১৫ জন প্রার্থী। ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় টিকলেই কেবল ভর্তি হবার সুযোগ পাওয়া যায়। সুকৃতির উপর আস্থা থাকলেও ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত বাবা-মার দুশ্চিন্তা কাটল না। কিন্তু তাঁদের সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সুকৃতি খুবই ভালো রেজাল্ট করল ভর্তি পরীক্ষায়। সবার মধ্যে ও হলো দ্বিতীয়। অভিভাবকের সাথে সাক্ষাতকারে আর্মির কর্নেল অধ্যক্ষ সাহেব যখন সুকৃতির প্রশংসা করে আশাবাদী ভবিষ্যতের কথা বললেন, তখন আনন্দ আর গর্বে বুকটা ভরে উঠল বাবার। অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেড়িয়ে এসেই বাইরে অপেক্ষমাণ সুকৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। পাশে দাঁড়ান তাঁর মিসেসকেও জানালেন সুসংবাদটা। বাবা-মায়ের আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হলো সুকৃতিও।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
ক্লাস থ্রিতে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়ে গেল সুকৃতি। বাক্স-পেটরা, লেপ-তোশক নিয়ে হলে উঠল সে লালন শাহ হলে । একেবারে নতুন পরিবেশ, অচেনা সবাই । কিছুটা ঘাবড়ে গেল সুকৃতি। কোনোদিন মা-বাবা ছাড়া থাকেনি সে। পড়া আর খেলা ব্যতীত অন্য কোনো কাজ করতে হয়নি। ঘরের কুটোও সরায়নি কখনো। এখন নিজের সব কাজই করতে হবে তাকে, বলা যায় জুতো। সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। জলের মাছ ডাঙ্গায় পড়লে যে অবস্থা হয়, ছোট্ট সুকৃতির অবস্থাটা হলো তেমনি। বাড়ির খাবার আর হোস্টেলের খবারের মধ্যে যে পার্থক্য সেটাও প্রথম দিকে ভীষণ কষ্ট দিতো সুকৃতিকে। ঠিকমতো পেট পুরে খেতে পারত না। ফলে কদিনেই স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেল তার। অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে সব বাচ্চাদেরই এমন হয়। আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয় তারা। অনেকে স্বজনহীন নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে বাসায় ফিরেও গিয়েছে। কিন্তু স্বভাবচাপা সুকৃতি কোনোদিনই কোনো অনুযোগ করেনি।
‘প্যারেন্ট’স ডে’তে মা-বাবার কাছে অনেক বাচ্চা কান্নাকাটি করে নানান অসুবিধার কথা জানলেও সে হাসি মুখে স্বাভাবিক থাকারই চেষ্টা করত। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালেই ভেতরের কষ্টটা বোঝা যেত। আগের সেই উচ্ছলতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পরে গেলেও মায়ের কোলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আদর নেবার যে আনন্দ-প্রয়াস, সেই প্রানবন্ততা এখন আর ওর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর কোমল অনুভূতিতে কেমন যেন চির ধরেছে, নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে আবেগ। ওর মা ছেলের এই অবস্থা দেখে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্যে উঠে পড়ে লাগল । একবার তো সে জোর করেই অধ্যক্ষের কাছে নিয়ে গেল সুকৃতির বাবাকে। আর্মি অফিসার অধ্যক্ষ সাহেব খুবই নিয়মতান্ত্রিক, কম কথা বলা লোক।
আরও পড়ুন গল্প পাথরে ফুল
ছেলেকে ফিরিয়ে নেবার কথা শুনে অধ্যক্ষ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
‘দেখুন, আমি আপনাদের মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছি। বিশেষ করে সুকৃতির মায়ের মানসিক উদ্বিগ্নতা। একটা ছোট্ট ছেলে বাবা-মাকে ছেড়ে যে কোনো নতুন পরিবেশে গেলে একটু বিষণ্ণ হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথম দিকে সব বাচ্চাদেরই এমন হয়। তবে আস্তে আস্তে সবাই খাপ খাইয়ে নেয়, স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । দেখবেন আপনার ছেলেও ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া সুকৃতি খুবই bright Ges promising. আমরা ওকে নিয়ে বেশ আশাবাদী। এখানে সুকৃতি ভালো করবে বলেই আমাদের ধারণা। তারপরও তাকে এই প্রতিষ্ঠানে রাখবেন কিনা that’s your decision. তবে ভালো করে ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সঙ্গত বলে আমি মনে করি।’
অধ্যক্ষ সাহেবের মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হলো না। সুকৃতিকে ছাড়তে চান না তিনি। ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাও ভাবলেন মা। বেশ দোটানায় পড়ে গেলেন তিনি। বুঝতে পারছেন না ছেলেকে এ প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে যাওয়া সঠিক হবে কিনা। এখানে ভর্তি হওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। কি করবেন তিনি? জিজ্ঞাসু চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি। সিদ্ধান্ত চাইছেন।
স্মিত হেসে বাবা বললেন,
‘ধন্যবাদ প্রিন্সিপ্যাল সাহেব, আমরা আরও ভেবে সিদ্ধান্ত জানাবো আপনাকে।’
‘OK. Thats up to you.’ ছোট্ট করে বললেন অধ্যক্ষ সাহেব।
‘আমরা কি সুকৃতির সাথে একটু দেখা করতে পারি?’ আকুতি ভরা প্রত্যাশার চোখে তাকালেন মা অধ্যক্ষ সাহেবের দিকে।
‘Yes, thats possible ‘
অধ্যক্ষ সাহেব ডাকিয়ে আনালেন সুকৃতিকে। Wating room-এ মা-বাবার সাথে দেখা হলো সুকৃতির। পাশে বসিয়ে সঙ্গে আনা খাবার ছেলেকে মুখে তুলে খাওয়ালেন মা। পরিতৃপ্ত মা নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলেন মুখ। তারপর ছেলের মাথাটাকে বুকের মধ্যে টেনে হু হু করে কেঁদে দিলেন। কান্না যেন থামতেই চায় না। সুকৃতি মুখ তুলে মায়ের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘তুমি কাঁদছো কেন মা? আমি তো ভালো আছি। স্যাররা আমাকে খুব আদর করেন। আমার রুমমেটরাও খুব ভালো। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না এখানে।’ অতটুকুন ছেলের মুখে এমন কথা শুনে ছেলেকে আরও জোরে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরেন মা। চোখে তাঁর অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা।
আরও পড়ুন গল্প কথোপকথন
রেসিডেন্সিয়ালেই থেকে গেল সুকৃতি। বাবা ঢাকার বাইরে চাকরি করায় প্রত্যেক parent’s day-তে যাওয়া সম্ভব হতো না বাবা-মা’র। ঢাকায় বসবাসরত নানি যেতেন তখন সুকৃতিকে দেখতে। কাজের চাপে কখনো কখনো তাঁর পক্ষেও যাওয়া হয়ে উঠত না। প্রায়ই হতো এমন। এই না যাওয়াটা প্রচণ্ড বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল সুকৃতির মনের উপর। Parent’s day’তে সব ছাত্রের বাবা-মা যখন তাদের সন্তানদের পরম আদরে কাছে টেনে আপ্যায়ন করত, নিজের হাতে মুখে তুলে খাওয়াতো তখন সুকৃতি অসহায় এতিমের মত চেয়ে থাকত, বিষণ্ন মনে ঘুরে বেড়াত এদিক-ওদিক, কখনো বা ঘরে গিয়ে একাকী গুমরে গুমরে কাঁদতো। নিজেকে তখন খুব অপায়ে মনে হতো তার। বাবা-মা’র ভালোবাসা নিয়েও অবুঝ শিশুর কোমল মনে নানা প্রশ্ন উঠত।
শিশু মন সব কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝে না, বোঝে আবেগ দিয়ে, না পাওয়ার বেদনার নিরিখে। আদর-স্নেহের কাঙ্গাল হৃদয় যখন দিনের পর দিন বাবা-মা’র সাহচার্য, ভালোবাসা বঞ্চিত হয়, তখন ভেতরে ভেতরে তাদের প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়, ক্ষুব্ধতা জন্মায়। আর ফলশ্রুতিতে অলক্ষ্যে এই সব স্নেহ-বুভুক্ষু সন্তানদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা এবং মানসিক গঠন ব্যহত হয়। তাদের মধ্যে এক ধরনের বিষাদ আর হতাশার জন্ম নেয়। কোমল সুকুমার বৃত্তি পূর্ণাঙ্গ বিকশিত হয় না। তাদের বড় হওয়া হয় অসম্পূর্ণ, অপরিপক্ক। আমাদের দেশে অনেক বাবা-মা’ই শিশুদের স্বাভাবিক চাওয়াকে গুরুত্ব দেয় না, উপেক্ষা করে।
আরও পড়ুন সুকৃতি এবং বৈরীকাল-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সুকৃতি এবং বৈরীকাল (১ম পর্ব)