সাতচল্লিশ-থেকে-একাত্তর-৩য়-পর্ব
প্রবন্ধ,  সাহিত্য

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৩য় পর্ব)

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৩য় পর্ব)

সৈকত আরেফিন

 

১৯৪২ সালে সওগাত পত্রিকায় ‘আয়েশা’ নামের একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে রশীদ করিমের আবির্ভাব হলেও তাঁর লেখকসত্তার স্ফূরণ ঘটে মূলত ষাটের দশকে। প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ (১৯৬১)-ভাষাগত বৈদগ্ধ, শাণিত বিশ্লেষণপ্রবণতা, আঙ্গিকশৈলী বিচারে সমকালীন অন্য কথাকারদের থেকে রশীদ করিমকে আলাদা করে দেয়। আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণধর্মী উপন্যাসে ‘এক বিরাট রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে আসা যে মধ্যবিত্ত এখনো স্থিত হয়নি, যার পশ্চাদভূমিতে আছে কলকাতা থেকে উৎসদেশের বেদনা নতুন সমাজের অশ্চিয়তা ও সংশয়, সর্বোপরি রাজনৈতিক মতাদর্শ প্ররোচিত আবহমান ইতিহাস ও সংস্কৃতির খণ্ডিত বিচারের দায় যে মধ্যবিত্তকে উচ্চকিত রেখেছে, তারাই এ উপন্যাসের অভিনিবেশকেন্দ্র। প্রথম উপন্যাসের বর্ণনা-পরম্পরায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস প্রসন্ন পাষাণ (১৯৬৩) বিভাগ-পূর্ব সময়ে বাঙালি মুসলমানের জীবনচিত্র।

এটা বলা যায় যে, ‘প্রসন্ন পাষাণের মনস্তত্ত্ব বেশ জটিল, অনিকেত-সংশয়গ্রস্ত-দ্বিধান্বিত ও স্ববিরোধী […] উপন্যাসের গুরুত্ব অনেকটা আঙ্গিকের গুণে। খুব সচেতন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখক চরিত্রের ভেতর-বাহিরের রূপকে, সংস্কার মনস্তত্ত্বের সরল-জটিল কিংবা নিন্দা-প্রশংসার রেখাচিত্র বর্ণনার প্রয়াস’ পান। আমার যত গ্লানি (১৯৭৩)-তে উপন্যাসের নায়ক এরফান উপন্যাসের দুজন প্রধান নারী চরিত্রের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক তৈরির তীব্র বাসনা নিয়ে বলা যায় উপন্যাসটিকেই আচ্ছন্ন করে দেয়। তাঁর প্রেম একটি লাল গোলাপ (১৯৭৮) উপন্যাসে শরীরসর্বস্বতা আরও প্রকট। একটি ত্রিভূজ প্রেমের কাহিনি অবশেষে একটি সরলরেখায় পরিণত হয়। রশীদ করিমের অন্য উপন্যাস যেমন—সাধারণ লোকের কাহিনী (১৯৮১), একালের রূপকথা (১৯৮১), শ্যামা (১৯৮৪), বড়ই নিঃসঙ্গ (১৯৮৫) ও মায়ের কাছে যাচ্ছি (১৯৮৯) প্রভৃতি। আবু ইসহাক অতিপ্রজ লেখক নন।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ সমকালীন ভাবনা

কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান তিনটিমাত্র উপন্যাস (সূর্য-দীঘল বাড়ী-১৯৫৫, পদ্মার পলিদ্বীপ-১৯৮৬, জাল) ও দুটি গল্পগ্রন্থ (হারেম ১৯৬২, মহাপতঙ্গ-১৯৬৩)। এসব সৃজনকর্মে তিনি পূর্বজ কথাকারদের, বিশেষ করে শওকত ওসমান কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মতো উপন্যাস নিয়ে অনুসন্ধিৎসা ও অন্বেষার পথে না হেঁটে প্রথানুগত অথচ নিবিড়ভাবে আঁকেন বাংলাদেশের তমসাবৃত ও সংস্কারচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবনকে। ‘অস্তিত্বের মৌল দাবি মেটাতে মন্বন্তরের সময় যে জনস্রােত চিরপরিচিত গ্রামকে পেছনে ফেলে শহরমুখী হয়েছিলো, নগরজীবনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতায় রক্তাক্ত, বিপন্ন, নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে তাদের পুনরায় গ্রামে প্রত্যাবর্তনের পটভূমিকায় সূর্য-দীঘল বাড়ী উপন্যাসের সূচনা।’ দীর্ঘ বিরতিতে লেখা পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসেও তিনি পদ্মা-তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষের জীবনের অন্তর্গূঢ় বেদনাকে তুলে ধরেন।

দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় সমাজজীবনে পালাবদল সূচিত হলেও শামসুদ্দীন আবুল কালাম বিবর্তনকে আত্মস্থ করেননি, এমনকি, তাঁর সমকালে ‘শওকত ওসমান কিংবা আবু ইসহাক সচেতনভাবে গ্রহণ ও বর্জনের যে কাজ করেন আবুল কালামের রচনায় তার চিহ্নমাত্র নেই। রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো সমকালীন উপাদানগুলি বর্জন করেও আবু ইসহাক বা শওকত ওসমান বিষয়ের দিক থেকে যে জরুরি প্রাসঙ্গিকতায় তাঁদের রচনাকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম সেদিকে যান না।’ তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত কাশবনের কন্যা (১৯৫৪)-তেও শুধু একটি শ্লথ কাহিনি থাকে মাত্র, বাস্তবজীবনের রেখাচিত্র তাতে নেই। এমনকি যে গ্রামকে উপজীব্য করে কাহিনি এগোয় সে গ্রামও বাস্তবে গড়হাজির। ফলত, শামসুদ্দীন আবুল কালামের অপরাপর উপন্যাস (আলমনগরের উপকথা-১৯৫৪, কাঞ্চনমালা-১৯৬১, জায়জঙ্গল-১৯৭৮, কাঞ্চনগ্রাম-১৯৯৮ প্রভৃতি) ও গল্পগ্রন্থ (অনেক দিনের আশা-১৯৫২, ঢেউ-১৯৫৩, পথ জানা নাই-১৯৫৩, দুই হৃদয়ের তীর-১৯৫৫, শাহের বানু-১৯৫৭, পুঁই ডালিমের কাব্য-১৯৮৭ প্রভৃতি) শেষপর্যন্ত রোমান্টিক ভাবালুতায় পর্যবসিত।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ বইমেলা ও সরদার জয়েনউদদীন

ঐতিহ্যের দিক থেকে তো বটেই লেখকসত্তার দিক থেকেও শহীদুল্লা কায়সার শেষাবধি পাঁচের দশকেই থেকে যান। তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহের মধ্যে সারেং বৌ (১৯৬২) ও সংসপ্তক (১৯৬৫)-এ লেখকসত্তার যে পরিচয় ফুটে ওঠে তাতে গ্রামজীবনের ছান্দসিকতার অন্তর্লীনে সামাজিক গড়নবিন্যাসের ভাঙাগড়া টের পাওয়া যায়। শহীদুল্লা কায়সার এমন দুর্লভ আন্তরিকতা নিয়ে সারেং বৌ লেখেন যে, গরিব শ্রমজীবী মানুষের তিক্ত সংগ্রাম, সুতীব্র আকাক্সক্ষা আর রঙিন স্বপ্ন শরীরী বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়। সংসপ্তক্ল-এ তিনি আরো বড় পরিধিতে স্থিতস্বার্থের বিরুদ্ধে গরিব মানুষেদের জড়ো করেন বটে কিন্তু সীমিত পরিসরে সারেং বৌ-তে যে শৈল্পিক সিদ্ধি এসেছিল, সংসপ্তক-এ তা ব্যাহত হলো।

বিভাগ-পরবর্তী নয় বছরের কালখণ্ডের পটভূমিকায় আনোয়ার পাশার প্রথম উপন্যাস নীড় সন্ধানী (১৯৬৮)-তে ভারতীয় উপমহাদেশের আর্থ-সমাজ বাস্তবতা ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রদায়-মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে এর চরিত্র হাসানের মধ্য দিয়ে। হাসানকে বলা যায় ঔপন্যাসিক আনোয়ার পাশার শিল্পদৃষ্টির মানসপ্রতিমা। আনোয়ার পাশাই যেন হাসানের ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) উপন্যাসেও সুদীপ্ত শাহীনের চিন্তনপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ঔপন্যাসিক মূলত নিজের দর্শনই প্রকাশ করেন। প্রথম উপন্যাস নীড় সন্ধানীর মতো নিষুতি রাতের গাথা (১৯৬৮) উপন্যাসও গড়ে ওঠে সম্প্রদায়গত বিভাজনে মানবিকতাবোধ উপেক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। রাইফেল রোটি আরওরাত প্রতীকী অর্থে “রাইফেল’ আগ্নেয়াস্ত্রের দম্ভ, ‘রোটি’ অর্থনৈতিক ক্ষুধা আর ‘আওরাত’ ওদের রুচিবোধ। অর্থাৎ অস্ত্রের দম্ভে, আর্থনীতিক বঞ্চনায় শুভশক্তিকে পরাস্ত করতে চাওয়া।” মূলত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ধর্মের নামে মানবতাকে পদলেহন করার দলিল এ উপন্যাস। নিরূপায় হরিণী (১৯৭০) নামে আনোয়ার পাশার একমাত্র গল্পসংকলনে সমস্যাপ্রধান ও নিরীক্ষাপ্রবণ গদ্যভাষায় আনোয়ার পাশা সমাজ-রাষ্ট্রের ক্ষতকে শৈল্পিক রূপ দেন।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ কামাল লোহানীর বিপ্লবমন্ত্রের প্রথম পাঠ

অল্প বয়সেই কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬১)-এর মতো উপন্যাস লিখে তাঁর সাহিত্যিক-ঋদ্ধিকে যে উচ্চতায় স্থাপন করেন, পরবর্তী উপন্যাসসমূহে সে উচ্চতাকে আরও বাড়িয়ে নিতে কোনো প্রয়াসই তিনি নেন না বলা যায়। বরং একধরনের পুরনো আয়েসী রচনায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। কর্ণফুলি (১৯৬২) কিংবা ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪)-য় তিনি সমগ্রতাকে লক্ষ্য করেন বটে, কিন্তু এখানে প্রথমত, সমাজপরিপ্রেক্ষিতের গড়নবিন্যাসে নিভৃত ভাঙাগড়ার অভিমুখ শেষপর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়, দ্বিতীয়ত, চরিত্ররা যান্ত্রিক, মানুষের চলিষ্ণুতা তাদের নেই, সপ্রতিভ আকাক্সক্ষাও নেই। তবে উপন্যাসের চেয়ে তাঁর গল্পে সমাজজীবন ও শ্রেণিচেতনা একটি লক্ষযোগ্য বিষয় হয়ে ওঠে। লোকজীবনে গভীরে ব্যাপ্ত ধর্মান্ধতা ও সংস্কার পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশে আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প যথার্থ-অর্থে শিল্প হয়ে ওঠে। জেগে আছি (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১), মৃগনাভি (১৯৫৩) ও অন্ধকার সিঁড়ি (১৯৫৮) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থে আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পঋদ্ধি স্বীকৃত।

কথাশিল্পী আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, তাঁর রোমান্টিক জীবনবোধ ঈষৎ মার্কসীয় শ্রেণিচেতনাকে উস্কে দিয়েও শেষপর্যন্ত বিদ্যমান বাস্তবতাকে প্রায়ই এড়িয়ে যায় এবং সময় ও ভৌগোলিক বিস্তারকে অস্বীকার করে। যদিও কথাসাহিত্য ছেড়ে কলামিস্ট বনে যাওয়া আবদুল গাফফার চৌধুরী একজন অল্পপ্রজ লেখক। চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৫২) ছাড়া তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আছে নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪) ও শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭)। গল্পের ক্ষেত্রে আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘জীবনের যে সন্ধান করেছেন তাতে প্রাপ্তির চেয়ে তাঁর অনুসন্ধানের নেশাটাই বড়ো। আর এই দৃষ্টিতে ব্যক্তিই তাঁর গল্পে বড়ো হয়ে উঠেছে, সমাজের সামষ্টিক বিষয় নিয়ে তাঁর তত মাথাব্যথা নেই।’  তাঁর তিনটি গল্পের বই কৃষ্ণপক্ষ (১৩৬৬), স¤্রাটের ছবি (১৯৫৯) ও সুন্দর হে সুন্দর (১৩৬৭)।

আরও পড়ুন প্রবন্ধ গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার

কথাশিল্পী হিসেবে জহির রায়হানের আবির্ভাবও বিভাগোত্তর কালেই। ছাত্রজীবনেই লেখালেখি শুরু করে পরে তিনি মূলত চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠেন। এটা লক্ষ্যণীয় যে, তাঁর কথাসাহিত্যে চিত্রনাট্যের পরিভাষার প্রয়োগ দেখা যায়, তা জহির রায়হানের চলচ্চিত্র-সত্তার ফল। তাঁর আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯) উপন্যাস কিংবা ‘সময়ের প্রয়োজনে’র মতো চলচ্চিত্রানুগ গল্প আঙ্গিক পরিচর্যার দিক থেকে জহির রায়হানকে সমকালের অপরাপর কথাকারদের থেকে পৃথক করে দেয়। হাজার বছর ধরে বয়ে চলা পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র্য, ঈর্ষা, কলহই কেবল নয়, ভালোবাসারও সরল যে ছবি ফুটিয়ে তোলেন কথাকার জহির রায়হান, তার গদ্যভাষাও ঈর্ষণীয়। উপন্যাসের মতো তাঁর ছোটগল্পও নিরাবেগ নয়। একটিমাত্র গল্পের বই সূর্যগ্রহণ (১৩৬২)-তে বিষয়ের জটিলতাকে জহির রায়হান ভাষার প্রাঞ্জলতা দিয়ে অতিক্রম করেন।

আরও পড়ুন সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর: বাংলাদেশের কথাসাহিত্য-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

সৈকত আরেফিন একজন গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: পাতা ও পতত্রি, মৃদু ব্যথা হতে পারে; প্রবন্ধগ্রন্থ: সমাপ্তি-শাস্তি-অতিথি, সাহিত্য পাঠ ও পর্যেষণ। তিনি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহাম্মদপুর ইউনিয়নের আহম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!