সম্রাট-জাহাঙ্গীরের-স্বর্ণমুদ্রা-৫ম-পর্ব
গল্প,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৫ম পর্ব)

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৫ম পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

একটু আগেও সূর্যটা ছিল মাঝ আকাশে। হঠাৎ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এসে ঢেকে দিল সেটাকে। ঠিক সেভাবে সব দুঃখ-কষ্টগুলো জমা হতে লাগল গোলাপের মনে। কী করবে সে এখন? মাথা কুণ্ডয়ন ছাড়া আর কি উপায়? এতগুলো টাকা বেহাত হয়ে গেল উপস্থিত জোচ্চুরি ও প্রতারণায়। প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকাল সে, দুই তিন হাজারের মতো টাকা ছিল পকেটে, সেগুলোরও কোনো হদিস মিলল না। শুধু সস্তা দামের মোবাইলটি খুঁজে পাওয়া গেল বাম পকেটে। গতকালই তার বউ জুলেখা ও দুই কন্যা জুঁই, চামেলীর সঙ্গে কথা হয়েছে মোবাইলে। ছোট মেয়ে চামেলী কত আহ্লাদ করে তাকে বলছিল- বাবা আমার জন্যি নতুন একখ্যান ফরগ আইনো কিন্তুক। সাতে বাসনা সাবান, শ্যাম্পু, কিরিম আরো কতডি চুলির কাঁটাও কিন্তুক লাগবি। এসব মনে হতেই গোলাপের বুকটা হু হু করে উঠল। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল জলে। কি ঘটেছিল গতকাল রাতে? তার যে একেবারে স্মৃতি লুপ্তি ঘটেছে এমন কিন্তু নয়।

হ্যাঁ… হ্যাঁ… এইতো এখন আবছাভাবে অনেক কিছুই মনে পড়ছে তার। পর্যাপ্ত দ্রাক্ষা রসে সে যখন নেশায় বুঁদ হয়েছিল তখন সাবিত্রীর অট্টহাসি। ঘরের বিদিন মানষির এত চ্যাচামেচি হচ্চে ক্যা, ইরা কারা? সাবিত্রী খিল খিলিয়ে হাঁসে কেনগো আমার পেয়ারের নাগর। তুমি যে আমার সাথে মউজ মাস্তি করতে চাচ্ছিলে, কিন্তু এখনতো দেখছি বীণ বাঁজিয়েও তোমার জাগানো যাচ্ছে না। তাই কী আর করা। এখন ওরাই না হয় তোমাকে নিয়ে একটু আনন্দ ফুর্তি করবে।

আরও পড়ুল গল্প বিপরীত

গত রাতের এসব কথা মনে হতেই গোলাপের মন ও শরীর দুটোই ঘৃণা ও অপমানে রি রি করতে লাগল। টাকাগুলো না হয় হাতছাড়া হয়েছে কিন্তু নিজের সম্ভ্রম। ওহ্ খোদা আমাকে পাপ মুক্ত করো- আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলল গোলাপ। তার এখন ইচ্ছে হচ্ছে যমুনা নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করতে। দুঃসংবাদ বাতাসের আগে দৌড়োয়। আর এ দুর্ঘটনাটির খবরও গোলাপের পৌঁছার আগেই চরগোবিন্দপুর গ্রামে পৌঁছে গেল। দুদিন পর ঈদ কিন্তু সেই ঈদের খুশি ও আনন্দ কোথায় গোলাপ ও নিতাইয়ের ঘরে? দুটি পরিবারেই নেমে এসেছে করুণ বিষাদের ছায়া। ঘটনাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিতাইয়ের একেবারে মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। মাথাটি দুহাত দিয়ে চেপে ধরে বসে পড়ল উঠোনে। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাতে লাগল এদিক ওদিক। নিতাই অপুত্রক, তার স্ত্রী বিমলা সন্তানবতী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেননি এ পর্যন্ত। নিতাইয়ের এ অবস্থায় তার স্ত্রী নানা রকম সান্ত্বনার বাণী শোনাতে লাগলেন তাকে।

অবশেষে একদিন পর গোলাপ এলো নিতাইয়ের বাড়িতে। গোলাপ নিতাইয়ের চোখের দিকে দৃষ্টিপাত না করে, দূরে দিগন্তের দিকে তার নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি নিক্ষেপ কর্‌ সেদিন যা যা ঘটেছিল সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিল। নিতাই এসব শুনে কী করবে? তার প্রয়োজন টাকা। রাজশাহী কৃষি ব্যাংক থেকে এতগুলো টাকা লগ্নি করা হয়েছে, তার এই খামারটি বন্ধক রেখে। কি করে তার এই বিপুল ঋণ তিনি শোধ করবেন? নিতাই গোলাপকে উদ্দেশ্য করে বলল- আমি এতকিছু বুজিনি বাপু, তুই যেনতিন পারিস আমার গরু নাহয় টাহা দুইডের একটা ফেরত আইনে দে। এইডে ছাড়া আমি তোর মুখ দেখতিও চাইনে। এ মুহূর্তে কি করবে নিতাই সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নিতাইয়ের মনে পড়ল সেই পিতলের মুদ্রাটির কথা। যা তিনি কিছুদিন আগে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন রাস্তায়।

আরও পড়ুন গল্প তিল তাল

আলমারির দেরাজ থেকে মুদ্রাটি বের করে হাতে নিয়ে আরও বেশ কিছুক্ষণ সেটিকে ভালো করে দেখল নিতাই। জিনিসটি হাতের মধ্যে আলতো করে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে লাগল কী করা যায় এটি নিয়ে? আগে এটিকে এমন একজনকে দেখানো দরকার যে এটি সম্পর্কে দু’চার কথা বলতে পারে। চট করে নিতাইয়ের মাথায় এলো, চরগোবিন্দপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোলাম রসূলের নাম। তিনি একজন সদ্বজন ও জ্ঞানী মানুষ। তিনি বিলক্ষণ বুঝবেন এটি আদৌ কোনো মূল্যবান বস্তু কিনা।

গোলাম রসূল মুদ্রাটি হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে উল্টে-পাল্টে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, জিনিসটি সুলতানী না মোগল আমলের বুঝতে পারছি না। তবে আমার ধারণা এটি অবশ্যই একটি স্বর্ণমুদ্রা। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তুই এটিকে একবার পরেশ স্যাঁকরাকে দেখিয়ে নিস। স্বর্ণকার হিসেবে গ্রামে তার তো বেশ নাম-ডাক আছে জানি। তবে এটি যে তুই সড়কে কুড়িয়ে পেয়েছিস সেটা বলতে যাসনে। জিজ্ঞেস করলে বলিস দাদার কাছ থেকে বাবার হাত ঘুরে উত্তরাধিকার সূত্রে তোর হাতে এসেছে এটি।

আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা

আর আমি তোকে এমন একজন লোকের কাছে পাঠাচ্ছি যিনি এটি দেখলেই বলে দিতে পারবেন এটার প্রকৃত মূল্য ও এর ইতিহাস বৃত্তান্ত। লোকটির নাম ড. আবু শামস। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অনুষদের ডিন ছিলেন। পিএইচডি করেছেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইতিহাস বিদ্যাটিতে তিনি প্রথিতযশা ও বিজ্ঞ মনীষী। ভারতীয় মধ্যযুগ বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যের সঙ্গে শুধু তুলনা করা চলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এক সময়ের বিভাগীয় প্রধান ইরফান হাবীব ও অক্সফোর্ডের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. তপন রায় চৌধুরীর সঙ্গে। মানুষটির সঙ্গে আমার খণ্ডকালীন ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন। বহুকাল যোগাযোগ নেই, তবে পত্রালাপ হতো মাঝেমধ্যে। আপসোস মানুষটি অকৃতদার ও প্রচারবিমুখ। তা না হলে ইরফান হাবীব কিংবা তপন রায় চৌধুরীর চেয়েও বেশি নাম-ডাক হতো এ আমি হলফ করে বলতে পারি। এরপর গোলাম রসূল একটি সাদা কাগজে মুদ্রা ও এর বাহকের বিষয়ে প্রয়োজনীয় দু’চার কথা লিখে কাগজটি ভাঁজ করে তুলে দিলেন নিতাইয়ের হাতে।

আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৫ম পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!