সাদা মেঘের তুলো (১ম পর্ব)
সাদা মেঘের তুলো (১ম পর্ব)
শাহানাজ মিজান
বৃষ্টির দিনে কোনো কাজ যদি না থাকতো, কতই না ভালো হতো। গ্রামের বাড়িতে টিনের ঘরের চালের উপর ঝমঝম বৃষ্টির; রিমঝিম রিমঝিম শব্দ শুনতে দারুণ লাগে। মনে হয়, প্রেয়সী যেন আলতা রাঙা পায়ে নূপুর পরে ছন্দে ছন্দে আনন্দে নৃত্য করছে। আর সে নৃত্য দেখতে দেখতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে মন চায়। অলসতা এসে ভর করে সমস্ত শরীরে,মনে। বিছানাও যেন আপন করে, আদরে জড়িয়ে রাখে।
শহরের মানুষ প্রকৃতির এই রোমাঞ্চকর স্বর্গীয় অনুভূতি থেকে বঞ্চিত, তবে বৃষ্টি বিলাসী মন যার, সে সব জায়গাতেই প্রকৃতির রোমাঞ্চ খুজে পায়।
বৃষ্টির আজ অভিমানের পালা চলছে, অঝোরে কেদেঁই যাচ্ছে, থামতে চাইছে না। নাহ আজ আর অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না অমিতের। বালিশের নীচে থেকে ফোনটা বের করে দেখলো, প্রায় দশটা বাজে। অফিস আওয়ার শেষ, নিয়তও পাকা, আজ আর অফিসে যাবে না।
আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম
অনাকাঙ্খিত বৃষ্টি, তবুও ভালো লাগছে খুব। ফাল্গুন মাসে এমন বৃষ্টি হয় কখনো, মনে পড়ে না। ভেবেছিলাম আজ অফিস শেষে একবার বইমেলায় যাবো কিন্তু এমন বৃষ্টি হবে কে জানতো।
হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভেঙে, বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
কোথাও এতোটুকু বাতাস নেই, কিন্তু রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি ঝড়েই যাচ্ছে। এমন সময় নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা হারিয়ে যেতে চায় ঐ দূর নীল সীমানায়। এমন সময় নোড়ার কথা মনে পড়লো। নোড়ার খুব পছন্দ এমন বৃষ্টি।
খোলা বারান্দায় বসে আছি। বৃষ্টি হচ্ছে অথচ আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে পাগলা হাওয়ায় বৃষ্টির ছিটাফোঁটা এসে ছুয়ে দেয় চোখ-মুখ-ঠোট। হাতে কাজী নজরুলের দোলন চাঁপা, আর ধোয়া ওঠা এক কাপ চা। ভাবোতো, কেমন লাগবে? দারুণ লাগবে তাইনা ,অমিত? বৃষ্টি আমার এতোটুকু পযর্ন্তই পছন্দ। বেশি হলে কেমন যেন লাগে।
মনে হচ্ছিলো, আমার পাশে চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে নোড়া এই কথাগুলো বললো। অথচ কতোগুলো বছর ওকে দেখিনি আমি।
আমি আজ একাই বাসায় আছি, বৃষ্টি এসে ভালোই হয়েছে, অন্তত সঙ্গী জুটলো। একা একা বৃষ্টির সাথে কথা বলবো। নিজেই বলবো আর নিজেই শুনবো। বারান্দার গ্রীল ধরে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে থাকবো, ভিজবো কিছুক্ষণ। একটু ঠাণ্ডা লাগবে, লাগুক।দেখার বা বারণ করার মতো কেউ তো নেই।
বৃষ্টির কারণে হয়তো বুয়া আজ কাজে আসেনি। মা গেছেন বড় আপার বাসায়। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা খুব একাকিত্ব বোধ করেন। মা, প্রথম প্রথম আমাকে খুব চাপ দিতেন, যেন সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করি। এখন আর বলেন না, হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছেন। মা কোথাও যাওয়ার কথা বললে, বাধা দিই না। বয়স হয়েছে, তার ভালো থাকাটাই শেষ কথা। যখন যেখানে ভালো লাগে যাক। মা ভালো আছে, খুশিতে আছে, এটা দেখেই নিজের ভালো থাকা। বড় আপার বাচ্চাদের সাথে হাসি-মজায় মায়ের বেশ সময় কেটে যায়। বাড়িতে তো আমি আর মা দুটো প্রাণী মাত্র।
আরও পড়ুন গল্প পাথরে শৈবাল খেলে
এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসলাম। নোড়ার কথা সব সময় এমনিতেই খুব বেশি মনে পড়ে, ভুল করেও মনে পড়ে, বৃষ্টি ভেজা সকালে, কিংবা গোধূলি রাঙা সন্ধ্যা বেলায়ও মনে পড়ে।
তারপর আপনা আপনি দুচোখে বৃষ্টি নামে।হৃদয়ে এক বিশাল শূন্যতার খাদ।বুকের গভীরের বড় দীর্ঘশ্বাস দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে যাই।
নোড়ার পছন্দ বসন্তের দিন আর আমার বৃষ্টিভেজা শ্রাবণ, বর্ষা ঋতু।
গাছের পুরোনো পাতা ঝড়ে পড়ে নতুন পাতা গজায়। ফাল্গুনের দখিনা হাওয়ার দোলায় দোলে নতুন কচিকাচা পাতারা। খেলা করে। তাদের খেলার সঙ্গী হয় সোনালী রোদ। ঝিকিমিকি ছন্দ তুলে কচি পাতাগুলো মনের আনন্দে নেচে ওঠে। যেদিকেই তাকাও, যতোদূর চোখ যায়, চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুলের সমারোহ। শিমুল পলাশের বনে যেন ফাগুন ঝড়া আগুন। সেই আনন্দে মনের সুখে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যায় ভ্রমর। ভ্রমরের সাথে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে মৌমাছির দল। সমস্ত ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, জমা করে বিশাল মৌচাকে। ভ্রমরকে দেখিয়ে দেয় যে সবার চেয়ে তারাই সেরা।
আহা! এমন প্রশান্তমনা দিনে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতেও কি শান্তি। এমন একটা সুন্দর ঋতু রেখে তোমার কেন যে বর্ষা পছন্দ তাই বুঝি না। বৃষ্টি ভালো লাগে কিন্তু অতিবৃষ্টি নয়। ঘরের বাইরে যাওয়া যায় না। লোকজনেরও যাতায়াত-কাজকর্মে কতো অসুবিধা হয়।
সারারাত বৃষ্টি হবে, ভোরে বৃষ্টি থেমে যাবে। শুভ্র নীল আকাশে উকি দিয়ে আসবে সকালের সোনা রোদ। ঝিকিমিকি করবে সদ্য স্নান করা গাছের সবুজ পাতাগুলো। আমার এমন একটা মিষ্টি স্নিগ্ধ সকাল দেখতেই ভালো লাগে।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন জল
পাশাপাশি হাটতে হাটতে ওর কথা শুনে আমি হাসছিলাম। এমন সময় কোকিল ডেকে উঠলো। নোড়া দুষ্টুমি করলো কোকিলের সাথে।
──এই অমিত, শোন কোকিল ডাকছে। জানো, কোকিলের সাথে সাথে ওর ডাক অনুকরণ করলে ও রেগে গিয়ে আরো জোরে জোরে আর ঘন ঘন ডাকে, দেখবে?
নোড়া আর কোকিলের খুনসুটি দেখছি। কোকিল কু-উ-উ করে ডাকছে, নোড়াও ওর সাথে ওভাবেই কু-উ-উ করে ডাকছে। অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যি, নোড়া ওর অনুকরণ করছিলো বলে, একটা সময় জোরে জোরে আর ঘন ঘন ডেকে নোড়াকে যেন হারিয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেল। আর কোকিলকে রাগিয়ে দিয়ে নোড়া হেরে গিয়েও হাসতে লাগলো। ওর সেই হাসিতে যেন অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়ানো ছিলো।
নোড়া ম্যাথ নিয়ে পড়ছিলো আর আমি ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করছিলাম। অবশ্য আমি ওর থেকে এক ইয়ার সিনিয়র। ঢাকা ভার্সিটির এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর কবিতা আবৃত্তি আমাকে এক মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে রেখেছিলো। অনুষ্ঠান শেষে একগুচ্ছ রজনী গন্ধা দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম,
──কবিতা তো নয়, যেন শ্রাবণ ধারায় বৃষ্টি ঝড়লো।
নোড়া লাজুক হেসে বলেছিল,
──আপনার বুঝি বৃষ্টি খুব পছন্দ?
সেই থেকেই পরিচয়। তারপর অনেক দিন টি এস সি চত্বরে আড্ডায় মেতেছি। পাশাপাশি হেটেছি বহুদূর নির্জন পথ ধরে। কথার ছন্দে বাধনে বাধা পরতে পরতে ভালো লাগতে শুরু করলো দুজন দুজনকে। আমি মটকা চা নিলে, ও নিতো তেতুল চা। ওর পছন্দের তেতুল চা খেয়ে দেখলাম, আসলেই তো ভালো লাগে। এমনি করেই একদিন ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা হয়ে গেল। ওর প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র। আর আমার রবী ঠাকুর ও হুমায়ুন আহমেদ। কিন্তু একটা ব্যাপার দুজনই ভীষণ পছন্দ করতাম। সেটা হলো, শরৎ কালে নীল আকাশের বুকে ভেসে ভেসে যখন সাদা মেঘের তুলো উড়ে যায়, তখন সেটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।
দুজনের পছন্দে অপছন্দে মিল অমিল থাকলেও, দুজনেরই ভবিষ্যৎ সংসারের স্বপ্নটা ছিল এক।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন গোধূলি
লেখাপড়া শেষ করে, দুজনই চাকরিতে যোগদান করলাম। ও কলেজে আর আমি ব্যাংকে। এবার আমাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পালা। কিন্তু স্বপ্নের অনেক কাছে গিয়েও ভাগ্যের পরিহাসে ফিরে আসতে হয়েছে। আমার বাবা সেদিন, এতোটা কঠিন না হলেও পারতেন। বাবা রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ। রক্ষণশীলতা খারাপ নয়, তবে রক্ষণশীলতার নামে অতিরিক্ত কঠোর নিয়ম চাপিয়ে দেয়া, কারো কারো জীবনে দূর্বিসহ অভিশাপ ডেকে আনে।
বুকের গভীর থেকে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস উঠে এলো অমিতের।
আরও পড়ুন সাদা মেঘের তুলো গল্পের-
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সাদা মেঘের তুলো (১ম পর্ব)