সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (শেষ পর্ব)
সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (শেষ পর্ব)
জনবহুল এই ঢাকা শহরটিতে নিতাইয়ের আসা হয় বছরে কদাচিৎ। দূষিত বায়ু কিংবা পিঁপড়ার মতো ভিড় সমৃদ্ধ এই শহরটিতে দু’একবেলা যাপন করতেই হাঁপিয়ে ওঠে। মনটি তার ছটফট করতে থাকে কখন তিনি ফিরে যাবে গ্রামে। অনেক গলিঘুঁজি হাতড়ে পূর্ব শাহজাহানপুরে তেষট্টি নম্বর বাড়িটি অবশেষে খুঁজে পেল নিতাই। কড়া নাড়তেই পাতলা ছিপছিপে গড়নের মাঝ বয়সী একজন লোক দরজা খুলে নিতাইকে জিজ্ঞেস করল-
-কাকে চাই?
-স্যার কি আছেন নাহি ভিতরে?
-আপনি কি আবু শামস স্যারের কাছে এসেছেন?
-জী, উনাক কন, পাবনার গোলাম রসুল সাহেব আমাক পাঠায়ছেন। একটা জরুরী বিষয়ে উনার সাতে কতা কইবের চাই।
লোকটি দরজাটা হাট করে খোলা রেখে চলে গেল ভেতরে। আচরণে মনে হলো চুরি হওয়ার মতো কোনো ধন সম্পত্তি নেই এ বাড়িতে। মিনিট পাঁচেক পর লোকটি ফিরে এলো হন্তদন্ত হয়ে।
-আসেন, ভেতরে আসেন। লোকটি কথাগুলো বলল বেশ সন্তুষ্টচিত্তে।
দু’তিনটি কক্ষ ডিঙ্গিয়ে নিতাইকে নিয়ে সে হাজির হলো একেবারে আবু শামস নামক মানুষটির খাস কামরায়। কামরাটির এদিক-ওদিক রাশি রাশি বইয়ের অবিন্যস্ত স্তূপ। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু আলমারিগুলোও রাজ্যের নানা বইয়ে ভর্তি। রুমটির এক পাশে একটি টেবিল, সেটির উপরেও পাঁজা পাঁজা বই স্তূপ করে রাখা। আর আছে একটি অনেক দিনের পুরনো ইলেকট্রিক ল্যাম্প। সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলি পাঁকিয়ে উপরের দিকে উঠছে বলে বোঝা গেল, টেবিলের ওপাশে কেউ একজন রয়েছে বটে। কিন্তু টেবিলের ওপর সারি সারি বইগুলোর জন্য তার চেহারাটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না সহজেই।
নিতাই তার পায়ের আঙ্গুলগুলোর ওপর শরীরের সমস্ত ভার অর্পণ করে ঈষৎ মাথাটি উঁদ বিড়ালের মত উঁচু করে চেয়ারে উপবিষ্ট মানুষটিকে একবার দেখার চেষ্টা করল। নিতাই দেখতে পেল শারীরিক বৈশিষ্ট্যে খর্বকায় একজন মানুষ চেয়ারে বসে সিগারেট টানছেন আর নিবিষ্ট মনে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন। লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই নিতাই গলা খাঁকারি দিল একবার। লোকটি এবার তার দিকে দিকপাত করলেন। ওহ, আপনি তাহলে এসেছেন পাবনা থেকে। নিতাই মাথা নেড়ে বলল, জী। সঙ্গে গোলাম রসূলের চিরকুটটিও তুলে দিলেন অধ্যাপক আবু শামসের হাতে।
আরও পড়ুন একজন অনন্যা
চিঠিটিতে কিছুক্ষণ নিৰ্ণিমেষ চোখ বুলিয়ে ড. আবু শামস, বললেন “কই দেখি সোনার মোহরটি”। নিতাই একটি সাদা রুমালের ভেতর থেকে স্বযত্নে মুদ্রাটি বের করে আবু শামসের হাতে তুলে দিল একটু সাবধানতার সঙ্গে। আবু শামস চোখ দিয়ে ইশারা করলেন, নিতাইকে টেবিলের সামনের সোফাটিতে গিয়ে বসতে। আবু শামস একটি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মোহরটিকে উল্টে পাল্টে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন একজন বিচক্ষণ জহুরীর মতো। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, একটু পর পর সিগারেটে টান দিচ্ছেন আর একজন পাকা স্যাঁকড়া যেভাবে কষ্টিপাথর ঘষে অখ্যাত কোনো বস্তুর ভেতর হতে সোনা বের করে আনে ঠিক সেরকম চেষ্টাই যেন করে যাচ্ছেন তিনি। তার এই নিবিড় অণুবীক্ষণ চলল প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে। মাঝেমধ্যে মই বেয়ে বইয়ের আলমারি থেকে কোনো একটি বই বের করে কি যেন মিলিয়ে নিচ্ছেন আর মাঝেমধ্যেই তার মাথাটি ঈষৎ নেড়ে বিড়বিড় করে বলে উঠছেন- “হ্যাঁ..হ্যাঁ.. নিশ্চিতভাবে এটিই হবে”-এ জাতীয় সব উক্তি।
এবার আবু শামস বললেন- এই যে নিতাই বাবু সোফা ছেড়ে এবার এখানে এই চেয়ারটিতে এসে বসুন। মনে হয় আপনার মোহরের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। আবু শামসের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর নিতাইয়ের মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চটপট সোফা ছেড়ে চেয়ারটিতে এসে বসল সে। আবু শামস তার ভৃত্যটিকে ডেকে চা পরিবেশনের হুকুম দিয়ে পুনরায় কথাবার্তা শুরু করলেন-
“আপনার এই মোহরটি একটি সোনার মোহর এবং এটি যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলের সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। বেশ অবাক হচ্ছেন বুঝি? মেঝেতে পরে থাকা কিছু কাগজপত্র নিচু হয়ে তুলতে তুলতে কথাগুলো নিতাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন আবু শামস। অবাক হওয়ার মতই বিষয় বৈকি। আপনি হয়তো ভাবছেন প্রায় চারশত বছরের পুরোনো মুদ্রা সুজানগরের চরগোবিন্দপুর গ্রামে এলো কোথা থেকে। সেই রহস্যও ভেদ করা গেছে। তার আগে একটু চা পান করা যাক, কী বলেন? গুড়ের চা, আপনার বেশ পছন্দ হবে আশা করি। তারপর আপনাকে সব খুলে বলছি। দুটো সুদৃশ্য পেয়ালায় চা এলো যথা সময়ে। অতি সুস্বাদু চমৎকার গুড়ের চা, চুমুকেই সারাদিনের ক্লান্তিতে সতেজতা ফিরে পেল নিতাই। অপার্থিব এক প্রসন্নতায় ভরে উঠলো তার প্রাণটি।
আরও পড়ুন গল্প দীপ্তিদের দেবতা
আবু শামস পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বললেন- হ্যাঁ.. যা বলছিলাম- আপনার এই মুদ্রার রহস্যের জট খুলতে হলে আগে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ইচ্ছায় তার ছোটবেলার বন্ধু, ঘনিষ্ঠ সহচর ও প্রধান সেনাপতি ইসলাম খাঁ বাংলা ও বিহারের রাজধানী রাজমহল হতে সরিয়ে আনলেন ঢাকায়। সেটি ছিল ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ। ইসলাম খাঁ আগ্রা থেকে ঢাকা এই দীর্ঘ পথটি যতটুকু সম্ভব স্থল পথে ও বাকিটুকু যমুনা, গঙ্গা নদী হয়ে পাবনা জেলার সুজানগর অঞ্চলটির পাশ ঘেষে বয়ে চলা পদ্মা নদী হয়ে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী শহর ঢাকা এসে পৌঁছলেন। সন্দেহ নেই মোঘল সম্রাটের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও রাজ আমত্যগণও যোগাযোগের জন্য এই পথটি সর্বদা অনুসরণ করতেন।
আমার যতটুকু ইতিহাস জ্ঞান তাতে আমি বলতে পারি ইসলাম খাঁ ই প্রথম ব্যক্তি যিনি পাবনা অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে নিদারুণ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। যদিও রেকর্ডপত্র তেমন কিছু নেই। কিন্তু ধারণা করা যায় যে যাত্রাপথে প্রায়ই সুজানগর কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকার কোথাও তিনি তার তাবু ফেলে অবকাশ উপভোগ করতেন কয়েকদিন। পাবনার মধ্য দিয়ে দুলাই, চরগোবিন্দপুর ও কাশিনাথপুর হয়ে ইছামতি নামে যে নদীটি যমুনায় গিয়ে মিশেছে সেটি আসলে ইসলাম খাঁ নিজ উদ্যোগে খনন করেছিলেন। পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে সুজানগর নামক এই স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কথা গোপন ছিল না আগ্রার রাজমহলেও। মোঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ সম্রাটই প্রাকৃতিক দৃশ্য, গাছপালা, পশু-পাখি অসম্ভব পছন্দ করতেন।
একবার কাবুল থেকে একজন একটি মদনটাক ধরে আনল সম্রাট বাবরকে উপহার দেবে বলে। সম্রাট বাবর পাখিটিকে বেশ পোষও মানিয়ে ফেললেন অল্প সময়ের মধ্যে। বাবর পাখিটিকে মাংসের টুকরো ছুঁড়ে দেন আর অমনি ওটা ধরে খায়। পাখিটির ঠোট থেকে ফসকে যেত না কিছুই। পাখিটি একবার একটি আস্ত জুতো গিলে ফেলল। তারপর একদিন একটি আস্ত মূরগী গিলল- ডানা ও পালক সমেত। নিতাই আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল- আমান একটা মুরগি! এইডে কি সত্যি নাহি বানানি গল্প? আশ্চর্যিত হচ্ছো কেন নিতাই? এটা স্বয়ং সম্রাট বাবর তার বাবর নামায় লিখে গেছেন।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী নেপোলিয়ান বোনাপার্টের দেশে
শোন, তোমাকে আরেকটি গল্প শোনাচ্ছি। একবার সম্রাট জাহাঙ্গীর ইমামবর্দি অঞ্চলে শিকারে বের হয়েছেন। সেখানে তিনি একটি কোয়েল পাখি শিকার করলেন। যার এক পায়ে ছুরি-নখর আছে, অন্য পায়ে নেই। যেহেতু পুরুষদের দু’পায়েই ছুরি-নখর থাকে আর স্ত্রীর কোন পায়েই থাকে না, সম্রাটের কাছে সবাই জানতে চাইল পাখিটি পুরুষ না স্ত্রী? সাথে সাথে সম্রাট জাহাঙ্গীর বলল- ওটা স্ত্রী কোয়েল। তারা পাখির পেট কাটল এবং কয়েকটি ছোট ছোট ডিম দেখতে পেল। বিস্মিত হয়ে সবাই জিজ্ঞাসা করল- আপনি কী করে ধারণা করেছিলেন? সম্রাট জাহাঙ্গীর বলল- পুরুষের চেয়ে স্ত্রীর মাথা ও ঠোট ছোট। মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে এক সময় ধারণাটা হয়ে যায়। আর এই গল্পটি তুমি পাবে জাহাঙ্গীর নামায়।
এখন আসল কথায় আসি, মোঘল সম্রাটের সৈন্য সামন্ত ও উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিবর্গ যারা আগ্রা থেকে ঢাকায় আসা যাওয়া করতেন তারা বোধ করি সকলেই এই মনোরম স্থানটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন সেই ইসলাম খাঁর আমল থেকেই। সম্রাট জাহাঙ্গীর একজন অসামান্য সৌখিন ও শিল্পানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন ফলিত ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি অসম্ভব অনুরক্ত। তার শাসন আমলে তিনি তৈরি করেছিলেন ৪৬ রকমের মুদ্রা। ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মাথায় এক উদ্ভট খেয়ালের জন্ম হলো। তিনি তার তঙ্কশালার সমস্ত মোহর রাশিচক্রের প্রতীকগুলোর মুদ্রাঙ্কনে সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন এবং সে ইচ্ছেও তামিল হলো খুব দ্রুত। একেকটি মুদ্রায় শোভা পেল রাশিচক্রের একেকটি জাতকের চিহ্ন।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
নিতাইকে উদ্দেশ্য করে আবু শামস বললেন- আপনি যে মুদ্রাটি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন সেটি হল মিনরাশির প্রতীক যুক্ত মুদ্রা। মুদ্রাটিতে আড়াআড়ি ভাবে দুটো মাছ, মাথা দুটি দুটোর দুদিকে। এপর্যন্ত কিন্তু সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু ঝামেলাটি পাকিয়েছে অন্য জায়গায়। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তার পুত্র খুররম যিনি শাহজাহান নাম ধারণ করে সিংহাসন আলো করে অধিষ্ঠিত হলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ধার্মিক ও নির্দয়ভাবে গোঁড়া একজন শাসক। সিংহাসনে বসেই তিনি ফরমান জারি করলেন যে, মনুষ্য ও জীব-জন্তুর ছবি সম্বলিত সব মুদ্রা সংগ্রহ করে গলিয়ে নতুন করে মুদ্রা তৈরি করতে হব। যেখানে কোন মানুষ কিংবা জীব-জন্তুর ছবি থাকবে না। আর যদি কারো কাছে এরূপ ছবিযুক্ত মুদ্রা পাওয়া যায় তবে সেই ব্যক্তিটিও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। শাহজাহানের নির্দেশ অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত মুদ্রা রাজ্যের সর্বস্তর থেকে তুলে আনা হল। সেই সাথে শাহজাহানের টাকশালে আরো যেসব অসংখ্য মুদ্রা ছিল সেগুলোও সব একত্রে গলিয়ে ফেলা হল।
এসব শুনে নিতাইয়ের মুখটি একেবারে ফ্যাঁকাশে পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করল। সে মনে মনে ভাবে তাহলে তার এই মুদ্রাটি কী নকল? আবু শামস বোধহয় নিতাইয়ের মনের অবস্থাটি বুঝতে পারলেন। তিনি নিতাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন- কাহিনী তো এখনো শেষ হয়নি মশাই এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? কাহিনীটির শেষ পরিণতির আগে আরেক রাউণ্ড গুড়ের চা হয়ে যাক, কি বলেন নিতাই বাবু? সাথে খাঁটি সরিষার তেল ও চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখানি। কী আপত্তি নেই তো? নিতাই কিছুটা অসাড় কণ্ঠে বললেন- না আপত্তি থাকপি ক্যা? চা ও ঝালযুক্ত মুড়ি শেষ করে আবু শামস তার ইতিহাসধর্মী বিশ্লেষণ পুনরায় শুরু করলেন।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
নিতাই বাবু আপনি জানেন কিনা জানি না, সম্রাট শাহজাহানের ছিল তিন পুত্র- শাহজাদা দারাশুকো, শাহসুজা ও আওরঙ্গজেব। এই তিন জনের মধ্যে দারাশুকো ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী, বিদ্যান ও সংস্কৃতিমনা। তিনি সেই রাশিচক্রের প্রতীক যুক্ত কয়েক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা লুকিয়ে ফেললেন কোন এক দুর্ভেদ্য জায়গায়। ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান তার মধ্যম পুত্র শাহ সুজাকে বাংলা ও বিহারের শাসন কর্তা নিযুক্ত করে তাকে পাঠালেন ঢাকায়। ঢাকার বড় কাটরায় শাহ সুজা তৈরি করলেন তার মহল। আর সেখান থেকেই তিনি বাংলা ও বিহারের শাসনকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন। তার এই শাসন আমলে তিনি ঢাকা থেকে আগ্রা কিংবা আগ্রা থেকে ঢাকা তার এই যাতায়াতের পথ হিসাবে পদ্মা নদীটিকেই বেছে নিয়েছিলেন এবং এই সুজানগরের পাশ দিয়েই তিনি সবসময় যাতায়াত করতেন। সম্ভবত সুজানগরের ভূপ্রকৃতি তাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে তিনি প্রায়ই সেখানে তাবু ফেলে সুজানগর অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেন। সেই সময়ে এ অঞ্চলটি ছিল প্রচুর বৃক্ষ ও ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ।
তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন এসব জঙ্গল সাফ ছুতোর করে যদি বসতি স্থাপন করা যায় তবে নিশ্চই এটি মনুষ্য বসবাসের একটা আদর্শ, মনোহর ও উপযুক্ত স্থান হিসাবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু কিভাবে তিনি করবেন এই অসাধ্য সাধন। তার কোষাগারে তো পর্যাপ্ত অর্থের যোগান নেই। আগ্রায় ফিরে গিয়ে তিনি তার এই অভিপ্রায় ও মনোবাসনার কথা তার ভ্রাতা দারাকে খুলে বললেন। দারাশুকো তার সহদর সুজার মুখে এসব কথা শুনে খানিক চিন্তা করে বললেন- উপায় একটি আছে বটে। ভাইয়ের মুখে আশার বাণী শুনে সুজার চোখে মুখে আলো ফুটে উঠল। কী সেই উপায়? দারাশুকো সুজাকে বললেন তার কাছে কয়েক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে যা বেশ কিছুকাল আগে তাদের পিতা সম্রাট শাহজাহান বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। সুজা চাইলে সেই মুদ্রাগুলো ব্যবহার করতে পারে তার ভালোলাগার সেই জায়গাটির বন-জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে।
আরও পড়ুন গল্প বিষফুল
দারাশুকো ছিলেন অসামান্য বুদ্ধিমান একজন মানুষ। তিনি অল্প মুদ্রা ব্যয় করে ঢের বেশি কাজ আদায় করে নেয়ার জন্যে একটি অভিনব উপায় বের করলেন। তিনি শাহসুজাকে উপদেশ দিলেন এক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা ও সঙ্গে একটি কামান নিয়ে যেতে। মুদ্রাগুলোর জন্য কামানটি কেন প্রয়োজনীয় সে বিষয়টিও তিনি শাহ সুজাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন। সম্ভবত ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা পাইক পেয়াদা ও বরকন্দাজ সমেত আগ্রা থেকে ঢাকা ফেরার পথে বস্তা ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা, কামান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যাত্রা বিরতি করলেন সুজানগরে।
দূর-দূরান্তে লোক পাঠিয়ে খবর পৌঁছে দেওয়া হলো যে সুজানগর অঞ্চলের ঝোপঝাড় ও বনাঞ্চলগুলোতে কামান দেগে স্বর্ণমুদ্রা ছিটানো হবে। যদি কেউ সেই স্বর্ণমুদ্রা পেতে চায় তাহলে তাকে জঙ্গলের গাছপালা কেটে সেই মুদ্রা সংগ্রহ করতে হবে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এলো সেই লোভে পড়ে। তারপর কামানের নলের ভেতর স্বর্ণমুদ্রা ভরে সেটি দাগানো হলো বিভিন্ন জঙ্গল ও ঝোপঝাড় লক্ষ্য করে । অপেক্ষারত মানুষজনও দা, কুড়াল ও হাঁসুলি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল জঙ্গলের বুক চিরে সেই স্বর্ণমুদ্রা তুলে আনতে।
১৬৬০ সালে উত্তর প্রদেশের ফতেপুরে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তিনি যখন যুদ্ধে হেরে আরাকানে পলায়ন করেছিলেন তখনও তিনি সুজানগরে কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। এ এলাকার মানুষজনও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে এ অঞ্চলটি তার নামেই নামকরণ করেছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে রাস্তাঘাট, সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সম্ভবত মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে এই মুদ্রা।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী সকাল
আবু শামস নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি সেই মুদ্রাগুলোরই একটি পেয়েছেন। আপনি অনেক ভাগ্যবান। নিতাই বেশ কৌতূহলি কণ্ঠে আবু শামসকে জিজ্ঞেস করলো- আপনের মতে এইডের দাম আনুমানিক কত হইবের পারে?
আবু শামস বললেন- এটি একটি আপেক্ষিক ব্যাপার, নিতাই বাবু এটির মূল্য এক কোটি, দু’কোটিও হতে পারে কিংবা আবার পাঁচ কোটিও হতে পারে। আবু শামসের মুখ থেকে মোহরের মূল্য শুনে নিতাইয়ের সমস্ত মুখমণ্ডলটি খুশি ও আনন্দে অপূর্ব এক জ্যোতির্ময় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন তাহলে আল্লাহ, ঈশ্বর কিংবা ভগবান আগে থেকেই কি সব কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন? একদিকে তার এতগুলো টাকা ও সম্পদ বেহাত হলো অন্য দিকে সেই ঈশ্বরেরই কৃপায় তিনি পেলেন আরো ঢের বেশি। স্বর্ণমুদ্রাটি আবু শামসের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে তিনি রওনা হলেন গ্রামের উদ্দেশ্যে।
অপরাহ্নে চরগোবিন্দপুর গ্রামে পৌঁছে নিতাই যা শুনলেন সেটার জন্য বোধ করি তিনি সামান্যতমও প্রস্তুত ছিলেন না। বাড়ি পৌঁছানোর আগেই তিনি তার গ্রামের পরিচিত এক হাটুরের কাছ থেকে শুনতে পেলেন যে, গতকাল রাতে গোলাপ গলায় দড়ি নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। একটু আগেই জানাযা শেষে তাকে সমাহিত করা হয়েছে তার আদর্শ গরু খামারের একেবারে পাশ ঘেঁষেই।
কখনো আনন্দ কখনো বিষাদ, কখনো অম্ল কখনো মধুর, কখনো ক্লেশ কখনো বিনোদন, কখনো অবসাদ কখনো অবসর সম্পর্ক যুক্ত এই ধরিত্রীর মায়া ভুলে গোলাপ কেন যে এই বিশ্ব চরাচর ত্যাগ করে অন্য ভূবনে চলে গেল সেটি বুঝি একমাত্র গোলাপ ছাড়া চরগোবিন্দপুর গ্রামের আর একটি মানুষও জানতে কিংবা উপলব্ধি করতে পারলো না।
আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (শেষ পর্ব)