সাদা-মেঘের-তুলো-শেষ-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

সাদা মেঘের তুলো (শেষ পর্ব)

সাদা মেঘের তুলো (শেষ পর্ব)

শাহানাজ মিজান

 

বন্ধু জামানের কাছে শুনেছিলাম নোড়া বিয়ে করেছে। একটা চিরকুটও পাঠিয়েছিলো, তাতেও বিয়ের কথাটাই লেখা আছে। আচ্ছা, নোড়া কি খুব সুখে আছে? ওর বর নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে ওকে। এতোদিনে হয়তো ওর বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে।
যাবো যাবো করতে করতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। একদিন সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে, একবার শুধু চোখের দেখা দেখবো বলে, ওদের বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু দেখা হলো না। ওরা সে বাসা ছেড়ে দিয়েছে কিছুদিন আগেই।
আচ্ছা, আমার কথা কি ওর একবারের জন্যেও মনে পরে না? আমি তো ঠিকানা বদলাইনি, যদি ভুল করেও একবার আসতো! বদলাইনি ফোন নম্বর, প্রতিক্ষায় থাকি, যদি সেই পরিচিত নাম্বার থেকে একবার ফোন আসে! আমি তো নিজেও বদলাইনি, ওর সাথে কি এই জীবনে আর কখনো দেখা হবেনা আমার?

আরও পড়ুন গল্প মরিচপোড়া

ফাল্গুনের মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া কিংবা ছুটির দিনের বৃষ্টি ভেজা সকাল উপভোগ করতে, কী বই কিনবো তা নিয়ে ভাবছিলাম। অনেক নতুন লেখকের বই প্রকাশ হয়েছে , যাদের নাম খুব বেশি ছড়ায়নি, কিন্তু খুব ভালো লেখেন তারা। বাংলাদেশের মতো ছোট একটা দেশ হিসেবে এখানে কবি লেখকের সংখ্যা অনেক বেশি। আফসোস হয় তাদের জন্যে, একজন লেখক লিখতে যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন, সেই পরিমাণ মূল্যায়ন করা হয় না তাদের। আজকাল বই পড়ুয়াদের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। সবাই স্মার্ট ফোনের পেছনে সময় নষ্ট করে, অথচ একটা ভালো বই কিনে পড়ে না। নোড়া ঠিকই বলতো,

আমরা বাঙালিরা জ্ঞানী-গুণীদের কদর করতে জানি না, মূল্যায়ন করতেও জানি না। এমনকি একজন মানুষকে মানুষ হিসেব নূন্যতম প্রাপ্য সম্মানটুকুও দিতে জানি না। নিজে কিছু জানি বা না জানি, কিছু করতে পারি বা না পারি, নিজেকে সব সময় বড় মনে করি। কিন্তু অন্যের গুণ বা ভালোটাকে স্বীকার করতেও জানি না, স্বীকৃতি দিতেও জানি না। কারো প্রতি সামান্য প্রশংসামূলক কথা বলতেও কুণ্ঠাবোধ করি। আসলে আমাদের মানসিকতাই এমন। শুধু একজন লেখক নন, যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষেরই সামান্যতম গুণ বা ভালো কাজের স্বীকৃতি দিলে সে আরো বেশি ভালো কাজ করার উৎসাহ পায়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্ররেণা পায়। অথচ আমরা কি করি, একজন মানুষ যখন সামনে এগোতে যায়, তখন তার সম্বন্ধে বাজে সমালোচনা করে তার মনটাকে ভেঙে দিই, তার পা পেছন থেকে টেনে ধরি। তার সামান্যতম দোষটাকে অনেক বড় করে প্রচার করি। এই নীচু মানসিকতা থেকে বের হয়ে, আমরা কবে যে সত্যিকারের মানুষ হবো, আল্লাহই জানেন।

বইমেলায়, সন্ধ্যার দিকে প্রচণ্ড ভীড় ঠেলে এলোমেলো পায়ে বইমেলা প্রাঙ্গনে হাঁটছিলাম। পা দুটো ঠিক কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে আমার, জানি না । হঠাৎ চোখ আটকে গেল সুন্দর একটা বইয়ের প্রচ্ছদে। ভীড়ের মাঝে বইটা নিতে হাত বাড়াতেই, পছন্দের বইটার উপর আচমকা এসে পড়লো আরো একটি হাত।
আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম, সেও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হাজার জনমের চেনা এই হাত, এই চোখ, এই মুখ।
ভুল বা স্বপ্ন নয়, বাস্তব জগতেই বিচরণ করছি, এতো সত্যিই নোড়া!
একটু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম নোড়ার দিকে। এক মূহুর্তে মনে পড়ে গেল ফেলে আসা নানা রঙের দিনগুলো।

আরও পড়ুন গল্প শিকড়ের সন্ধানে

বিয়ের আসরে, আমার আর নোড়ার বাবার মধ্যে দেনমোহরের পরিমাণ নিয়ে ঝামেলা শুরু হলো। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আমার বাবা বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে, বর যাত্রী নিয়ে ফিরে এলেন। সেদিন বর কনের বেশে থাকা আমরা দুজন, আমাদের বাবাদের কথার উপরে কোনো কথা বলতে পারিনি। তাদের বোঝাতে পারিনি কিছুই। শুধু ফিরে আসার সময় দেখেছিলাম নোড়ার ছলছল চোখের মায়াবী চাহনি। সেই মূহুর্তে সবকিছু পিছে ফেলে ছুটে যেতে পারিনি ওর কাছে।

তারপর কেটে গেছে ছয়টি বছর!

সেদিন একমাত্র মেয়ের বিয়েটা ওভাবে ভেঙ্গে যাওয়ায়, নোড়ার বাবা হার্ট এ‍্যাটাকে মারা গেলেন, বিয়ের আসরেই, যা অমিত কখনো জানতেও পারেনি।

অমিত আর নোড়া, বইটা নিয়ে মেলার পাশের লেকটার কাছে বসলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নোড়া বললো,
──এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরও কেন জানি না, তোমার প্রতীক্ষায় অপেক্ষার প্রহর গুণতাম প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত অসহায় চাতকের ন‍্যায় তৃষ্ণার্ত চোখে পথের দিকে চেয়ে থাকতাম, মনে হতো এই বুঝি তুমি এলে। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে, প্রতিক্ষীত চোখ উপেক্ষিত হয়ে ফিরে এসেছে বার বার। প্রতিদিন তোমার প্রিয় বৃষ্টির মতো অঝোর ধারা বয়ে গেছে এই দুটি চোখে, তুমি আসোনি।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

বেশ কিছুদিন পরে, একদিন তোমার বন্ধু জামান ভাই এসে তোমার লেখা একটা ছোট্ট চিরকুট দিয়ে গেল। তাতে লেখা ছিলো-তুমি বিয়ে করেছ, আমি যেন তোমায় ভুলে যাই।
সদ্য বাবাকে হারিয়েছি, সমাজের লোক থেকে শুরু করে, আত্মীয় স্বজনদেরও কটু কথা থেকে রেহাই পাইনি। তারপর তোমার পাঠানো এই চিরকুট বুকের ভেতরে বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধেছিলো। প্রচণ্ড ঝড়ে উপরে পরা গাছের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিলাম আমি। মায়ের কষ্টটাই বেশি ছিলো। আমার মা আহত পাখির মতো গুমরে গুমরে কেঁদেছেন, তবুও তার ডানা দিয়ে, আগলে রেখেছিলেন আমায়। নিজে সবকিছু হারিয়েও আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শক্ত খুটির মতো। তবুও তাতে ভর করে উঠে দাড়াতে কেটে গেছে বহু সময়। মা অনেক বার বলেছেন, এখনো বলেন, জীবনটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে কিন্তু নতুন ভাবনায়ও শুধু তুমিই ছিলে, তুমিই আছো। আর কাউকে ভাবতে পারলাম না, পারিনি আজও।
তবুও বাসা বদলে নিলাম। বদলে নিলাম কলেজ, ফোন নম্বর সবকিছুই। যেন ভুল করেও ভুল না হয়ে যায়। তোমার নতুন জীবনের প্রতি, দূর থেকেই শুভকামনা জানিয়েছি। পুরোনো নাম্বারে মনের অজান্তেই ফোন চলে গিয়ে যেন তোমাদের বিব্রত না করি। তোমাদের সুখের সংসারে বিঘ্ন না ঘটাই।
──(জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে) মাকে নিয়ে অন্য একটি বাসা ভাড়া নিয়ে নিলাম, এখনো সেখানেই থাকি। তবে যেখানেই থাকি না কেন, বিশ্বাস করো, যতই তোমাকে ভুলতে চেয়েছি, ততই বেশি বেশি মনে পড়েছে। সবকিছু বদলে নিলেও নিজেকে বদলাতে পারলাম না। মাঝে কতগুলো বছর চলে গেল। পুরোনো এলোমেলো স্মৃতির সাথে যোগ হলো বেদনার পথচলা। জীবন থেকে চলে গেল কতকিছু, অথচ ভুল করেও তোমাকে ভোলা গেল না। তুমি তো জানো অমিত, আমি অংকের প্রফেসর অথচ জীবনের অংকের হিসেব মেলাতে পারলাম না কিছুতেই। এই জীবনের সাদা খাতায়, কি যোগ করবো আর কি বিয়োগ করবো, গুন-ভাগের হিসেবে কতো লিখবো, না লিখবো বুঝতে পারিনি। বার বার মনে হয়, জীবন থেকে সব কাটতে কাটতে জীবনটাই যেন একটা রাফখাতা হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন অন্তর্জাল ও মৃত্যু

ওয়ালেট থেকে অমিতও একটি ছোট্ট চিরকুট বের করলো। মিলিয়ে দেখলো, দুটো চিরকুটে একই কথা লেখা এবং হাতের লেখাটাও এক। দুজন দুজনের দিকে তাকালো, কারো কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।

দুজনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।

তারপর অমিত দুটো চিরকুট ছিড়ে লেকের পানিতে ফেলে দিয়ে বললো,
──নোড়া চলো যাই, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। চলো এখনই যাই….
──আমি…! আমি কোথায় যাব? তাছাড়া তুমি বইমেলায় এসেছ, আর কিছু বই না নিয়েই চলে যাবে?
──হুম, কারো জীবনের গল্প বা উপন‍্যাস আর পড়বো না। কিংবা পরে পড়বো। এখন চলো যাওয়ার সময় একটা নতুন সাদা খাতা কিনে নিয়ে যাবো। সেই খাতায় আজ থেকে আমরা আমাদের জীবনের নতুন গল্প লিখবো দুজন মিলে। সেই গল্প সবাইকে শোনাতে আবার একদিন এই বই মেলায় আসব, সাথে হানিমুনটাও এখানেই হয়ে যাবে, কি বলো দারুণ হবে না!
নোড়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমি নোড়ার হাত ধরে আবার বললাম,
──জীবনের রাফখাতা ছিড়ে ফেলে দিলাম। এখন থেকে আমি হিসেব করবো আর তুমি সেই অংক লিখে রাখবে, ভুল হবে না আর কোনোকিছুতেই।
এখন আমরা সোজা যাবো কাজী অফিসে। আজ আর প্রয়োজন নেই কোনো লাল বেনারসি বা সেরোয়ানীর সাজের। প্রয়োজন নেই নোলক কিংবা টিকলির। তোমার আমার পরনে যা আছে তাই যথেষ্ট। লম্বা চুলের বেনী আর এই গোলাপী শাড়ীতেই দারুণ লাগছে তোমাকে। আমি তো সাদা পাঞ্জাবী পরেই আছি। বর-বউ হিসেবে মন্দ নয়, কি বলো? কাজী অফিস থেকে বের হয়ে, একটা হুডখোলা রিকশায় করে সারারাত ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো আর দুজনে ফাল্গুনের মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করবো। তারপর ভোরের আকাশে আমাদের জীবনের নতুন সূর্যোদয় দেখবো।
ওহ! যাওয়ার সময় ফুলের দোকান থেকে কিছু বেলী ফুলের মালা নিব আর নিব তোমার প্রিয় কাঠগোলাপ।

নোড়া বিস্ময়ে ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, ঠোঁটের কোনো এক চিলতে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। তারপরও আমার হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরলো।

আরও পড়ুন সাদা মেঘের তুলো গল্পের-
১ম পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সাদা মেঘের তুলো (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!