রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাগার চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাগার চিন্তা
রবীন্দ্রনাথ যুগস্রষ্টা চিন্তাবিদ। তাঁর চিন্তায় তাঁর সমকালের সকল দিকই অনবদ্য ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে। গ্রন্থাগার ভাবনাও তাঁর সচেতন মনে রেখাপাত করেছে এবং তাঁর রচনার মধ্যে তা ছড়ানো রয়েছে। উনিশ শতকের শেষ দশকে (১৮৮৬ সালে) ১২৯২ বঙ্গাব্দে তিনি ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধটি লেখেন। (১৯২৮ সালে) ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে নিখিল ভারত গ্রন্থাগার সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে তিনি যা বলেন তা ‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এ দুটি প্রবন্ধে বরীন্দ্রনাথের যে চিন্তা চেতনা প্রকাশিত হয় তা ১৯৩১ সালে ভারতীয় গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী এস আর রঙ্গনাথনের পঞ্চনীতি (Five Laus of library Science) প্রকাশের আগে। উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির জগতে গ্রন্থাগার নিয়ে ভাবনায় রবীন্দ্রনাথই পথিকৃত।
রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে চিন্তার প্রসারতায় গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্য ও কর্মধারাগুলো এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের দর্শন শাশ্বত রূপে প্রকাশিত। গ্রন্থাগারের স্বরূপ ও গ্রন্থাগারিকের কর্তব্যের কথা তিনি সামান্য কয়েকটি কথার মধ্যেই অনবদ্যরূপে প্রকাশ করেছেন। ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহানন্দের সঙ্গে লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃংখলে কাগজের কারাগারে বাধা পড়িয়া আছে’। মানুষ অমর নয়, দূরের মানুষের বাণী কাছের মানুষের কানে পৌঁছে না, কিন্তু গ্রন্থ স্থান ও কাল অতিক্রম করে যায়। গ্রন্থ মানুষের উপলব্ধির ধারক ও বাহক এবং গ্রন্থাগার হচ্ছে এর ধারণ ও প্রসারকেন্দ্র।” রবীন্দ্র চিন্তায় গ্রন্থের এই স্থিতিশীল অথচ চলমান রূপটি প্রকাশ পেয়েছে।
“এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে, বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে, সংশয় ও বিশ্বাস, সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে দেহে দেহে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার লগ্ন হইয়া বাস করে।” রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি গ্রন্থ সংগ্রহের স্বরূপ ও নীতি নির্দেশ করে । গ্রন্থাগারে সব মতের, সব পথের, সব বিষয়ের বই থাকে, একই বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনুসন্ধিৎসু পাঠক যাতে চিন্তা করতে পারেন সেই ব্যবস্থাই গ্রন্থাগারিক নিরপেক্ষভাবে করেন।
আরো পড়ুন প্রবন্ধ সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর: বাংলাদেশের কথাসাহিত্য
‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “অধিকাংশ লাইব্রেরিই সংগ্রহ বাতিকগ্রস্থ। তারপর আনা বই প্রায়ই ব্যবহারে লাগে না, ব্যবহারযোগ্য অন্য চার আনা বইকে এই অতিস্ফীত গ্রন্থপুঞ্জ কোণঠাসা করে রাখে।” এই উক্তির মধ্যেও জীবন্ত গ্রন্থাগারের স্বরূপ কেমন হবে তার দর্শনটি রয়েছে। রঙ্গনাথনও বলেছেন বই ব্যবহারের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “লাইব্রেরি তার যে অংশে জমা করে সে অংশে তার উপযোগিতা আছে, কিন্তু যে অংশে সে নিত্য ও বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত সেই অংশে তার সার্থকতা।” লাইব্রেরির আকৃতি ও প্রকৃতির দার্শনিক রূপরেখাই শুধু নয়, রঙ্গনাথনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় নীতির কথাও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আগেই রূপ পেয়েছে এভাবে, “শুধু পাঠক লাইব্রেরিকে তৈরি করে তা নয়, লাইব্রেরি পাঠককে তৈরি করে তোলে।” অর্থাৎ প্রত্যেক পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী বই যেমন থাকবে তেমনি প্রতিটি বইয়ের চাহিদা অনুযায়ী থাকবে পাঠক। গ্রন্থাগারিকের কর্তব্য সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের উক্তি প্রনিধানযোগ্য, “লাইব্রেরিয়ানের গ্রন্থবোধ থাকা চাই, কেবল ভাণ্ডারী হলে চলবে না। লাইব্রেরিয়ানের থাকবে গুদাম রক্ষকের যোগ্যতা নয় আতিথ্য পালনের যোগ্যতা।” গ্রন্থ ব্যবহারের সহজ ব্যবস্থা করাই গ্রন্থাগারের মূখ্য কর্তব্য।
এভাবেই রবীন্দ্রচিন্তায় সূত্রাকারে ছড়িয়ে আছে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান এবং গ্রন্থাগারকে ক্রমবর্ধনশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উপায়। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক শিক্ষা জগতে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান শিক্ষারও শুরু ও পথিকৃত। প্রথমে ব্রহ্মবিদ্যালয় আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময়ে (১৯০১ সালে) রবীন্দ্রচিন্তায় আশ্রমের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। শান্তিনিকেতনকে বিশ্বভারতীতে (১৯২১ সালে) রূপান্তর করার সময় গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ও দর্শন তুলে ধরেন রবীন্দ্রনাথ। বইয়ের জন্ম থেকে এর সংরক্ষণের দিক, বই প্রকাশের ও প্রযুক্তির দিক, তত্ত্ব ও তথ্যের দিক, বইয়ের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের দিক, বইয়ের চিত্ররূপ ও রসরূপের দিক তথা বইয়ের উৎপত্তি, গঠন, বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণের সাথে সাথে গ্রন্থাগার সংগঠন ও পরিচালনার দিক ও ধারা এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
আরও পড়ুন প্রবন্ধ সাহিত্য চর্চার একাল সেকাল
গ্রন্থাগারের কলেবর বাড়ান তিনি। শান্তিনিকেতন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে স্বপ্ন, “ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞ প্রতিষ্ঠা হবে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।” সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ হচ্ছে এর গ্রন্থাগার। এ সময়ে আশ্রমের শিক্ষার্থীদেরকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, “ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বোহেমিয়া প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশ থেকে অজস্র পরিমাণ বই দানরূপে শান্তিনিকেতনে লাভ করেছে।” ১৯১৯ সাল থেকে বৌদ্ধশাস্ত্র, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, তিব্বতি ও চীনা প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা দানের ব্যবস্থা হয়। ১৯২৭ সালে হায়দারবাদের নিজাম সরকার ও ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯২৯ সালে মিশর বহু মূল্যবান আরবি, পারসি ও উর্দু বইপত্র বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারে দান করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বার্থক গ্রন্থাগারিকের মত গ্রন্থাগারটির ক্রমবর্ধমান রূপটির (growing organism) পূর্ণতা দিতে থাকেন।
গ্রন্থাগারিকের ধর্ম ও পাঠকচিত্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা নতুন ভাব ও কর্মধারায় বিকশিত হয়। তাঁর প্রতিভাদীপ্ত চিন্তা তৎকালীন বাংলাদেশের গ্রন্থাগার আন্দোলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে যখন বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ গঠিত হচ্ছে তখন প্রমথ চৌধুরীও গ্রন্থাগার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি তাঁর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেন, “লাইব্রেরির মধ্যেই আমাদের জাত মানুষ হবে।” “আমার মনে হয় এ দেশে লাইব্রেরির স্বার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল ও কলেজের চাইতে কিছু বেশি।” ভারতীয় উপমহাদেশে এর শুরু ঊনিশ শতকের শেষে এবং সেটা অভিবক্ত বাংলাদেশেই প্রথম দেখা দেয়। শান্তিনিকেতনকে বিশ্বভারতীতে রূপান্তর করার সময় গ্রন্থ সংগ্রহ ও গ্রন্থাগার প্রকল্প হাতে নিয়ে এবং তারপরে (১৩৩৫ বঙ্গাব্দে) ১৯২৮ সালে নিখিল বঙ্গ গ্রন্থাগার সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে গ্রন্থাগারের দর্শন ও বিজ্ঞান তুলে ধরেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা
লাইব্রেরির আকৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। “লাইব্রেরি অত্যন্ত বেশি বড় হলে কোনো লাইব্রেরিয়ান তাকে সত্য ভাবে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে পারে না। সেজন্য আমি মনে করি বড় বড় লাইব্রেরি মূখ্যত ভাণ্ডার, ছোট ছোট লাইব্রেরি ভোজনশাল্পতা পত্যহ প্রাণের ব্যবহারে ভোগের ব্যবহারে লাগে। ছোট লাইব্রেরি বলতে আমি এই বুঝি, তাতে সকল বিভাগের বই থাকবে। কিন্তু একইবারে চোখা চোখা বই। বিপুলায়তন গণনার বেদিতে নৈবেদ্য যোগাবার কাজে একটি বইও থাকবে না, প্রত্যেক বই থাকবে নিজের বিশিষ্ট মহিমা নিয়ে।” ব্যবহারেই বইয়ের স্বার্থকতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “নিজের প্রকৃত শিক্ষক নিজেই এবং শিক্ষার স্থান লাইব্রেরি।”
ভালো বই একদিকে জীবন গঠনের সহায়ক আবার অন্যদিকে অন্তরঙ্গ বন্ধু। পাঠক বই পড়ার মধ্যে দিয়ে এক আনন্দলোকের সন্ধান পায়। পাঠক চিত্তে ভাল বই পড়ার প্রভাব শুধুর প্রসারী। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য চর্চা শুরু হয় বই পড়ার অভ্যাস থেকে। তবে রবীন্দ্রচিন্তায় বই পড়ে পড়ে মনের স্বাভাবিক শক্তিকে একেবারেই আচ্ছন্ন করার বিপক্ষে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “মানুষের জ্ঞান ও ভাবকে বইয়ের মধ্যে সঞ্চিত করিবার যে একটা প্রচুর সুবিধে আছে সেকথা অস্বীকার করিতে পারি না। কিন্তু সে সুবিধার দ্বারা মনের স্বাভাবিক শক্তিতে একেবারে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলে বুদ্ধিকে কাবু করিয়া তোলা হয়।”
রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা প্রবন্ধে বলেছেন, “মানুষের অনেকগুলি মনের ভাব উৎপন্ন হইতেছে যাহা কেবল পুথির সৃষ্টি। এই সকল বাস্তবতাবর্জিত ভাবগুলো ভূতের মত মানুষকে পাইয়া বসে, তাহার মনের স্বাস্থ্য নষ্ট করে; বই পাঠের দ্বারা সত্যকে জানতে হয়। সত্যকে জানার ফলে মানুষ অন্ধ সংস্কার ও বিশ্বাস থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন হয় এবং সেই স্বাধীন চিত্ত নিজস্ব চিন্তাশক্তি ও মননশক্তির স্বাভাবিক স্ফূরণ ঘটাতে সক্ষম হয়। রাশিয়া ভ্রমণকালে তিনি রাশিয়ার গ্রন্থাগারগুলোর কার্যদ্বারা বিশেষভাবে লক্ষ্য করে বলেছিলেন গ্রন্থাগারকে সক্রিয় ও সৃষ্টিধর্মী করে তুলতে হবে। শ্রীনিকেতনে পল্লী উন্নয়নের কাজে রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাংলাদেশে ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থা চালু করেন।
আরও পড়ুন প্রবন্ধ গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের গ্রন্থাগার আন্দোলনের পথিকৃত। তখন কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ১৯২৫ সালে তারই সভাপতিত্ত্বে লাইব্রেরি এসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ তখন অনেকগুলো নামকরা পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে ওঠেছিল। এ সকল লাইব্রেরির প্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রয়াসে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ গড়ে ওঠে, যার নেতৃত্ব দেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
গ্রন্থারিকের কর্তব্য ও দায়িত্ব বিবেচনা করে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থারিককে শিক্ষক ও পণ্ডিতমণ্ডলীর মত সমান শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদকে অভিনন্দন জানিয়ে উত্তরায়ণ থেকে ১৯৩৭ সালে লেখা এক বাণীতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “Wish the efforts of the Bengal Library Association All Success. The Association will meet a great demand in the country by training qualified Librarians.”
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাগার চিন্তা