শিকড়ের সন্ধানে (১ম পর্ব)
শিকড়ের সন্ধানে (১ম পর্ব)
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
──মা, আমার বাবা-মা কে? আমার বাড়ি কোথায়? আমাকে তোমরা কোথা থেকে এনেছ? কি আমার পরিচয়? জবাব দাও। জবাব আজ তোমাকে দিতেই হবে। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পরে বর্ষা।
নাবিলা হতভম্ব! অবাক হয়ে চেয়ে থাকে বর্ষার কান্না ভরা মুখের দিকে! নাবিলার হতভম্ব চেহারা দেখে আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে বর্ষা।
──কি হলো, কথা বলছো না কেন? জবাব দাও। জবাব চাই আমি।
বর্ষার চিৎকারে যেন সম্বিৎ ফেরে নাবিলার। থত মত খেয়ে বলে,
──কি আবোল-তাবোল বলছিস তুই এসব? আমি তোর মা। তোর বাবাকে চিনতে পারছিস না! রানা, রোমান তোর ভাই। এতে তোর সন্দেহ কেন? এক সাথে বড় হয়েছিস, এক সাথে খেলাধুলা করেছিস, ঝগড়া মারামারি করেছিস, এক বিছানায় ঘুমিয়েছিস! এখন হঠাৎ করে কেন তোর মনে হচ্ছে আমরা তোর কেউ না?
বর্ষা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আবার।
──প্লিজ মা, আমার বয়স এখন তের বছর। এই তের বছর আমি তোমাদের কাছে, তোমাদের স্নেহে, যত্নে বড় হয়েছি। আর মিথ্যা গল্প শুনিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করো না। আমি যে তোমাদের কেউ না, তোমরা যে আমাকে অন্য কারো কাছ থেকে এনে বড় করছো সেটা আমি শুনেছি। মালা আন্টি তার ননদকে বলছিলেন, আমাকে তোমাদের মেয়ে করে নিয়ে আসার কথা। তোমরা আমাকে স্নেহে, আদরে বড় করছ। আমাকে শিক্ষা দিয়ে, আমার সব আব্দার পুরণ করছো। আমি তোমাদের ঋণ কোন দিনও শোধ করতে পারব না। তবে যেহেতু আমি জেনে গেছি, রানা আর রোমানের মতো তোমার পেটে আমি জন্ম নেইনি, কিন্তু কোথাও না কোথাও, কারও না কারও পেটে তো আমার জন্ম হয়েছে, আমি শুধু সেই সত্য টুকুই তোমার কাছে জানতে চাইছি। এটা কি আমার বেশী চাওয়া? মা, প্লিজ আমাকে বল। আমার সত্য পরিচয়।
আরও পড়ুন গল্প দীপ্তিদের দেবতা
স্তব্ধ নাবিলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
──ঠিক আছে, তোর বাবা ফিরে আসুক। তার কাছ থেকেই বরং তুই জেনে নিস তোর আসল পরিচয়।
বর্ষা আজ স্কুলে যায়নি। সারা দিন পার হয়ে গেল, বর্ষা কোন খাবার মুখে তুলল না।
সন্ধার পর বাসায় ফিরল আতিক। ঘরে ঢুকেই প্রতিদিনের মত চিৎকার করে ডাকল বর্ষাকে,
──কইরে, আমার মা কই? এদিকে আয় জলদি। দেখ কি এনেছ?’
প্রতিদিনই অফিস থেকে ফেরার সময় মেয়ের জন্য কিছু না কিছু হাতে নিয়ে ঘরে ফেরে আতিক। সেদিনও ব্যত্যয় ঘটেনি এর। অন্যদিন বাবার গলা শুনে দৌড়ে এসে বাপের গলা জড়িয়ে ধরে আব্দার করে জানতে চায়, বাবা কি এনেছে তার জন্য।
আজ বাবার ডাক শুনেও ঘর থেকে বের হলো না বর্ষা। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকল। সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। কয়েকবার ডেকেও বর্ষার সাড়া না পেয়ে, নাবিলার কাছে জানতে চাইল,
──ব্যাপার কি?
নাবিলা খুলে বলল সবকিছু। সব শুনে আতিক অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বর্ষার ঘরের দরজায় গিয়ে বলল,
──শোন মামনি, এদিকে আয়, আমার কাছে। যা জানতে চাস, আমি বলছি।
আরও কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর দরজা খুলে বের হয়ে এল বর্ষা। তখনও চোখ-মুখ ফুলে আছে। চোখের নীচে পানির দাগ শুকিয়ে আছে। আতিক ছুটে গিয়ে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় মেয়েকে। বলে,
──এবার আমাকে বল, যা জানতে চাস তুই। আমি তোকে বলব।
আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
বর্ষা কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে নিয়ে নাবিলাকে যা বলেছিলো, সেই কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করলো। বর্ষা থামলে আতিক বলল,
──বরিশাল জেলার সৈয়দপুর গ্রাম। সুন্দর ছায়া ঘেরা বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের মতই। অন্য দিনের মতোই সবেমাত্র ফজরের আজান হচ্ছে গ্রামের মসজিদ থেকে। তখনও অন্ধকার কাটেনি। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। টিনের চালের উপরে পেয়ারা গাছ থেকে টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ এখনো কানে আসছে। সৈয়দপুর গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির লোকজন এখনও গভীর সুপ্তিতে আচ্ছন্ন। কামাল সাহেব সৈয়দপুর গ্রামের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। সবাই তাঁকে মান্য করে। বিপদে আপদে পরামর্শের জন্য ছুটে আসে তাঁর কাছে। প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করা তাঁর দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। সেদিনও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি।
কুয়ার পাড় থেকে ওজু সেরে মসজিদের দিকে পা বাড়ালেন কামাল সাহেব। মসজিদটি গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। হালট ধরে যাওয়ার পথেই পড়ে গ্রামের কবরস্থানটা। ঘন গাছপালায় ঘেরা কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়, কবরস্থানের কবরগুলোর পাশে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেয়া মানুষদের প্রিয়জনদের লাগানো জুঁই, কামিনী, বেলী ফুলের গাছ থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ এসে মনকে আবেশে ভরে তোলে। ভোরের পাখিদের কলকাকলী মুখর করে তোলে চারপাশ!
ভোরের এই শান্ত, স্নিগ্ধ সমাহিত রুপ প্রতিদিনই উপভোগ করেন তিনি। বৃষ্টি ধোয়া গাছপালা যেন মোহনীয় সাজে সেজেছে! সবুজ গাছগুলো যেন আরও ঘন সবুজ হয়ে উঠেছ! একটি রাতের শেষে নতুন ভোর, নতুন আর একটি দিনের শুরু!
বৃষ্টি থেমে গেলেও, এখনও আকাশের মুখ ভার! যে কোন মুহূর্তে অঝোর বর্ষণ শুরু হওয়ার আশংকা। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। টর্চ হাতে কামাল সাহেবকে বেশ সাবধানে পা ফেলে এগোতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন গল্প নীল সমুদ্রের ঢেউ
কবরস্থানের কাছাকাছি আসতেই নবজাতকের কান্নার আওয়াজের মত একটা আওয়াজ ভেসে এল কামাল সাহেবের কানে। একটু থমকে দাঁড়ালেন তিনি! বিড়ালের ডাক মনে করে কিংবা শোনার ভুল মনে করে আবার পা বাড়ালেন। নাহ, শোনার ভুল নয়! এবার স্পষ্ট শিশুর কান্নার শব্দ এবং বেশ জোরালো! যেদিক থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে, জোর পায়ে, প্রায় দৌড়ে গেলেন কান্নার শব্দের কাছে। কবরস্থানের মাঝামাঝি চারদিকে শিকড়-বাকর ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী এক বট গাছ। বট গাছের নীচে ঘন পাতার স্তুপের মধ্যে কাঁথায় জড়ানো এক নব জাতক শোয়ানো! শিশুটি একটু পরপরই কেঁদে উঠছে। তখনো বট গাছ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে! কামাল সাহেব দৌড়ে গিয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। পানিতে চুপচুপে ভেজা তার শরীর! শিশুটিকে বুকের ভিতর জড়িয়ে নিয়ে ছুটলেন বাড়ির দিকে।
সাজেদা বেগম সবে নামাজ আদায়ের জন্য জায়নামাজ হাতে বারান্দার জলচৌকির দিকে পা বাড়িয়েছেন। কামাল সাহেবকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেলেন! কি ব্যাপার জানতে চাওয়ার আগেই কামাল সাহেব বুকের কাছে জড়িয়ে রাখা পোঁটলাটা এগিয়ে দিলেন সাজেদা বেগমের দিকে। পরম বিস্ময়ে সাজেদা বেগম শিশুটিকে হাত বাড়িয়ে নিজের বুকে তুলে নিলেন! মানুষের বুকের ওমে শিশুটির কান্না একটু কমলেও তখনও একটু পরপরই কেঁদে উঠছে। দ্রুত শুকনো কাপড়ে জড়িয়ে শিশুটির শুশ্রুষায় লেগে গেলেন তিনি।
দুধ গরম করে চামচে করে একটু একটু করে খাওয়ানোর পর খানিকটা ধাতস্থ হলো শিশুটি। কামাল সাহেব অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন, কোন নিষ্ঠুর পিতা-মাতা এমন কাজ করলো! এভাবে নিজেদের বুকের ধনকে কবরস্থানে ফেলে রেখে গেল হৃদয়হীন ভাবে! গ্রামের সবাইকেই ভালভাবেই চেনেন তিনি। তবু ভাবলেন একটু খবর নেয়া যাক। বাড়ির গৃহ কর্মী সুফিয়াকে ডেকে বললেন, আশে-পাশের পাড়ার সব বাড়িতে খবরটা জানাতে।
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
কবরস্থানে নবজাতক শিশু পাওয়ার খবর বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে! সবার একই প্রশ্ন, কোন পাষণ্ড এমন কাজ করলো!
শিশুটিকে নিয়ে কি করা উচিত-ভাবতেই মনে পড়লো তাঁর আইনজীবী বন্ধু আজিজ সাহেবের কথা। আজিজ সাহেবকে বিষয়টা জানাতেই তিনি পরামর্শ দিলেন, শিশুটির বিষয়ে তাঁর উচিত স্থানীয় থানাকে অবগত করানো।
সাজেদা বেগম ইতিমধ্যেই শিশুটিকে একটা পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নিয়েছেন। একটা কাঁচের বোতলে গরম দুধ, একটা পেয়ালা, চামচ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিপত্র একটি ব্যাগে ভরে নিয়েছেন। কামাল সাহেব ও সাজেদা বেগম শিশুটিকে নিয়ে থানায় পৌঁছে থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তাকে শিশুটির ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন।
থানা থেকে প্রায়ই কুড়িয়ে পাওয়া বা অসহায় অনেক শিশুকেই আইন নিয়ে কাজ করে বা যে সব প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয় থানা থেকে। আইনগত প্রক্রিয়া শেষে ঐ সব শিশুদেরকে তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়।
এমনি একটি সংগঠনের জিম্মায় দেওয়া হল কবরস্থানে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটিকে।
আরও পড়ুন শেকড়ের সন্ধানে-
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
শিকড়ের সন্ধানে (১ম পর্ব)