লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (১ম পর্ব)
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (১ম পর্ব)
কাবার্ড থেকে কর্নফ্লেক্সের বাক্সটা বের করতে গিয়ে কবিরের মনে হলো এত বেলায় প্রাতঃরাশ না করে একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলেই বোধ করি ভালো হতো। টানা সাত দিন একনাগাড়ে লাইব্রেরিতে কাটিয়ে কিছু একটা যে দাঁড় করানো গেছে; এটাই স্বস্তির বিষয়। প্রস্তাবনাটা প্রফেসর টার্নারকে সন্তুষ্ট করবে বলে আশা করা যায়।
মণিবন্ধের ঘড়িটায় সময় দেখাচ্ছে প্রায় ১২টা। ফ্রিজ খুলে দেখা গেল কিছুই নেই ওতে। থাকবেই বা কী করে। দু’দিন হাঁড়ি চড়েনি। এটা-ওটা খেয়ে চলছে এ কদিন। পিএইচডির জন্য অভিসন্দর্ভটা লিখতে গিয়ে কালঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে। যাকে বলে একেবারে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
ছুটির দিনগুলোতে প্রতিনিয়তই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। পাঠক্রমের ধরাবাঁধা ছক ভেঙে কবিতা, সাহিত্য কিংবা দর্শনের বইগুলো ছুটির দিন ছাড়া পড়ার ফুরসৎ কোথায়। রাত জেগে কবির পড়ে সিমোন দ্য বুভেয়ার, সাত্রে, ভলতেয়ার, রুশো কিংবা জর্জ এলিয়ট। এতেই তার হৃদয় সত্যি সত্যি পরিশ্রুত হয়।
দুধভর্তি জামবাটির এক বাটি দুধের মধ্যে কর্নফ্লেক্স ঢালতে গিয়ে কবিরের খেয়াল হলো রান্নাঘরটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বাইরে ঝকঝকে রোদ অথচ ঘরের ভেতর অন্ধকার। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতেই ঘরের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে অজস্র আলোর ফোয়ারা। বাইরে চোখ মেলতেই দেখা গেল দূরে আকাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পাইন, ওক আর চেস্টনাট গাছের সারি। বাগান আলো করে ফুটে আছে হথর্ন, লাইল্যাক আর লাবার্নাম ফুল। গ্রীষ্মের আগমনে আপেল গাছগুলোও মঞ্জুরিত হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কবিরের চোখ আটকে গেল বার্জ গাছের নিচে বসা দুজন মানুষের ওপর। একজনকে তো দিব্যি চেনা যাচ্ছে কিন্তু শেরদিলের পাশের মেয়েটি কে। শেরদিল এসেছে পাকিস্তান থেকে। কবিরের ডর্মে থাকে। মাস্টার্স করছে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে।
আরও পড়ুন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প রক্তে জ্বলে একাত্তর
এখানে পড়তে এসে কবিরকে যখন পোলক ছাত্রাবাসগুলোর অন্যতম গ্র্যান্ড ভবনে থাকতে দেওয়া হলো, তখন তো তার আনন্দের সীমা নেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চোখধাঁধানো নিসর্গঘেরা ছোট্ট স্বপ্নময় আবাসন। এত সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো ছাত্রাবাসটি দেখে প্রথমে আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল। সেই আনন্দে কেউ যেন একঘড়া বিষ ঢেলে দিল যখন সে দেখল তার ফ্ল্যাটেরই একটি কক্ষ দখল করে আছে শেরদিল নামের এই পাকিস্তানি।
জানালা দিয়ে কবির লক্ষ করল অবিশ্রান্ত গতিতে কথা বলে চলছে শেরদিল। তরুণীটি শুধু মাথা নাড়ছে। হাত নেড়ে নেড়ে মেয়েটিকে যেন কী সব বোঝাচ্ছে।
কবির মনে মনে হাসে। সুন্দরী ওই তরুণীটিকে অন্তত একটি রাতের জন্য জয় করার অভিলাষে নিশ্চয়ই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে শেরদিল। মুখ দিয়ে নিশ্চয়ই ছুটছে অজস্র মধুর মিথ্যার ফুলঝুরি। শেরদিল নিশ্চয়ই মেয়েটিকে বলছে, “জানো, আমরা চৌদ্দ পুরুষ ধরে জমিদার। আমাদের জমিজিরাত হেলিকপ্টারে চেপে সম্পূর্ণ একদিন ধরে দেখলেও ফুরোয় না ইত্যাদি, ইত্যাদি।”
এই সুন্দরী তরুণীটি যদি শেরদিলের ঘরে যায়, তাহলে ও কী করবে। মেয়েটিকে ধরে জোর করে চুমো খাবে? মেয়েটির সোনালি চুলের ঘ্রাণ নেবে? নাকি ধর্ষণ করবে। কবিরের মনে হলো বুঝিয়ে-সুজিয়ে ওকে ঘরে নিতে পারলেই শেরদিল ওকে ধর্ষণ করবে। কবিরের মনে হতে লাগল, পাকিস্তান ধর্ষণ, পাকিস্তান ধর্ষণ, ধর্ষণ…। আচ্ছা পাকিস্তানিরাও কি মুগ্ধ হয়! তাদেরও কি মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা আছে কিংবা আছে সৌন্দর্যবোধ? কবির নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে।
ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। এক্ষুনি কিছু একটা রান্না না করলেই নয়। শুধু কর্নফ্লেক্সে ক্ষুধা পুরোপুরি নিবৃত্ত হয়নি। হঠাৎ করেই প্রবলভাবে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করল কবিরের। কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয় না। ভাবতেই বুকটা যেন কেউ চেপে ধরে। আহা কী কষ্ট!
গত সপ্তাহে দুটো মুরগি কেনা হয়েছিল সুপারমার্কেট থেকে। ফ্রিজ থেকে তারই একটি বের করা হলো ডিফ্রস্ট করার জন্যে। বান্নার জোগাড়যন্ত্র নিয়ে কবির যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তখনই শেরদিল ঘরে ঢুকল সেই তরুণীটিকে সঙ্গে নিয়ে।
আরও পড়ুন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প একশত ছিদ্রযুক্ত জামা
ডর্মে প্রবেশের দিন থেকে অদ্যবধি কবির শেরদিলকে হাই কিংবা গুড মর্নিং কিছুই বলেনি, হয়নি একটি বাক্যবিনিময়ও। দুজন দুজনের প্রতি পোষণ করেছে শুধুই সীমাহীন ঘৃণা। কবির মনে মনে অসংখ্যবার খুন করেছে শেরদিলকে। শেরদিলও নিশ্চয়ই তাকে। ২৬শে মার্চের পর থেকে পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করলেই জিহ্বায় অনুভূত হয় এক ধরনের তিক্ততা। আসলে ২৬শে মার্চ বলাটা ভুল হলো। পরিণত বয়সে যখন থেকে সে বুঝতে শিখছে পাকিস্তান মানেই হচ্ছে অত্যাচার, নিপীড়ন আর বৈষম্যের প্রতীক, ঠিক তখন থেকে।
তরুণীটি ঘরে ঢুকেই কবিরকে বলল,
— হাই।
কবিরও সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল,
— হাই।
মেয়েটি প্রলম্বিত পদক্ষেপে একটি টেবিলে গিয়ে বসল। শেরদিল সম্ভবত মধ্যাহ্নভোজের জন্য নিমন্ত্রণ করেছে তরুণীটিকে। মেয়েটিকে মুগ্ধ করতে মহাসমারোহে রান্নার আয়োজন শুরু করল শেরদিল। কখনও ফ্রিজ খুলে বের করছে কয়েক টুকরো পনির, কখনও ফ্রঁসোয়া কিংবা আবার কখনও প্লেটে সাজাচ্ছে শুকনো পাউরুটির টুকরো। শেরদিল যেন চিরাচরিত মেজাজে হয়ে উঠেছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভ্রান্ত ও উন্মাদ এক কামুক।
মেয়েটি কবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি?
— বাংলাদেশ, সোৎসাহে জবাব দিল কবির।
মেয়েটি এবার বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল,
— আমি তোমার দেশকে চিনি। ওখানে তো এখন ভীষণ যুদ্ধ হচ্ছে, তাই না? অনেক লোক মারা যাচ্ছে পাকিস্তানি যোদ্ধাদের হাতে।
শেরদিল চোয়াল শক্ত করে তাকাল মেয়েটির দিকে। শেরদিলের অভিব্যক্তিতে মেয়েটি বিপন্নের মতো এদিক-ওদিক তাকাল দু’একবার। সে হয়তো ভুলেই গিয়েছিল আজ সে শেরদিলের নিমন্ত্রিত অতিথি।
আরও পড়ুন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা
মেয়েটি জানালো সে এসেছে ফরাসি দেশ থেকে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছে ইংরেজি সাহিত্যে।
কবির সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল,
— আমিও তোমার মতো সাহিত্যের ছাত্র। তবে ইংরেজি নয়, বাংলার। আমার মাতৃভাষার। এখানে আমি স্কলারশিপে পিএইচডি করতে এসেছি, ভাষাতত্ত্বে।
কবির নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল, স্কলারশিপ কথাটির মধ্যে কী ঈষৎ?
আত্মঅহংকার কিংবা আত্মশ্লাঘার প্রকাশ পেল। পেলে পাক, তাতে কী আসে যায়। পৃথিবীতে শুধু মেধা, মনন, সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পবোধ নিয়েই উচ্চকিত হওয়ার ন্যায্যতা থাকা উচিত। বিত্ত, বৈভব, সৌন্দর্য, বংশমর্যাদা কিংবা অন্য কিছুর নয়।
তরুণীটি সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল,
— তোমার নামটা কি জানতে পারি?
সসপ্যানে খুন্তি চালাতে চালাতে কবির বলল,
— হুমায়ুন কবির।
মেয়েটি জানাল ওর নাম হেনরিয়েট ডিবন। ও এসেছে ফ্রান্সের তুলুস থেকে; প্যারিস থেকে তুলুস গাড়িতে ছ’সাত ঘণ্টার পথ।
হেনরিয়েট দেখতে নিপুণ কোনো শিল্পীর পটে আঁকা ছবির মতো। সরল উন্নত গড়ন, মসৃণ ত্বক। দু’গালে যেন গোলাপি রুজ পাউডার লেপে দিয়েছে কোনো জাতশিল্পী। টিকোলো নাক, কালো ঘন ক্র, সুপুষ্ট কামুক ঠোঁট। বারগেন্ডি রঙের চুলের সঙ্গে সোনালির মিশ্রণ, যেন আগুনের সঙ্গে সোনা মেশানো। শরীরের শুভ্রতার সঙ্গে মুখের লালিমার মিশ্রণ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর রংতুলিকেও হার মানায়। গভীর নীল চোখ, চওড়া চোয়াল আর বড়ো চিবুক। খাঁটি ফরাসি চরিত্র এই চিবুকেই ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ুন লেখকের মুক্তিযুদ্ধ –
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (১ম পর্ব)