সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৪র্থ পর্ব)
সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৪র্থ পর্ব)
রাজ্যের জ্যাম ঠেলে গাবতলি থেকে পরীবাগ পৌছতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল। জাকির তালুকদারের দামি প্রাইভেটকার থেকে গোলাপ নেমে একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। প্রাসাদোপম বাড়িটি দেখে গোলাপের মনে হলো মানুষটি সত্যি বিশটি গরু কেনার মতো যোগ্য লোকই বটে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলার কলিংবেলটি টিপতেই একজন অপরূপ সুন্দরী রমণী দরজাটি খুলে দিল। মেয়েটির চোখের প্রশ্নের উত্তরে জাকির তালুকদার বলল, ওহ, ইনি হলো গরুর ব্যাপারি। নাম গোলাপ, যার কাছ থেকে আজ এতগুলো গরু কেনা হল। গোলাপের দিকে তাকিয়ে জাকির তালুকদার মৃদু হেসে বলল, ইনি হলেন আমার স্ত্রী সাবিত্রী। সাবিত্রী…? এ আবার কি ধরনের নাম রে বাবা। সাধরণত হিন্দু ঘরের মেয়েদের নাম হয় সাবিত্রী। তাহলে তালুকদার সাহেব মনে হয় নিশ্চই কোন হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছেন। অবশ্য নামে বা আচরণে আর আজকাল বুঝার উপায় নেই কে হিন্দু আর কে মুসলিম।
চরগোবিন্দপুর বাজারে চায়ের দোকানে একটি ছেলে চা বিক্রি করে নাম বাদল সরকার। সারাজীবন গোলাপ জেনে এসেছে যে ছেলেটি হিন্দু কিন্তু পরবর্তীতে জানা গেল সে আসলে মুসলমান। আবার একবার অসুস্থ হয়ে গোলাপ ভর্তি হয়েছিল বারডেম হাসপাতালে। লাকি তালুকদার নামে একটি নার্স কি যে সেবা সশ্রুষা করে তাকে সাড়িয়ে তুলল সেটি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। একদিন দুপুরে তাকে গোলাপ ভাত খাওয়ার জন্য বেশ খানিকক্ষণ চাপাচাপি করল। কিন্তু কিছুতেই মেয়েটি খাবে না। পরে বাধ্য হয়ে মেয়েটি বলল আমি হিন্দু, গো মাংস আমার জন্য নিষিদ্ধ।
গোলাপের তো আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। সাবিত্রী নামের মেয়েটি নিঃসন্দেহে অতীব সুন্দরী পর্যায়ের। অনেকটা হিন্দি ছবির নায়িকাদের মতো। নীল জমিনের ওপর সাদা ফুল আঁকা সিফনের শাড়িটি শৈল্পিকভাবে কুচি দিয়ে কি সুন্দর করে পরেছে সে। নাভির বেশ খানিকটা নিচে। আর ব্লাউজটি ঠাস বুনোটে আঁটসাঁট হয়ে একেবারে শরীরের সঙ্গে যেন এঁটে আছে। নিটোল শরীর অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব ও আকর্ষণীয় দেহবল্লরী। বক্ষ বিভাজিকায় শোভা পাচ্ছে একটি মাধুর্যমণ্ডিত হীরার লকেট। হীরার লকেটটি যেভাবে তার সারা শরীরে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছে। রমণীটির রূপ-ঐশ্বৰ্য্যও ঠিক তেমনি ঘরজুড়ে আলো ছড়াচ্ছে যেন।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা
জাকির তালুকদার তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শোন সাবিত্রী, টাকাগুলো ভালো করে গুনে একটি ব্যাগের মধ্যে ভরে দাও। বেচারাকে যেতে হবে অনেকদূর। তার আগে চা-নাশতা কিছু একটা দাও। পরে না হয় রাতের খাবার খেয়ে উনি রাতের কোচ ধরে চলে যাবেন গ্রামে। গোলাপ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, খাওয়া দাওয়ার কোন দরকার নাই। চলেন টাহা গুনে বুজে নি গিরামের দিক পাও বাড়াই। সাবিত্রী চা-নাশতা আনতে ছুটলেন হেঁসেলে। ইতোমধ্যে জাকির তালুকদার একটি বিলেতি মদের বোতল নিয়ে সোফায় তার পাশে এসে বসেছেন। সঙ্গে ছোলা ভাজা, বাদাম ও লেবু দিয়ে মাখানো শসার সালাদ। টি-টেবিলে গ্লাস রাখা হয়েছে দুটি। দুটি গ্লাসের মাজেজা কী সেটা গোলাপের বোধগম্য হলো না সহসাই।
জাকির তালুকদার আনকোরা হুইস্কির সিপিটি খুলতেই, স্পিরিটের সঙ্গে কোনো সুগন্ধি মেশালে যেমন একটি গন্ধ তৈরি হয়, ঠিক তেমন একটি গন্ধ ভুড়ভুড় করে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। গ্লাসে হুইস্কি ও বরফ ঢেলে পান ভোজনে মত্ত হলো জাকির তালুকদার। এরই মধ্যে সাবিত্রী চা-বিস্কুট রেখে গেল টেবিলের উপর। পাশাপাশি খাবার টেবিলে রাতের খাবারও সাজাতে শুরু করল সে।
টেবিলে সাজানো হয়েছে নানা রকমের উপাদেয় ব্যঞ্জন। বাঁশমতি চালের ধবধবে সাদা ভাত, খাসির রেজালা, মুরগির ঝাল ফ্রাই, মুগডাল দিয়ে তৈরি মুড়িঘণ্ট, মচমচে করে ইলিশ ভাজা, তার উপর বাদামি রঙের কুচিকুচি করে কাটা পেঁয়াজের বেরেস্তা ভেজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে খুব যত্ন করে। খাবারগুলো দেখে মনে হয় যেন টেবিলে নানা রঙের সব পসরা নিয়ে বসেছে কেউ। সরস অন্নের ঘ্রাণে গোলাপের পেটের খিদেটা যেন দ্বিগুণ বেগে চনমনিয়ে উঠলো। জিভে একেবারে পানি আসার মতো অবস্থা। এত পদের ব্যঞ্জন দিয়ে তার খাওয়া হয়ে ওঠে না সচরাচর। ভিন্ন ভিন্ন পেশার কারণেই তাকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কাটাতে হয় জীবনের বেশিরভাগ সময়। সে জন্যই তার খাবারও জোটাতে হয় কখনো রাস্তায়, ফুটপাতে, লঞ্চ-স্টিমার ও জাহাজঘাটায়। রাজ্যের সব বারোয়াড়ি ও অকুলীন আহার্য দ্রব্যে তার পেটটি যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। টেবিলে রাখা ভোজ্য পদগুলো এতই সুগন্ধ ছড়াচ্ছে যে, গোলাপের মনে হলো ওগুলো কোনো নামিদামি ভোজনালয় কিংবা রেস্তোরায়ও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
আরও পড়ুন গল্প জীবনের উপহাস
জাকির তালুকদার বেশ কয়েক পেগ মদ উদরপূর্তি করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। মাথাটিও চড়েছে বলে মনে হচ্ছে কিঞ্চিৎ। নেশার জন্য তার চোখ দুটি অত্যুজ্জ্বল। কিছুটা মাতলামি গলায় গোলাপকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন- আরে ভায়া এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? মদ জিনিসটা কী কখনো একা খাওয়া যায়? নাও না তুলে গ্লাসটা? একটু হলেও অন্তত চেখে তো দেখ। তারপর রাতের খাবার খেয়ে না হয় রওনা হয়ে যেও। এই বলেই সে আরেকটি গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে শুরু করল। আরে একি হইরতিছেন? আর না… আর না…। আমি এই টুকই খাবো।
জাকির তালুকদার লোকটিকে বেশ উদার ও দরাজ মেজাজের মানুষ বলে মনে হলো গোলাপের কাছে। এত ভালো মানুষ এই সময়ে পাওয়া সত্যিই বেশ কঠিন। এর যত্নআত্তি করছে তাকে। গোলাপ এবার হুইস্কির গ্লাসটি আলতো করে হাতে তুলে নিল। কাঠের আসবাবে বার্নিশ করার তারপিনের মতো রঙ বস্তুটির। গোলাপ যে আগে কখনো মদ স্পর্শ করেনি তা কিন্তু নয়। সে আগে যে কবার পান করেছে তার মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা মদ যা ভাত পঁচিয়ে তৈরি করা। অথবা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির স্পিরিট। বিলেতি মদ তার জীবনে এই প্রথম। আর এ জন্যই বোধকরি লোভটি সামলানো গেল না সহজে।
দু’চার পেগ গলধঃকরণ করতেই গোলাপের মাথাটি ঝিমঝিম করতে লাগল। আসলে ঝিমঝিম নয় মাথাটি ঠিক যেন চরকির মতো ঘুরতে লাগল। সেই যে বৈশাখী মেলায় নাগরদোলার চরকি, সেরকম। নাকি সেই চরকি যেখানে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভল্লুক সব আঁকা থাকে আর খদ্দেররা যে যার পছন্দ মতো ঘরে পয়সা ফেলে। তারপর চরকির বোর্ডটি ঘুরতে ঘুরতে যার ভাগ্যে গিয়ে স্থির হয় সে সব টাকা নিয়ে চলে যায়। কী যেন কোন চরকি হবে? মাথার মধ্যে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে গোলাপের। আরও একটু মদ ঢকঢক করে গিলে নিল গোলাপ। কত পেগ খাওয়া হয়ে গেছে তা একবার গোনার চেষ্টা করল সে। সাত…আট… নাকি দশ।
আরও পড়ুন গল্প পরাভূত
সাবিত্রী এবার বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল গোলাপের পাশে। হাত বুলাতে লাগল তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে। কী হে গোলাপ- আরও দু’এক পেগ হবে নাকি? ঢেলে দেব গ্লাসে? এসব সে কি দেখছে? সত্যি সত্যি কি তার সঙ্গে এসব হচ্ছে? নাকি সবই ভ্রম কিংবা কৃহক? এখন সে সম্পূর্ণই আউট। মাথাটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে মাথামুন্ডু কী সব আজেবাজে বকছে সে। সেগুলোর বেশিরভাগেরই পাঠ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। হঠাৎ মাথাটা চরম গুলিয়ে উঠল গোলাপের। হর হর করে উগলে দিল পাকস্থলির সবকিছু- তারপিন রঙের হুইস্কি, ভাজা ছোলা, চানাচুর, পেঁয়াজ, লেবু দিয়ে তৈরি সালাদ। ভিতরের সবকিছু বেরিয়ে এল প্রচণ্ড বেগে। তারপর বেশ ক’বার ওয়াক ওয়াক শব্দ করে একবারে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। পুরো রাত ধরে মনে হলো যেন হালকা লয়ে বহু মানুষের আনাগোনা ও গুঞ্জন শুনতে পেল গোলাপ। কখনো কখনো সাবিত্রীর অট্টহাসি হালকা লয় ভেদ করে তারস্বরে পৌঁছাল তার কানে।
একসময় মনে হলো কেউ বুঝি তার ওপর চড়ে বসেছে। নাকি সেগুলো সবই স্বপ্ন। গোলাপের তা সঠিক করে বলার উপায় নেই । সম্ভবত সকাল দশটা কিংবা এগারটা হবে। গোলাপের হাতে ঘড়ি নেই তাই সে সঠিক করে বলতে পারবে না। তার ঘুম ভাঙল এক দারোগার লাঠির গুঁতোয়। গোলাপ হকচকিয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসল। একী সে কোথায়? এটাতো দেখা যাচ্ছে ফ্ল্যাটের বাইরে সিঁড়ির ওপর শুয়ে আছে সে। দারোগাটি বেশ উত্তেজিত গলায় গোলাপকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে তোর মতলবখানা কি? চুরি না ডাকাতি? কোন ধান্দায় বেরিয়েছিলি? চল, থানায় চল। পোঁদের উপর প্যাদানি পড়লেই আপনা-আপনি সব মুখ দিয়ে বেরুবে।
আরও পড়ুন অশরীরী আত্মা
গোলাপ অনুনয় বিনয়ের সঙ্গে হাতজোড় করে দারোগার কাছে সবকিছু খুলে বলল, লুকালোনা কিছুই। পুলিশ অফিসারটি ঈষৎ বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, আমার সঙ্গে চালাকি? ধাপ্পাবাজ কোথাকার। এ ফ্ল্যাটের মালিকের নাম সাবিত্রী হতে যাবে কোন দুঃখে? উনার নাম শায়লা বেগম। উনি ঢাকা শহরের একজন খ্যাতিমান সমাজসেবিকা। তুই এইসব কি বলছিস? মাথামুন্ডু ঠিক আছে তো? দারোগা ও গোলাপের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুনে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সাবিত্রী। তিনি প্রশ্ন করলেন- এ কী অফিসার, আমার দোরগোড়ায় এতসব হট্টগোল কিসের? পুলিশ অফিসারটি সাবিত্রীকে বলল- ম্যাডাম এই লোকটি বোধহয় সারা রাত এই সিঁড়ির উপর শুয়ে ছিল। আপনি কী একে চেনেন? সাবিত্রী তার সুন্দর চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বলল আমি তাকে চিনতে যাব কেন? জীবনে আগে কখনো তাকে দেখিনি। এইতো এখনই প্রথম দেখলাম। তা সে এখানে ঘুমাচ্ছিল কেন? দারোগাটি বলল- সে কথাতো আমি বলতে পারব না। আপনি যদি ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন তাহলে থানায় নিয়ে আচ্ছা করে ধোলাই দিলেই সব বের হয়ে আসবে।
না, না থাক ধোলাই দিতে হবে না। ও তো আর আমার ঘরে ঢুকে কিছু চুরি টুরি করেনি। ওকে বরং ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিন কিন্তু এদিক যেন না আসে আর। দারোগাটি গোলাপের শার্টের কলার চেপে ধরে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির চৌহদ্দির একেবারে বাইরে নিয়ে গেল। তারপর বেশ ঝাঁঝাল গলায় বলল- মহিলাটি ভদ্র বলে বেঁচে গেলি ব্যাটা। উনি তোর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে ধোলাই দিয়ে এতক্ষণে তোর পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলতাম। বাঁচতে চাস তো জীবনে আর এদিক মাড়াসনে। কথাগুলো বলে, দারোগাটি হন হন করে তার জিপটির দিকে এগিয়ে গেল।
আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (৪র্থ পর্ব)