রক্তে-জ্বলে-একাত্তর-২য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

রক্তে জ্বলে একাত্তর (২য় পর্ব)

রক্তে জ্বলে একাত্তর (২য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

নির্বাচনী হাওয়ায় মুখরিত এলাকা। নমিনেশন পেয়েছে সরকারি দলের পক্ষে শমসের সুলতান।
এ নিয়ে হাওয়ায় ভাসছে নানান গুজব। কেউ বলছে বিশ লক্ষ, আবার কেউ এক ডাকে পঞ্চাশ পর্যন্ত। এ যেন কোরবানি ঈদের গরুর মূল্য। তবে এটা ঠিক টাকার পরিমাণ যাই হোক, শমসের সুলতান মোটা অর্থ খরচ করেছে, তো বটেই। তা না হলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান সৈয়দ রাশেদ হাসান; সুদর্শন,মার্জিত এবং সুশিক্ষিত; উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দলের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক; তাকে নমিনেশন হতে বঞ্চিত করলো। এছাড়াও তিনি একটা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। স্বামী-স্ত্রী দুজনই শিক্ষক। এলাকায় শিক্ষিত পরিবার বলে খ্যাত। বিসিএস পরীক্ষা কৃতকার্য হয়েও, মায়ের অনুরোধে লোভনীয় সোনার হরিণ চাকরিতে যোগদান করেননি। তার মা বলেছিলেন-উঁচু পদে চাকরি করে দেশ সেবা করা যায় কিন্তু জনসেবা করা যায় না। আভিজাত আর অহংকার নিয়ে সমাজের উঁচুতলায় বসবাস করা যায় বটে, ওটা কোন জীবন না।

তাদের পরিবারের কোন কিছুর অভাব নেই। তার মা চায় এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে তার ছেলে থাকবে। এটা তার মায়ের জেদ। কেন এই জেদ, কেউ কখনো জানার সুযোগ পায়নি। শুধু তার নিজের ইউনিয়নে নয়, উপজেলায় অন্যান্য ইউনিয়নে রয়েছে তার সুনাম। শুধু তাই নয়, রয়েছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। সঙ্গে আছে দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এক ঝাঁক তরুণ সেনানী। সূর্য মার্কা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শমসের সুলতানের বিরুদ্ধে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে, তরুণ সমাজের প্রতিনিধি সৈয়দ রাশেদ হাসান।

আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা

ভোটের আর মাত্র পাঁচদিন বাকী। খবর আসছে উপজেলার সকল পর্যায়ের সরকারি লোকদের হাত করেছে শমু সুলতান। বিরোধীদের কারো মাঠে নামতে দেয়া হবে না। চিন্তায় পড়ে গেলেন রাশেদ। গভীর রাত ধরে শলাপরামর্শ হচ্ছে। হাতে বেশি সময় নেই। বৈঠাকখানায় সবাই মন ভার করে বসে আছে। এমন সময় রাশেদের মা প্রবেশ করলেন।
─ তোমাদের কি হয়েছে? দেখে মনে হচ্ছে, নির্বাচনের আগেই হেরে বসে আছো। তোমরা সবাই তরুণ এবং শিক্ষিত। তোমরা কোন দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছো না। তোমাদের ভেতরে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ভুলে যেও না স্বাধীনতা বিরোধীদের এটা একটা নতুন কৌশল। সরকারি দলের নেতাদের হটিয়ে সুকৌশলে নেতা হয়ে যাচ্ছে আর সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অনেক নেতা। বেরিয়ে আসতে হবে এই অনৈতিক খেলা হতে। এটা সত্য যে উপর মহলকে কেউ আসল খবর জানায় না। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের কোন্দলের কারণে অনেক সত্য ঘটনা কেউ জানতে পারে না।

রাশেদ, তোমার তো অনেক বন্ধু আছে, যারা অনেকেই সরকারি বড় পদে চাকরিতে আছেন। এটা জানি, তাদের অনেকের সাথে তুমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখো। এছাড়া বৌমার বেশ কজন আত্মীয় আছেন। তাদের কাছেও সাহায্য চাও। তোমরা তো অন্যায় কোন আবদার করছো না। শুধু ন্যায় বিচার চাইছো। ভোট কেন্দ্রে যেন ভোটারগণ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে। কেউ যেন ভয়ভীতি দেখাতে না পারে, এটুকু হলেই চলবে। তোমাদের চা-নাস্তার ব্যবস্থা করছি। রাতে খাবার খেয়ে এখানেই থেকে যাবে।

কথাগুলো বলে চলে গেলেন রাশেদের মা। কথাগুলো সবার পছন্দ হয়েছে। তাই তো রাশেদের বেশ কজন বন্ধু বিসিএস প্রশাসন এবং পুলিশ ক্যাডারের আছে। রাশেদের চাকরিতে যোগদান না করার পিছনে ওর মার নিষেধ ছিল, এটা সবাই জানে। বন্ধুদের সাহায্য চাইতে পারে। দেখা যাক, সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। রাতে খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।

আরও পড়ুন গল্প জারজ

শমসের সুলতান শতভাগ নিশ্চিত হয়ে আছে, নির্বাচনে সেই জয়ী হবে। প্রশাসন তার পক্ষে আছে। টাকা ছড়িয়েছে যেখানে যা প্রয়োজন। ভোটের আগের দিন মাহি আসবে, তখন লোকজন আরো অবাক হবে।
এদিকে রাশেদ তার বন্ধুদের কাছে বিস্তারিত বলেছে। এ-ও বলেছে, এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করছে একমাত্র তার মায়ের ইচ্ছেয়। বুদ্ধিমান বন্ধুরা বুঝে গেছে, রাশেদের মা’র অভিপ্রায় কি। তারাও চায় দেশে সৎ এবং শিক্ষিত যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসুক। রাশেদ একজন শিক্ষিত যুবক। বয়স মাত্র ত্রিশের কোঠায়। বন্ধুরা আশ্বাস দিয়েছে, স্থানীয় এবং জেলা পর্যায়ের প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে এবং কোন পক্ষপাতিত্ব করবে না। শুধু তাই নয় রাশেদকে গোপনে নিরাপত্তা দিবে।

ভোটের আর মাত্র দু’দিন বাকী। নির্বাচন প্রচার চুড়ান্ত পর্যায়ে। নির্বাচন অফিস হতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখন চলছে অন্দর মহলের খেলা। রাশেদ জানে বিরোধী দলের ভোট সে পাবে না। কিছু ভোট হয়ত দিবে, যারা ব্যক্তিগতভাবে রাশেদকে চেনে। একজন ভালো মানুষ হিসেবে সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। আবার অনেকেই চাইছে যে, দল বা প্রতীকের প্রার্থী যেই হোক না কেন, সৎ এবং শিক্ষিত ব্যক্তি হতে হবে।
সেই হিসেবে বিবেচনা করলে সৈয়দ রাশেদ হাসান একজন ভাল প্রার্থী। শমসের সুলতানের অতীত কাহিনী অনেকের জানা আছে। সুবিধাবাদী এবং শিয়ালের মত ধুর্ত। খোলস বদলাতে সময় লাগে না। কিভাবে রাতারাতি দল বদল করে সরকারি দল হতে নমিনেশন বাগিয়ে নিয়েছে। রাশেদ এবং তার কর্মী বাহিনী এর মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে যে, এলাকায় অনেক পরিবার আছে যারা কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শ নিয়ে দল করে না। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা যে দল করে, তাদের সুবিধার্থে, সে দলের সমর্থক। এক কথায় আত্মীয়বাজি দল সমর্থক। এদের সঠিকভাবে বুঝাতে পারলে কাজ হবে। তাই কর্মীদের কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে কাজ বণ্টন করলে ভালো হবে। প্রস্তাবটা সবাই লুফে নিলো। সেই ভাবে কাজ শুরু করবে, তবে রাশেদের মা’র সাথে পরামর্শ করতে হবে। মাত্র সন্ধ্যা। রাতে খাবারের সময় রাশেদ তার মা-র সাথে আলোচনা করে নিবে।

আরও পড়ুন  গল্প পক্ষিরাজের ডানা

সন্ধ্যার পরপর সবাই খাবার খেতে বসেছে। রাশেদের মা এবং স্ত্রী মৌ তদারকি করছে। রাশেদের পরিকল্পনা তার মাকে অবহিত করলে, একবাক্যে সমর্থন করলেন। তিনি কিছু পরামর্শ দিলেন।
─ আমার একটা সহজ-সরল কথা। এ প্রজন্মের তরুণদের পছন্দ হবে কি-না জানি না। তোমরা অনেকেই রাশেদকে পছন্দ করো বলেই তাকে সমর্থন করছো। কিন্তু অনেকেই দলগত ভাবে ভিন্ন মতের আছো। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে এ কথা ঠিক যে আমরা একটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী একটা পক্ষ আছে। তারা কিন্তু বসে নেই। ছলেবলে এবং বিভিন্ন কৌশলে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দলে ঢুকে পদ বাগিয়ে নিচ্ছে। আর তার পিছনে আছে একদল সুযোগ সন্ধানী মানুষ। প্রত্যেক গ্রামে গোপনে কাজ করো, জয় তোমাদের হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষ জেগে উঠবে এবং ত্যাগ করবে স্বাধীনতা বিরোধীদের। তারা ‘৪৭ কে আর্দশ বলে মনে করে কিন্তু ভুলে গেছে একাত্তরে সেই সাতচল্লিশ কবরস্থ হয়েছে চিরদিনের জন্য। একাত্তরে আমাদের শ্লোগান ছিল জয় বাংলা। বড়ই পরিতাপের বিষয় আমাদেরই জয় বাংলা শ্লোগানধারীরা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাতারাতি সাতচল্লিশে ফিরে যায়। আর আমাদের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা ফেরার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিষধর গোখড়া খোলস পাল্টিয়ে আবার ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। আর তারই দূষিত বীজ হলো শমসের সুলতান ওরফে শমু সুলতান এবং একাত্তরের ঘৃণিত রাজাকার গাজী সুলতান। এবার তোমরা তোমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখে, কি করবে তা তোমাদের সিদ্ধান্ত। কাউকে জোর করে অথবা তোমাদের স্যারের প্রতি কর্তব্য মনে করে ভোট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বলছি না। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক সময় পাবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিবে। দ্বিচারিনী আমার অপছন্দ। জীবন চলার পথে অনেক কিছু শিখেছি এবং জেনেছি।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

শেষের কথাগুলো দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন রাশেদের মা। উপস্থিত যুবকদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ন মতের কিন্তু বুদ্ধি হওয়ার পর হতে ভিন্ন ধারার মতামত শুনে আসছে। কিন্তু কেউ তাদের সঠিক ইতিহাস জানানোর আগ্রহ প্রকাশ করেনি। রাশেদের মায়ের কথায় মনে হয়েছে, আসল ইতিহাস জানা দরকার। তারা যা শুনেছে বাপ-দাদারের মুখে। স্বার্থ রক্ষার জন্য গোপন করেছে সঠিক ইতিহাস। এ যেন পূর্ণিমার চাঁদকে অন্ধকারে ঢেকে রাখা। অনেকের পরিবার আবার শমু সুলতানের পক্ষে কাজ করছে। রাতেই তারা প্রতিজ্ঞা করে, আজ হতে সঠিক ইতিহাস জানবে। তার আগে যে করেই হোক রাশেদ স্যারকে ভোট যুদ্ধে জেতাতে হবে এবং পরিবারের সবাইকে শমু সুলতানের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য কাজ করে যাবে। শমু সুলতানদের আসল চেহারা উন্মোচন করতেই হবে। শপথ নেয় এ প্রজন্মের কতিপয় সাহসী যুবক। আর রাতেই পাল্টিয়ে যায় গ্রাম্য রাজনীতির পেক্ষাপট।

সকালে প্রশান্ত আবহাওয়া সারা ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের দিন যেন সেই সত্তরের নির্বাচনের সুশীতল হাওয়া। সেই সময়টা ছিল শীতকাল। তবে আজকের মত গ্রামে এত বাজার-ঘাট ছিল না, ছিল না চায়ের দোকান আর মানুষের আড্ডা।

সকাল হতেই চায়ের দোকানে লোকজনের সমাগম। কানাঘুষা চলছে, দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পর বড় সুলতানের মেজ ছেলে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহি সুলতান গ্রামে এসেছে। বাতাসে গুজব উড়ে বেড়াচ্ছে, চাচাতো ভাইকে জেতানোর জন্য বাক্স ভরে টাকা নিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রক্তে জ্বলে একাত্তর (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!